জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহ্বান উপেক্ষা করে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে নয়াদিল্লির প্রধান লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এসব লক্ষ্য হলো অসন্তুষ্ট বাঙালি প্রদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক দমননীতির পরাজয় এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থী—মুসলমান ও হিন্দু—যেন দ্রুত একটি স্বাধীন, বন্ধুত্বপূর্ণ ও ধর্মনিরপেক্ষ ‘বাংলাদেশ’-এ ফিরে যেতে পারে, সে জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি।
এগুলো ভারতের জন্য স্বল্পমেয়াদে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সাম্প্রতিক পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলিতে ভারতের ভঙ্গুর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছিল। পাকিস্তান ভেঙে পড়লে একসময়ের সামরিক শক্তিধর মুসলিম প্রতিবেশীর হুমকি কার্যত দূর হবে; দেশটি তখন তার আগের আয়তনের অর্ধেকেরও কমে সীমিত থাকবে।
তবে এই সাফল্যের বিনিময়ে ভারতকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে—এমনকি যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বৃহত্তর যুদ্ধ দ্রুত শেষও হয়ে যায় এবং পশ্চিম সীমান্তে ভারতের ভূখণ্ডে আর বড় ধরনের ক্ষতি না হয়।

শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব সম্ভাবনা শেষ না করেই নয়াদিল্লির বলপ্রয়োগের পথে যাওয়া—বিশেষ করে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের যুক্তিসংগত মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে ঠান্ডাভাবে প্রত্যাখ্যান—ভারতের বহু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বিস্মিত করেছে এবং বিশ্বজনমতের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বিচ্ছিন্ন করেছে। জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন এবং সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য করার ফলে ভারতের একসময়ের গর্বিত নৈতিক অবস্থান স্পষ্টভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের অবিশ্বাস্যভাবে স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ও নির্মম নীতির কারণে পূর্ণ বাঙালি স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সমর্থন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ‘বাংলাদেশ’-এর আবির্ভাবে যে নতুন বিপদ ও সমস্যা সৃষ্টি হবে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ কারও নেই—বিশেষ করে ভারতের।
পূর্ব বাংলায় বিচ্ছিন্নতার সাফল্য উপমহাদেশজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবির শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে—ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই। চরম দারিদ্র্যপীড়িত ও অতিমাত্রায় জনবহুল এই দেশ—বর্তমানে যার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যা আগামী বিশ বছরে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা—ঘরোয়া অস্থিরতার উর্বর ক্ষেত্র এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। এটি ভারতের বাঙালিদের জন্য এক আকর্ষণকেন্দ্র হয়ে ভারতীয় ঐক্যের সূক্ষ্ম কাঠামোর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

উপমহাদেশজুড়ে আরও দারিদ্র্য, বিভাজন ও সংঘাত এড়াতে দিল্লি, ঢাকা ও ইসলামাবাদের নেতাদের বর্তমান বিভেদ ও তিক্ততা দূরে সরিয়ে রেখে নতুন সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান গঠনের সন্ধানে একত্র হওয়া জরুরি, যাতে তারা সম্মান ও শান্তির সঙ্গে অভিন্ন ও জরুরি সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারে। উদীয়মান প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ভারতের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে এমন নৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার, যা পুনর্মিলনের পথ দেখাবে—যে নেতৃত্ব বর্তমান সংঘাতে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত ছিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























