০২:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫
নাইজেরিয়ায় খরা মৌসুমের চাষাবাদ ধীরগতি: ধান–মকাই–গমের দামের পতনে কৃষকের অনাগ্রহ ওয়াশিংটন ডিসির গুলিবর্ষণের পর ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপ: যুক্তরাষ্ট্রে আইনি অভিবাসনেও ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা গুগল কি এনভিডিয়ার ‘একচেটিয়া আধিপত্য’ ভেঙে দিচ্ছে? এআই চিপ দৌড়ে নতুন শক্তির উত্থান স্পেনে ফ্রাঙ্কোর মতাদর্শের ‘পুনর্জাগরণ’? ৫০ বছর পরও কর্তৃত্ববাদী অতীতের ছায়া ফ্রান্সের গ্রাভেলিনসে ছোট নৌকার ফ্রন্টলাইন: ব্রিটেনে যাওয়ার অপেক্ষায় আটকে ৩ হাজার অভিবাসী টম স্টপার্ড আর নেই: বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও থিয়েটারের নতুন দিগন্ত তৈরি করা কিংবদন্তির বিদায় ব্রিটেনে সবজি খাওয়া কমেছে, বাড়ছে রেডিমেড খাবার–জাঙ্ক ফুডের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে মানুষ? রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের নতুন জীবনী: ‘মাস্টার স্টোরিটেলার’-এর জীবনে আলো–ছায়ার চিত্র ব্রিটেনে কমছে পাফিন, মহাকাশে বেঁচে ফিরল শেওলা, আর স্টোন এজ ‘চুইংগাম’-এ চমক—বিজ্ঞান বলছে কী পাকিস্তানে ‘নতুন যুগের অভ্যুত্থান’? সেনাপ্রধান আসিম মুনীরের হাতে সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে চাঞ্চল্য

ফ্রান্সের গ্রাভেলিনসে ছোট নৌকার ফ্রন্টলাইন: ব্রিটেনে যাওয়ার অপেক্ষায় আটকে ৩ হাজার অভিবাসী

উত্তর ফ্রান্সের গ্রাভেলিনস সমুদ্রসৈকতে ভোরের কমলা আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে টহল দিতে শুরু করে দুই ব্রিটিশ তরুণ—ড্যানি থমাস ও রায়ান ব্রিজ। হাতে আইফোন, বুকে ঝোলানো গোপ্রো, তারা বালুচরে পড়ে থাকা কোট, জুতা, টিয়ারগ্যাসের খালি ক্যানিস্টার দেখিয়ে ভিডিও বানায় ইনস্টাগ্রামের জন্য। তাদের ভাষায়, “শত শত হাজার অনিবন্ধিত পুরুষ” নাকি ব্রিটেনে ঢুকে খুন, গণধর্ষণ করছে এবং “স্বদেশি শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা”কে “প্রতিস্থাপন” করছে। ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এই সংকট চালু রেখেছে—যুক্তরাজ্যকে অস্থিতিশীল করার জন্য। আজ সৈকতে কোনো নৌকা নেই, অভিবাসীও নেই; তবু তাদের চিৎকার থেমে নেই।

গ্রাভেলিনসের দু’মাইল লম্বা এই সৈকতই এখন ব্রিটেনমুখী ছোট নৌকার সংকটের নতুন ফ্রন্টলাইন। আশপাশের বন আর খালে–খাঁদে অস্থায়ী ক্যাম্পে অন্তত তিন হাজার অভিবাসী অপেক্ষা করছেন—কবে সমুদ্রে নামবে পরের নৌকা। ফরাসি পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালালেও আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে তারা খুব বেশি কিছু করতে পারছে না; ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অচলাবস্থা, যেখানে কেউই জিতছে না।

ছোট নৌকায় বাড়তি চাপ, রাজনীতিতে ঝড়

গত এক বছরে (জুন পর্যন্ত) যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত পথে পৌঁছেছেন ৪৯,৩৪১ জন মানুষ—এর ২৭ শতাংশ বেশি আগের বছরের তুলনায়। অধিকাংশই ছোট নৌকায় করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। বিষয়টি এখন শুধু ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ আলোচনাই নয়, ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী জনতাবাদের উত্থানেও জ্বালানি জুগিয়েছে।
নতুন হোম সেক্রেটারি শাবানা মাহমুদ ছোট নৌকার সংখ্যা কমাতে ও ব্যর্থ আশ্রয়প্রার্থীদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে একগুচ্ছ কড়া প্রস্তাব দিয়েছেন—অস্থায়ী শরণার্থী মর্যাদা, স্থায়ী বসবাসের আগে দীর্ঘ অপেক্ষা, ব্যর্থ আবেদনকারীদের জন্য আর্থিক প্রोत्सাহনসহ ফেরার নীতি না মানলে জোরপূর্বক বহিষ্কারের হুমকি। একই সময়ে রিফর্ম ইউকে জরিপে লেবারের চেয়ে এগিয়ে থাকায় রাজনৈতিক চাপ আরও বেড়েছে।

লুন-প্লাজের ক্যাম্প: ধোঁয়া, ময়লা আর সামান্য মানবিকতার আশ্রয়

গ্রাভেলিনস থেকে মাত্র ১৫ মিনিট দূরের লুন-প্লাজ এখন এক অঘোষিত ‘শহর’—যেখানে সিগারেটের বাক্স বিক্রি হয় ভাঁজ করা টেবিলে, বাতাস ভরে থাকে পুড়ে যাওয়া প্লাস্টিকের গন্ধে, আর চারপাশে স্তূপ হয়ে থাকে আবর্জনা। ময়লা পরিষ্কার করতে আসতে চায় না সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও; তারা জায়গাটিকে “খুব বিপজ্জনক” বলে এড়িয়ে চলে।
এখানেই সপ্তাহে চার দিন মানবিক সংগঠন সালাম প্রায় এক হাজারকে গরম খাবার দেয়—হালাল মুরগি, সবজি, পাস্তা আর প্রতিজনের হাতে একটি করে কলা। বহু বছর আগের ক্যালের ‘জঙ্গল’ ক্যাম্প ভেঙে দেওয়ার পর ওই ৭ হাজার মানুষের অংশ এখন ছড়িয়ে আছে এ রুটে—গ্রাভেলিনস থেকে ডানকার্ক পর্যন্ত গাছের আড়ালে নীল–সবুজ টেন্টের ভিড়ে। শীত ঘনালে নৌকার সংখ্যা কমছে, কিন্তু ক্যাম্পে আটকে পড়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

ফরাসি পুলিশের “জিরো ফিক্সেশন” নীতি অনুযায়ী, মাসে দুবার এই টেন্ট ধ্বংস করা হয়—বস্তা, বিছানা, কাপড় সব পুড়িয়ে বা ভেঙে দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর আবার নতুন টেন্ট, আবার নতুন নৌকা ধরার চেষ্টা। এই একঘেয়ে চক্রে আটকে আছেন সবাই—পুলিশ, অভিবাসী আর স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ক্রিস্টিন এভার্ড বলেন, “জানদার্মরা অনেক সময় অত্যন্ত আগ্রাসী হয়, আমি নিজে একবার একজনকে মারতে দেখেছি, গিয়ে থামাতে হয়েছে। কিন্তু সব ভেঙে দিয়ে কী লাভ? আট দিন পর আবার একই দৃশ্য।”

স্মাগলার, গুলির শব্দ আর জীবন বাজি রাখা তরুণ–তরুণীরা

খাবারের সারিতে দাঁড়ানো মানুষজন নিঃশব্দে অপেক্ষা করলেও চারপাশে সবসময় নজর রাখে স্মাগলাররা। কেউ ছবি তুললেই চিৎকার, কখনো আবার অস্ত্র বের করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভয় দেখানো—কেউ যেন ব্যবসায় হস্তক্ষেপ না করে। স্বেচ্ছাসেবীদেরকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়—“গাড়ি এমনভাবে রাখুন, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত চলে যেতে পারেন।”

সুদানের ২৪ বছর বয়সী ফাতিমা নরম কণ্ঠে বলেন, তিনি দুই সপ্তাহ ধরে উত্তর ফ্রান্সের ক্যাম্পে আছেন। বাবা–মা মারা গেছেন, বোনরা আছে ম্যানচেস্টারে, তাদের কাছে যেতে চান। লিবিয়া, ইতালি, ফ্রান্স—পাড়ি দিতে দিতে এখন হাতে আছে মাত্র ৪০০ ইউরো। নৌকা ভাড়া দিতে সাধারণত লাগে হাজার হাজার ইউরো, তাই তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত উঠতে পারবেন কি না। “আমি সাঁতার জানি না, খুব ভয় পাই,” বলেন তিনি। “কিন্তু আপনি জানেন সুদানে এখন কী হচ্ছে? আর ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই।”

সোমালিয়ার আলি, ৩০, বলেন, তিনি জার্মানিতে দুই বছর কাজ করেছেন; আশ্রয় আবেদন নাকচ হওয়ায় এখন তাকে হয় ডিপোর্টেশন মানতে হবে, নয়তো যুক্তরাজ্যের পথ ধরতে হবে। ডাবলিন কনভেনশন অনুযায়ী, তিনি ইউরোপের প্রথম দেশেই কেবল আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন—সেটি আগেই শেষ। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে, সেখানে নতুন করে আবেদন করা সম্ভব। এজন্যই তিনি জমানো ১,২০০ ইউরো দিয়ে স্মাগলারদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।

স্থানীয়দের ক্ষোভ, মেয়রের অসহায়তা আর লন্ডন–প্যারিসের চুক্তি

গ্রাভেলিনসের মেয়র বের্ত্রাঁ রিঙ্গো বলছেন, শহরটি এখন চাপ সামলাতে পারছে না। কখনো নাইট শিফট শেষে বাড়ি ফেরা লোকজন সামনে দেখছেন শতাধিক অভিবাসী আর হাতে মাত্র কয়েকজন পুলিশ—ভোর বা সূর্যাস্তের আগে সবাই জড় হয় সৈকত সংলগ্ন গাছের আড়ালে। কাউকে ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস, ফ্ল্যাশ গ্রেনেড ছুড়তে হয়—এর মাঝেই ভাঙচুর হয় গাড়ি, বাড়ি, ছোট ব্যবসা।
শহর পরিষ্কার রাখতে তাকে অতিরিক্ত ছয়জন কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে; ক্যামেরা বসাতে হয়েছে ২৭০টি, অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়াও দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি শুরুতে এসবের পক্ষে ছিলাম না, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েছি। এখানে যা ঘটছে, এটা কেবল ডান–বাম রাজনীতির প্রশ্ন নয়; একজনের স্বাধীনতা যেখানে শেষ, অন্যের স্বাধীনতা সেখানেই শুরু।”

২০২৩ সালে যুক্তরাজ্য তিন বছরের এক চুক্তিতে ফ্রান্সকে ৪৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড দেয় ছোট নৌকা রুখতে সহায়তার জন্য—পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ২০২৭ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই অর্থের অংশ দিয়ে বাড়ানো হয়েছে টহল, নজরদারি, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার খরচ। কিন্তু ময়দানে থাকা মানুষদের অভিজ্ঞতা বলছে, সামগ্রিক চিত্র খুব কমই বদলেছে।

সামনে শীত, জমছে বোতলনেক

হাওয়ার গতিবেগ বেশি থাকায় আজ কোনো নৌকা যাচ্ছে না। পুলিশ গাড়ি নিয়ে বারবার সৈকত ঘুরছে; দূরে কুকুর হাঁটাচ্ছেন কেউ, কেউ ঘোড়ায় চড়ছেন—তার মধ্যেই চলে ‘নিয়ন্ত্রণের অভিনয়’। আবহাওয়া আরও খারাপ হবে, তাপমাত্রা নামবে শূন্যের নিচে—লুন-প্লাজে ক্যাম্পের ভিড় আরও বাড়বে।
নতুন করে টেন্ট গড়া, পুলিশি ধ্বংস, আবার ইংলিশ চ্যানেলের দিকে ছুটে যাওয়া—এই চক্র ভাঙার কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক রোডম্যাপ নেই এখনো। দূর থেকে সমুদ্র দেখতে হয়তো সুন্দর, কিন্তু তার ঢেউয়ের ওপর সবকিছু বাজি রেখে যারা পাড়ি দিতে চায়, তাদের জন্য গ্রাভেলিনস এখন আশা আর শত্রুতা মিলিয়ে এক নির্মম অপেক্ষার নাম।

জনপ্রিয় সংবাদ

নাইজেরিয়ায় খরা মৌসুমের চাষাবাদ ধীরগতি: ধান–মকাই–গমের দামের পতনে কৃষকের অনাগ্রহ

ফ্রান্সের গ্রাভেলিনসে ছোট নৌকার ফ্রন্টলাইন: ব্রিটেনে যাওয়ার অপেক্ষায় আটকে ৩ হাজার অভিবাসী

০১:১৬:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

উত্তর ফ্রান্সের গ্রাভেলিনস সমুদ্রসৈকতে ভোরের কমলা আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে টহল দিতে শুরু করে দুই ব্রিটিশ তরুণ—ড্যানি থমাস ও রায়ান ব্রিজ। হাতে আইফোন, বুকে ঝোলানো গোপ্রো, তারা বালুচরে পড়ে থাকা কোট, জুতা, টিয়ারগ্যাসের খালি ক্যানিস্টার দেখিয়ে ভিডিও বানায় ইনস্টাগ্রামের জন্য। তাদের ভাষায়, “শত শত হাজার অনিবন্ধিত পুরুষ” নাকি ব্রিটেনে ঢুকে খুন, গণধর্ষণ করছে এবং “স্বদেশি শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা”কে “প্রতিস্থাপন” করছে। ফরাসি ও ব্রিটিশ সরকার নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এই সংকট চালু রেখেছে—যুক্তরাজ্যকে অস্থিতিশীল করার জন্য। আজ সৈকতে কোনো নৌকা নেই, অভিবাসীও নেই; তবু তাদের চিৎকার থেমে নেই।

গ্রাভেলিনসের দু’মাইল লম্বা এই সৈকতই এখন ব্রিটেনমুখী ছোট নৌকার সংকটের নতুন ফ্রন্টলাইন। আশপাশের বন আর খালে–খাঁদে অস্থায়ী ক্যাম্পে অন্তত তিন হাজার অভিবাসী অপেক্ষা করছেন—কবে সমুদ্রে নামবে পরের নৌকা। ফরাসি পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালালেও আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে তারা খুব বেশি কিছু করতে পারছে না; ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অচলাবস্থা, যেখানে কেউই জিতছে না।

ছোট নৌকায় বাড়তি চাপ, রাজনীতিতে ঝড়

গত এক বছরে (জুন পর্যন্ত) যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত পথে পৌঁছেছেন ৪৯,৩৪১ জন মানুষ—এর ২৭ শতাংশ বেশি আগের বছরের তুলনায়। অধিকাংশই ছোট নৌকায় করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। বিষয়টি এখন শুধু ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ আলোচনাই নয়, ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী জনতাবাদের উত্থানেও জ্বালানি জুগিয়েছে।
নতুন হোম সেক্রেটারি শাবানা মাহমুদ ছোট নৌকার সংখ্যা কমাতে ও ব্যর্থ আশ্রয়প্রার্থীদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে একগুচ্ছ কড়া প্রস্তাব দিয়েছেন—অস্থায়ী শরণার্থী মর্যাদা, স্থায়ী বসবাসের আগে দীর্ঘ অপেক্ষা, ব্যর্থ আবেদনকারীদের জন্য আর্থিক প্রोत्सাহনসহ ফেরার নীতি না মানলে জোরপূর্বক বহিষ্কারের হুমকি। একই সময়ে রিফর্ম ইউকে জরিপে লেবারের চেয়ে এগিয়ে থাকায় রাজনৈতিক চাপ আরও বেড়েছে।

লুন-প্লাজের ক্যাম্প: ধোঁয়া, ময়লা আর সামান্য মানবিকতার আশ্রয়

গ্রাভেলিনস থেকে মাত্র ১৫ মিনিট দূরের লুন-প্লাজ এখন এক অঘোষিত ‘শহর’—যেখানে সিগারেটের বাক্স বিক্রি হয় ভাঁজ করা টেবিলে, বাতাস ভরে থাকে পুড়ে যাওয়া প্লাস্টিকের গন্ধে, আর চারপাশে স্তূপ হয়ে থাকে আবর্জনা। ময়লা পরিষ্কার করতে আসতে চায় না সিটি করপোরেশনের কর্মীরাও; তারা জায়গাটিকে “খুব বিপজ্জনক” বলে এড়িয়ে চলে।
এখানেই সপ্তাহে চার দিন মানবিক সংগঠন সালাম প্রায় এক হাজারকে গরম খাবার দেয়—হালাল মুরগি, সবজি, পাস্তা আর প্রতিজনের হাতে একটি করে কলা। বহু বছর আগের ক্যালের ‘জঙ্গল’ ক্যাম্প ভেঙে দেওয়ার পর ওই ৭ হাজার মানুষের অংশ এখন ছড়িয়ে আছে এ রুটে—গ্রাভেলিনস থেকে ডানকার্ক পর্যন্ত গাছের আড়ালে নীল–সবুজ টেন্টের ভিড়ে। শীত ঘনালে নৌকার সংখ্যা কমছে, কিন্তু ক্যাম্পে আটকে পড়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

ফরাসি পুলিশের “জিরো ফিক্সেশন” নীতি অনুযায়ী, মাসে দুবার এই টেন্ট ধ্বংস করা হয়—বস্তা, বিছানা, কাপড় সব পুড়িয়ে বা ভেঙে দেওয়া হয়। কয়েকদিন পর আবার নতুন টেন্ট, আবার নতুন নৌকা ধরার চেষ্টা। এই একঘেয়ে চক্রে আটকে আছেন সবাই—পুলিশ, অভিবাসী আর স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ক্রিস্টিন এভার্ড বলেন, “জানদার্মরা অনেক সময় অত্যন্ত আগ্রাসী হয়, আমি নিজে একবার একজনকে মারতে দেখেছি, গিয়ে থামাতে হয়েছে। কিন্তু সব ভেঙে দিয়ে কী লাভ? আট দিন পর আবার একই দৃশ্য।”

স্মাগলার, গুলির শব্দ আর জীবন বাজি রাখা তরুণ–তরুণীরা

খাবারের সারিতে দাঁড়ানো মানুষজন নিঃশব্দে অপেক্ষা করলেও চারপাশে সবসময় নজর রাখে স্মাগলাররা। কেউ ছবি তুললেই চিৎকার, কখনো আবার অস্ত্র বের করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভয় দেখানো—কেউ যেন ব্যবসায় হস্তক্ষেপ না করে। স্বেচ্ছাসেবীদেরকেও সতর্ক করে দেওয়া হয়—“গাড়ি এমনভাবে রাখুন, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত চলে যেতে পারেন।”

সুদানের ২৪ বছর বয়সী ফাতিমা নরম কণ্ঠে বলেন, তিনি দুই সপ্তাহ ধরে উত্তর ফ্রান্সের ক্যাম্পে আছেন। বাবা–মা মারা গেছেন, বোনরা আছে ম্যানচেস্টারে, তাদের কাছে যেতে চান। লিবিয়া, ইতালি, ফ্রান্স—পাড়ি দিতে দিতে এখন হাতে আছে মাত্র ৪০০ ইউরো। নৌকা ভাড়া দিতে সাধারণত লাগে হাজার হাজার ইউরো, তাই তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত উঠতে পারবেন কি না। “আমি সাঁতার জানি না, খুব ভয় পাই,” বলেন তিনি। “কিন্তু আপনি জানেন সুদানে এখন কী হচ্ছে? আর ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই।”

সোমালিয়ার আলি, ৩০, বলেন, তিনি জার্মানিতে দুই বছর কাজ করেছেন; আশ্রয় আবেদন নাকচ হওয়ায় এখন তাকে হয় ডিপোর্টেশন মানতে হবে, নয়তো যুক্তরাজ্যের পথ ধরতে হবে। ডাবলিন কনভেনশন অনুযায়ী, তিনি ইউরোপের প্রথম দেশেই কেবল আশ্রয়ের আবেদন করতে পারবেন—সেটি আগেই শেষ। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে, সেখানে নতুন করে আবেদন করা সম্ভব। এজন্যই তিনি জমানো ১,২০০ ইউরো দিয়ে স্মাগলারদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন।

স্থানীয়দের ক্ষোভ, মেয়রের অসহায়তা আর লন্ডন–প্যারিসের চুক্তি

গ্রাভেলিনসের মেয়র বের্ত্রাঁ রিঙ্গো বলছেন, শহরটি এখন চাপ সামলাতে পারছে না। কখনো নাইট শিফট শেষে বাড়ি ফেরা লোকজন সামনে দেখছেন শতাধিক অভিবাসী আর হাতে মাত্র কয়েকজন পুলিশ—ভোর বা সূর্যাস্তের আগে সবাই জড় হয় সৈকত সংলগ্ন গাছের আড়ালে। কাউকে ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস, ফ্ল্যাশ গ্রেনেড ছুড়তে হয়—এর মাঝেই ভাঙচুর হয় গাড়ি, বাড়ি, ছোট ব্যবসা।
শহর পরিষ্কার রাখতে তাকে অতিরিক্ত ছয়জন কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে; ক্যামেরা বসাতে হয়েছে ২৭০টি, অনেক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়াও দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি শুরুতে এসবের পক্ষে ছিলাম না, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েছি। এখানে যা ঘটছে, এটা কেবল ডান–বাম রাজনীতির প্রশ্ন নয়; একজনের স্বাধীনতা যেখানে শেষ, অন্যের স্বাধীনতা সেখানেই শুরু।”

২০২৩ সালে যুক্তরাজ্য তিন বছরের এক চুক্তিতে ফ্রান্সকে ৪৭৬ মিলিয়ন পাউন্ড দেয় ছোট নৌকা রুখতে সহায়তার জন্য—পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ২০২৭ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই অর্থের অংশ দিয়ে বাড়ানো হয়েছে টহল, নজরদারি, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার খরচ। কিন্তু ময়দানে থাকা মানুষদের অভিজ্ঞতা বলছে, সামগ্রিক চিত্র খুব কমই বদলেছে।

সামনে শীত, জমছে বোতলনেক

হাওয়ার গতিবেগ বেশি থাকায় আজ কোনো নৌকা যাচ্ছে না। পুলিশ গাড়ি নিয়ে বারবার সৈকত ঘুরছে; দূরে কুকুর হাঁটাচ্ছেন কেউ, কেউ ঘোড়ায় চড়ছেন—তার মধ্যেই চলে ‘নিয়ন্ত্রণের অভিনয়’। আবহাওয়া আরও খারাপ হবে, তাপমাত্রা নামবে শূন্যের নিচে—লুন-প্লাজে ক্যাম্পের ভিড় আরও বাড়বে।
নতুন করে টেন্ট গড়া, পুলিশি ধ্বংস, আবার ইংলিশ চ্যানেলের দিকে ছুটে যাওয়া—এই চক্র ভাঙার কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক রোডম্যাপ নেই এখনো। দূর থেকে সমুদ্র দেখতে হয়তো সুন্দর, কিন্তু তার ঢেউয়ের ওপর সবকিছু বাজি রেখে যারা পাড়ি দিতে চায়, তাদের জন্য গ্রাভেলিনস এখন আশা আর শত্রুতা মিলিয়ে এক নির্মম অপেক্ষার নাম।