কলকাতা, ৬ এপ্রিল—চট্টগ্রাম থেকে ৩৪ ঘণ্টার নৌযাত্রা শেষে আজ এখানে এসে পৌঁছেছেন একশরও বেশি বিদেশি উদ্বাস্তু। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম থেকে আসা এসব উদ্বাস্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের চেষ্টার প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা নিয়ে এসেছেন।
‘এটা একেবারে গণহত্যা,’ বলেন ডেনমার্কের নাগরিক টোন মার্টিনুসেন।
‘আমরা সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে দেখেছি,’ বলেন নিউইয়র্কের নিউ রোশেল এলাকার মার্কিন নাগরিক নিল ও’টুল। ‘আমি বেশি কিছু বলতে চাই না, কারণ আমাদের সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।’ তিনি তাঁর সংগঠনের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
সেনা অভিযান শুরু হওয়ার ঠিক পরপরই, এক সপ্তাহেরও বেশি আগে, সব বিদেশি সংবাদকর্মীকে প্রদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেন্সরশিপ অব্যাহত থাকায়, বাইরের দুনিয়ায় যে তথ্য পৌঁছাচ্ছে তার বেশির ভাগই ভারত সীমান্ত পেরিয়ে আসা প্রতিবেদনের ওপর নির্ভরশীল।
চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা একটি ব্রিটিশ জাহাজে করে আজ বিকেলে কলকাতার ডকে পৌঁছান ১১৯ জন বিদেশি। লড়াইয়ের কারণে জাহাজটি এত দিন পণ্য খালাস করতে পারেনি। তাঁরা ১৭টি ভিন্ন দেশের নাগরিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি দল ছিল ৩৭ জন মার্কিন ও ৩৩ জন ব্রিটিশ।

‘ক্ল্যান ম্যাকনেয়ার’ নামের জাহাজটি থেকে নামার সময় তাঁদের স্বাগত জানান কূটনৈতিক কর্মকর্তারা এবং ভারতীয় ও বিদেশি সংবাদকর্মীদের একটি ভিড়।
কিছু উদ্বাস্তু কথা বলতে অনিচ্ছুক থাকলেও, অন্যরা চট্টগ্রামের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, প্রায় চার লাখ মানুষের বাসস্থান চট্টগ্রামে লড়াই কীভাবে হয়েছে—এ বিষয়ে এত দিন খুব কমই জানা ছিল।
উদ্বাস্তুদের ভাষ্য অনুযায়ী, কয়েক দিনের লড়াইয়ের পর সেনাবাহিনী—যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য—শহর থেকে পূর্ব পাকিস্তানি প্রতিরোধ বাহিনীকে হটিয়ে দেয়।
তবে তাঁদের মতে, সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কর্ণফুলী নদীর তীরের বাইরে সেনাদের দখল নেই।
নদীর দক্ষিণের পুরো এলাকা এখন ‘মুক্তিবাহিনী’র নিয়ন্ত্রণে বলে জানান তাঁরা। এই বাহিনীতে রয়েছেন সাধারণ মানুষ, পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন।
উদ্বাস্তুদের দাবি, গতকাল সকালে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময়ও তাঁরা শহরের উপকণ্ঠে গুলির শব্দ শুনেছেন। তাঁদের মতে, শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাই পালিয়ে গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন।

শহরে আগুন ও ধ্বংস
২৬ মার্চ শুক্রবার ভোরে শহরে লড়াই শুরু হলে সেনাবাহিনী দরিদ্রদের বসতি—স্বাধীনতার সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থকদের এলাকা—পুড়িয়ে ছাই করে দেয় বলে জানান উদ্বাস্তুরা।
সেনা পাহারায় গতকাল সকালে ডকে নিয়ে যাওয়ার সময়ও ওই এলাকাগুলোর বাঁশের কুঁড়েঘরের ছাই তখনো ধোঁয়া ছাড়ছিল বলে তাঁদের ভাষ্য। পাকিস্তান সরকারপক্ষের পাকিস্তান রেডিও দাবি করছে, পুরো পূর্ব পাকিস্তান শান্ত রয়েছে এবং জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।
‘কিছুই শান্ত নয়, আর কিছুই স্বাভাবিক হয়নি,’ বলেন মার্টিনুসেন। তিনি ডেনমার্কের আরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর গবেষণার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে স্ত্রী কারেনকে নিয়ে সাত মাস আগে চট্টগ্রামে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তারা পরিকল্পিতভাবে দরিদ্রদের এলাকাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে, সম্ভবত মনে করেছে সেগুলো ভালোভাবে তল্লাশি করা সম্ভব নয়। তারা যেন হত্যা আর ধ্বংসে আনন্দ পাচ্ছিল।’
২৩ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘অনেক বাঙালি নিহত হয়েছে। মাত্র চার দিন আগে নদীতে এক জায়গায় ভাসতে থাকা ৪০০টি লাশ গোনা যেত।’
দোকান ও রাস্তায় সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যার একাধিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মার্টিনুসেন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, শেষ পর্যন্ত ৭ কোটি ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানিরাই জয়ী হবে। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান—যা ভারতীয় ভূখণ্ড পেরিয়ে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরে—দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানিদের শোষণ করে এসেছে।
স্বাধীনতার আন্দোলন
‘এত বেশি বাঙালি তাদের বাংলা দেশ চায়,’ বলেন তিনি, ‘আমি নিশ্চিত তারা তা অর্জন করবেই।’
বাংলা দেশ অর্থ বাঙালিদের দেশ। এটিই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নাম।
মার্টিনুসেনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন ২৬ বছর বয়সী নিল ও’টুল। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণই ভয় আর সন্ত্রাসের জোরে। সেনারা বারবার ঢুকছিল, সাধারণ মানুষকে গুলি করছিল। আমরা মৃতদেহ দেখেছি, মৃত্যুর দুর্গন্ধ পেয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাপক হয়রানি ও মারধর হয়েছে, আর বাইরে থেকে আসা লোকদের মাধ্যমে নির্বিচার লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে।’
প্রতিশোধের খবর
‘বাইরের লোক’ বলতে তিনি কাদের বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না করলেও, ধারণা করা হয় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত পশ্চিম পাকিস্তানিদের কথা বলেছেন।
অন্য উদ্বাস্তুরা জানান, কিছু বাঙালিও প্রতিশোধ হিসেবে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হত্যা করেছে।
উদ্বাস্তুদের মতে, চট্টগ্রামে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ চলছে। তিন দিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার পর কেবল শহরের কিছু অংশে বিদ্যুৎ ফিরেছে। বন্দর কার্যত বন্ধ ছিল, কারণ সেখানে কাজ করার মতো কোনো বাঙালি শ্রমিক ছিল না।
কয়েকজন উদ্বাস্তু তীব্র লড়াইয়ের সময় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে হোটেল আগ্রাবাদে আশ্রয় নেন।
তাঁরা জানান, তাঁদের অনুপস্থিতিতে সেনারা কয়েকটি বাড়িতে গিয়েছিল।
‘সেনারা খুব ভদ্র ছিল,’ ব্যঙ্গ করে বলেন নিউইয়র্কের মন্ট্রোজ এলাকার মার্কিন প্রকৌশলী এডওয়ার্ড জে. ম্যাকম্যানাস। ‘ওরা আমার সব হুইস্কি খেয়েছে, কিন্তু সব গ্লাস ফিরিয়ে দিয়েছে। খুবই সৎ।’
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























