সমুদ্রপথে আটকে থাকা অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ভূ–রাজনীতি, নিষেধাজ্ঞা এবং বড় ক্রেতাদের দ্বিধার কারণে প্রায় ১৪০ কোটি ব্যারেল তেল এখনো বন্দরের বাইরে অপেক্ষায়। তবু বৈশ্বিক তেলের দামে বড় ঝাঁকুনি দেখা যাচ্ছে না, যা বাজারে এক ধরণের অস্বস্তিকর স্থিতাবস্থা তৈরি করেছে।
রিপোর্টে তুলে ধরা হলো সেই সংকটের পূর্ণ চিত্র।
সমুদ্রপথে রেকর্ড তেলের ভিড়
ভরটেক্সার হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ১৪০ কোটি ব্যারেল তেল সমুদ্রে জমে আছে। ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের গড় হিসাবের তুলনায় এটি প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি। এসব চালানের বড় অংশ এখনো ক্রেতাহীন বা বন্দরে নামার অপেক্ষায়।
নিষেধাজ্ঞা, অতিরিক্ত সরবরাহ আর বাড়তি উৎপাদন
ওপেক প্লাস ধীরে ধীরে উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও গায়ানার মতো দেশ তেল রফতানি আরও বাড়িয়েছে। এর ফলে গত এক বছরে মূলধারার উৎপাদকদের সরবরাহ বেড়েছে ১৬ শতাংশ।
এরই মধ্যে রাশিয়া, ইরান ও ভেনেজুয়েলার নিষেধাজ্ঞাগ্রস্ত তেলের পরিমাণ এক বছরে বেড়েছে ৮২ শতাংশ। হঠাৎ করে এত বেশি ‘অন্ধকার ব্যারেল’ বাজারে আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
রুশ তেল এড়াচ্ছে চীন–ভারত
সাধারণত রাশিয়ার বড় ক্রেতা চীন ও ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র লুকোইল ও রোসনেফটকে নিষিদ্ধ করার পর দুই দেশই রুশ তেল কেনায় সতর্কতা নিয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র শানদং প্রদেশের একটি চীনা তেল টার্মিনালকেও নিষিদ্ধ করেছে, যা নিয়মিত ইরানি তেল নিত। এতে রাশিয়া ও ইরানের তেল উৎপাদন থামেনি, কিন্তু ক্রেতা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অসংখ্য ট্যাংকার সমুদ্রে আটকে আছে।

বাজারের দ্বিধা ও জটিল হিসাব
বিশ্বের মোট তেলের ১৫ শতাংশ এখন নিষেধাজ্ঞার আওতায়। এগুলোকে সরবরাহ হিসেবে গণনা করা উচিত কি না—এ নিয়ে বাজারে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
ইতিহাস বলছে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রুশ তেল বিক্রির পথ খুঁজে নেয়। সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন আবারও ভারতকে ‘নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের’ আশ্বাস দিয়েছেন।
যদি রাশিয়া নতুন সংস্থার আড়ালে বা জাহাজ থেকে জাহাজে গোপনে তেল স্থানান্তরের মাধ্যমে চীন–ভারতকে সরবরাহ পুনরায় শুরু করতে পারে, তবে ব্রেন্ট বাজারে অন্য উৎপাদকদের তেলের চাহিদা কমে যেতে পারে। দামের ওপর চাপও বাড়বে।
দাম স্থির কেন
গত দুই মাস ধরে ব্রেন্ট তেলের দাম ৬১ থেকে ৬৬ ডলারের মধ্যে স্থির রয়েছে। বিশাল অতিরিক্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও বাজার কেন ভাঙছে না, তার একটি কারণ হলো চীনের গোপন তেল মজুত।
রিস্ট্যাড এনার্জির তথ্য বলছে, এ বছর চীন প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল করে তেল মজুত করছে। ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা এই অতিরিক্ত সংরক্ষণ করছে। এই মজুদের বেশিরভাগই কৌশলগত রিজার্ভ হওয়ায় বৈশ্বিক দামে তাৎক্ষণিক প্রভাব কম।
যদি এই অতিরিক্ত তেল পশ্চিমা মূল্য নির্ধারণ কেন্দ্রগুলোতে জমা হতো, তাহলে দাম বড় আঘাত পেত। রিস্ট্যাডের হিসাব অনুযায়ী, চীন এখন পর্যন্ত যে ৯ কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল জমা করেছে, তার অর্ধেকও যদি যুক্তরাষ্ট্রের কুশিং স্টোরেজে ঢুকত, তাহলে মজুত ছুঁতো ৭ কোটি ব্যারেল—যে পর্যায়ে ২০২০ সালে দাম শূন্যের নিচে নেমেছিল।

বাজারের সামনে অদৃশ্য ঝুকি
নিষেধাজ্ঞা বাজারকে অদ্ভুত অবস্থায় ফেলেছে। সরবরাহ বাড়ছে, কিন্তু দামের প্রতিক্রিয়া ধীর। তবে একবার যদি সমুদ্রের এই জমে থাকা তেলের পাহাড় হঠাৎ স্থলভাগে ঢুকতে শুরু করে, তাহলে বৈশ্বিক তেলের দাম ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
#তেলবাজার #রাশিয়া #ইরান #চীন #বিশ্বঅর্থনীতি #জ্বালানিবিপর্যয় #তেলমূল্য #ভূরাজনীতি #সারাক্ষণ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















