অবকাঠামো আছে, জনবল নেই
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য একসময় আশার আলো ছিল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। কিন্তু এখন সেটি ন্যূনতম চিকিৎসাসেবাও দিতে হিমশিম খাচ্ছে। মানবসম্পদের চরম সংকট আর প্রায় এক বছর ধরে অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ না থাকায় হাসপাতালটি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালটি বহু বছর আগে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও এখনও ৫০ শয্যার জন্য অনুমোদিত জনবল দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। অথচ খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বরাদ্দ মাত্র ১০০ শয্যার উপযোগী। এক কর্মকর্তা জানান, “অবকাঠামো ও জনবলের এই অসামঞ্জস্যতা হাসপাতালকে কার্যত অকার্যকর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।”
৫০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যার যাত্রা
১৯৭০ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ২০০৩ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। কিন্তু নতুন জনবল যোগ হয়নি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬ তলা নতুন ভবন উদ্বোধন করেন, যার ক্ষমতা ছিল ২৫০ শয্যা।

তবে সাত বছর পরও সেই সম্প্রসারিত ভবন কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়নি। ভবন দোতলা হলেও চিকিৎসা সেবা চালাতে জনবল বিপর্যয়করভাবে অপ্রতুল।
৫০টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ২৯টি খালি
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ৫০টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ২৯টি এখন শূন্য। এর মধ্যে রয়েছে সিনিয়র চক্ষু বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র ও জুনিয়র অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র শিশু বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, জুনিয়র ইএনটি কনসালট্যান্ট, জুনিয়র রেডিওলজিস্ট, মেডিকেল অফিসার ও ডেন্টাল সার্জনের পদ।
এছাড়াও ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির প্রায় ২০টি পদ বহু বছর ধরে শূন্য রয়েছে।
অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ না থাকায় বন্ধ অপারেশন থিয়েটার
অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতিতে জানুয়ারি থেকে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার কার্যত বন্ধ। এমনকি সাধারণ সার্জারিও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়েছে। এতে রোগীরা বাধ্য হচ্ছেন অন্য হাসপাতালে গিয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে, যা ঝুঁকি ও কষ্ট দুই-ই বাড়াচ্ছে।
অস্থায়ীভাবে জিবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন ডা. এ এস এম মোস্তফা কামালকে ডেপুটেশনে আনা হয়েছে। তিনি অ্যানেস্থেসিয়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় সাময়িকভাবে অস্ত্রোপচার কার্যক্রম দেখাশোনা করছেন। কিন্তু হাসপাতালকর্মী ও রোগীদের ভাষায়, “এটি কেবল ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ দেওয়া মাত্র।”

রোগীদের হতাশা ও অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস
পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডের রোগী উজির আলী বলেন, “এক মাস ধরে ভর্তি আছি। ডাক্তার সোমবার অপারেশনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু এখনও হয়নি। গরিব মানুষের যেন মৃত্যুতেও শান্তি নেই।”
মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডের রোগীর মেয়ে পারভিনা খাতুন জানান, “গত সপ্তাহে অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, এখন আবার বলছে অপেক্ষা করতে হবে।”
অন্য এক রোগী সেলিনা খাতুন বলেন, “১৫ দিন ধরে আছি। তারিখ দেয়, আবার বদলে ফেলে। এখন জানি না, আদৌ হবে কি না।”
“একজন বিশেষজ্ঞে ভর করে চলছে”—ডা. তন্ময়
জুনিয়র সার্জারি কনসালট্যান্ট ডা. ইহসানুল হক তন্ময় জানান, জানুয়ারিতে অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ বদলি হওয়ার পর থেকেই অপারেশন থিয়েটার বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে এক সহকারী সার্জন যোগ দেওয়ার পর সীমিত আকারে অপারেশন শুরু হলেও এটি টেকসই সমাধান নয়। “দুটি অ্যানেস্থেসিয়া কনসালট্যান্টের পদ পূরণ করা গেলে আমরা পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করতে পারব,” তিনি বলেন।

৩৫০ রোগী, ৫০ শয্যার জনবল
অ্যাক্টিং আরএমও ডা. ওহেদ মাহমুদ রবিন জানান, “আধিকারিকভাবে আমরা ১০০ শয্যার হাসপাতাল, কিন্তু চালাচ্ছি ৫০ শয্যার জনবল নিয়ে। অথচ প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ রোগী ভর্তি থাকে।”
তিনি আরও বলেন, “অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ না থাকায় অপারেশন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। কিছু অপারেশন আমরা সীমিতভাবে চালাচ্ছি, কিন্তু জটিল রোগীদের বাইরে পাঠাতে হচ্ছে।”
তার আহ্বান, দ্রুত দুই অ্যানেস্থেসিয়া কনসালট্যান্টসহ সব শূন্য পদে নিয়োগ দিতে হবে, না হলে স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

নাগরিক সমাজের উদ্বেগ
চুয়াডাঙ্গা পৌর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলী বিশ্বাস বলেন, “১৬ লাখ মানুষের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র এই সদর হাসপাতাল। এখানে যদি পদগুলো পূরণ না করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।”
তিনি বলেন, “অপারেশনের বিলম্ব, ওষুধের ঘাটতি, চিকিৎসকের অনুপস্থিতি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা হাসপাতালটিকে এখন দুর্ভোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।”
প্রশাসনের নীরবতা
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
# চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল, স্বাস্থ্যসেবা সংকট, অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ ঘাটতি, হাসপাতাল জনবল সংকট, বাংলাদেশ স্বাস্থ্যব্যবস্থা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















