০৪:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৪ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ মে ২০২৪
  • 16
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

হেরম্ব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল। ‘কথার কথা কেউ বলে না, আনন্দ, আজ পর্যন্ত কারো মুখে আমি অর্থহীন কথা শুনিনি। তোমার ঈর্ষা হয়েছে।’

হেরম্বকে আশ্চর্য করে দিয়ে সহজভাবে আনন্দ একথা স্বীকার করল, ‘কেন তা হয়? আমার মন ছোট বলে?’

‘ঈর্ষা খুব স্বাভাবিক, আনন্দ, সকলের হয়।’

‘সকলের হোক, আমার কেন হবে?’

প্রশ্নটা হেরম্ব ঠিক বুঝতে পারল না। এ যদি আনন্দের অহঙ্কার হয় তবে কোন কথা নেই। কিন্তু সে যদি সরলভাবে বিশ্বাস করে থাকে যে তার অসাধারণ প্রেমে ঈর্ষারও স্থান নেই, তা’হলে হয়তো তাকে অনেকক্ষণ বকতে হবে। বলতে হবে, তোমার খিদে পায় না আনন্দ? মাঝে মাঝে প্রকৃতি তোমাকে শাসন করে না? হিংসাকে তেমনি প্রকৃতির নিয়ম বলে জেন।

হেরম্ব কথা বলল না দেখে আনন্দ বোধহয় একটু ক্ষুন্ন হল। যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানেই মেঝেতে সে বসল। তাকে চৌকিতে উঠে বসতে বলার মতো মনের জোর হেরম্ব আজ খুঁজে পেল না। সমুদ্রতীরের কলরব থেকে দূরে চলে আসার পর তার মনে যে স্তব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো একটা ভারী আবরণের মতো তা তার মনকে চাপ দিয়ে রেখেছে। সুপ্রিয়ার সেই হাতে ভর দিয়ে বসবার শিখিল ভঙ্গী মনে পড়ে। আসন্ন সন্ধ্যায় সুপ্রিয়া স্খলিত পদে তার পরিত্যক্ত গৃহে প্রবেশ করার পর অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে তার অন্তরের অমৃত পিপাসাকে ছাপিয়ে যে কোটি ক্ষুধিত কামনার হাহাকার উঠেছিল মাটির মানুষ হেরম্বকে এখনো তা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার দেহ শোকে অবসন্ন, মৃত্তিকার কীটদংশনে বিপন্ন তার মন।

‘আমার আজ কি হয়েছে জান?’-আনন্দ বলল।

হেরম্ব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘বল, শুনছি।’

সকাল থেকে নিজেকে আমার অশুচি মনে হয়েছে। কেবল ছোট কথা মনে হয়েছে, হীন অশুদ্ধ ভাব মনে এসেছে। রাগে হিংসায় ঘেন্নাতে আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। ঠিক যেন নরকবাস করেছি সারাটা দিন। এমন কষ্ট পেয়েছি আমি! যে ছিল অবোধ নিষ্পাপ শিশু, আজ সে আত্মজ পাপে মাথা হেঁট করল, তাই তোমাকে বলেছিলাম সন্ধ্যার পর আমার কাছে থেকো, কোথাও যেও না। আমি নিচে নেমে গেছি, আমাকে তুমি তুলে নিতে পার?’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৩ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৩ তম কিস্তি )

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৪ তম কিস্তি )

১২:০০:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ মে ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

হেরম্ব বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল। ‘কথার কথা কেউ বলে না, আনন্দ, আজ পর্যন্ত কারো মুখে আমি অর্থহীন কথা শুনিনি। তোমার ঈর্ষা হয়েছে।’

হেরম্বকে আশ্চর্য করে দিয়ে সহজভাবে আনন্দ একথা স্বীকার করল, ‘কেন তা হয়? আমার মন ছোট বলে?’

‘ঈর্ষা খুব স্বাভাবিক, আনন্দ, সকলের হয়।’

‘সকলের হোক, আমার কেন হবে?’

প্রশ্নটা হেরম্ব ঠিক বুঝতে পারল না। এ যদি আনন্দের অহঙ্কার হয় তবে কোন কথা নেই। কিন্তু সে যদি সরলভাবে বিশ্বাস করে থাকে যে তার অসাধারণ প্রেমে ঈর্ষারও স্থান নেই, তা’হলে হয়তো তাকে অনেকক্ষণ বকতে হবে। বলতে হবে, তোমার খিদে পায় না আনন্দ? মাঝে মাঝে প্রকৃতি তোমাকে শাসন করে না? হিংসাকে তেমনি প্রকৃতির নিয়ম বলে জেন।

হেরম্ব কথা বলল না দেখে আনন্দ বোধহয় একটু ক্ষুন্ন হল। যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানেই মেঝেতে সে বসল। তাকে চৌকিতে উঠে বসতে বলার মতো মনের জোর হেরম্ব আজ খুঁজে পেল না। সমুদ্রতীরের কলরব থেকে দূরে চলে আসার পর তার মনে যে স্তব্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, এখনো একটা ভারী আবরণের মতো তা তার মনকে চাপ দিয়ে রেখেছে। সুপ্রিয়ার সেই হাতে ভর দিয়ে বসবার শিখিল ভঙ্গী মনে পড়ে। আসন্ন সন্ধ্যায় সুপ্রিয়া স্খলিত পদে তার পরিত্যক্ত গৃহে প্রবেশ করার পর অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে তার অন্তরের অমৃত পিপাসাকে ছাপিয়ে যে কোটি ক্ষুধিত কামনার হাহাকার উঠেছিল মাটির মানুষ হেরম্বকে এখনো তা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার দেহ শোকে অবসন্ন, মৃত্তিকার কীটদংশনে বিপন্ন তার মন।

‘আমার আজ কি হয়েছে জান?’-আনন্দ বলল।

হেরম্ব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘বল, শুনছি।’

সকাল থেকে নিজেকে আমার অশুচি মনে হয়েছে। কেবল ছোট কথা মনে হয়েছে, হীন অশুদ্ধ ভাব মনে এসেছে। রাগে হিংসায় ঘেন্নাতে আমি অস্থির হয়ে পড়েছি। ঠিক যেন নরকবাস করেছি সারাটা দিন। এমন কষ্ট পেয়েছি আমি! যে ছিল অবোধ নিষ্পাপ শিশু, আজ সে আত্মজ পাপে মাথা হেঁট করল, তাই তোমাকে বলেছিলাম সন্ধ্যার পর আমার কাছে থেকো, কোথাও যেও না। আমি নিচে নেমে গেছি, আমাকে তুমি তুলে নিতে পার?’

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৩ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৫৩ তম কিস্তি )