কিছু পশ্চিমা পর্যবেক্ষকের কাছে দৃশ্যটি মনে করিয়ে দেয় পন্টিয়াস পিলাতের সেই মুহূর্ত, যখন তিনি যিশু ও বারাব্বাসের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন। “আপনারা কি মুজিবকে মুক্ত দেখতে চান?”—করাচিতে এক লাখের বেশি সমর্থকের সমাবেশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এভাবে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। ভুট্টোর শক্তিশালী বক্তৃতায় যেমনটা প্রায়ই হয়, জনতা গর্জে ওঠে সম্মতিতে। মাথা নত করে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আপনারা আমার একটি বড় বোঝা নামিয়ে দিলেন।”
এইভাবেই গত সপ্তাহে ভুট্টো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন সেই সিদ্ধান্ত, যা তিনি আগে টাইমের সংবাদদাতা ড্যান কগিনকে জানিয়েছিলেন—তার বিখ্যাত বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। একসময়ের পূর্ব পাকিস্তানের নিঃসন্দেহ রাজনৈতিক নেতা এবং এখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হবে।
পাঁচ দিন পর, মুজিবের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের পর ভুট্টো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। তিনি নিজে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে গিয়ে একটি ভাড়া করা পাকিস্তানি বিমানে মুজিবকে লন্ডনের উদ্দেশে বিদায় জানান। সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ভোর তিনটায় বিমানটি ছাড়ে। পাকিস্তানে সাংবাদিকদের এ খবর জানানো হয় দশ ঘণ্টা পরে—ইরানের শাহ ছয় ঘণ্টার সফরে একই বিমানবন্দরে পৌঁছানোর ঠিক আগে। ততক্ষণে মুজিব লন্ডনে পৌঁছে গেছেন—ক্লান্ত, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ। “আপনারা যেমন দেখছেন, আমি পুরোপুরি জীবিত ও সুস্থ,” বলেন মুজিব, হাতে ব্রায়ার পাইপ নিয়ে হালকা ভঙ্গিতে। “এই মুহূর্তে আমি শুধু দেখা দিতে চাই, কথা বলতে নয়।”

তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ঢাকায় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর মুজিব লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলের বলরুমে সংবাদ সম্মেলন করেন। হোটেলের বাইরে তখন উচ্ছ্বসিত অসংখ্য পূর্ববঙ্গের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। মুজিব বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবি করেন—যাকে তিনি বলেন “অপ্রতিহত বাস্তবতা”—এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানান।
প্রচণ্ড ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে মুজিব বর্ণনা করেন তার জীবন—“প্রচণ্ড তাপে মরুভূমির এক এলাকায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সেলে”—পরিবার বা বাইরের জগতের কোনো খবর ছাড়াই নয় মাস কাটাতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, তাকে যেকোনো সময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারত। “আর যে মানুষ মরতে প্রস্তুত, তাকে কেউ হত্যা করতে পারে না।” যুদ্ধের খবর তিনি বুঝেছিলেন, কারণ “সামরিক বিমান চলাচল ছিল, আর ব্ল্যাকআউট চলছিল।” ভুট্টোর সঙ্গে প্রথম বৈঠকের পরই তিনি জানতে পারেন যে বাংলাদেশ নিজস্ব সরকার গঠন করেছে। পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে মুজিব বলেন, “আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন, তিনিও লজ্জা পেতেন।”
তবে ভুট্টোর ব্যাপারে মুজিব ভালো কথাই বলেন, যদিও জোর দিয়ে উল্লেখ করেন—বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো যোগসূত্র বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি, যা ভুট্টো মরিয়া হয়ে চান। “আমি তাকে বলেছি, দেশে ফিরে আমার জনগণের সঙ্গে কথা বলার পরই এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারি,” বলেন মুজিব। তিনি কেন ঢাকার বদলে লন্ডনে গেলেন? “আপনি কি জানেন না আমি বন্দি ছিলাম?”—খাপছাড়া জবাব দেন তিনি। “এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছা, আমার নয়।” লন্ডনে থাকাকালে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করতে চান, তারপর বিজয়োল্লাসময় প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশে যাবেন।
অল্পই বিকল্প। মুজিবকে লন্ডনে পাঠানো কিছুটা বিস্ময়কর হলেও তাকে মুক্তি দেওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। বাস্তবে ভুট্টোর কাছে তেমন বিকল্পও ছিল না। বন্দি মুজিব পাকিস্তানের কোনো উপকারে আসছিল না; আর নিহত ও শহীদ মুজিব হলে পূর্ববঙ্গের মানুষের ঘৃণা আরও গভীর হতো। কিন্তু বিজয়োল্লাসময় জনতার কাছে ফিরিয়ে দিলে হয়তো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ঢিলেঢালা সম্পর্কের দিকে টানা যেতে পারে—এমন ভাবনাই ছিল ভুট্টোর।

লন্ডনের সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান সম্পর্কে মুজিবের তীব্র বক্তব্যের পর ভুট্টোর সেই স্বপ্ন অবাস্তবই মনে হয়। তবু কোনো না কোনো সম্পর্ক পুরোপুরি অসম্ভব নয়। আপাতত বাংলাদেশ আর্থিক, সামরিক ও অন্যান্য সহায়তার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। ভুট্টো হয়তো ভেবেছিলেন, একসময় বাংলাদেশের নেতারা ভারতীয় সেনা ও আমলাদের উপস্থিতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এবং পরাজিত মুসলিম ভাইদের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক বিবেচনা করবেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশকে পুরোনো কিছু বাণিজ্যিক সম্পর্কও পুনঃস্থাপন করতে হতে পারে। ভুট্টোর ভাষায়, “বর্তমান বাস্তবতাই চূড়ান্ত বাস্তবতা নয়।”
বিপুল স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উচ্ছ্বাস ভুট্টোর অজানা ছিল না। মুজিব মুক্তির খবর পৌঁছাতেই ঢাকা জাতীয় নায়কের জন্য এক বিশাল অভ্যর্থনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। পুরো সপ্তাহজুড়ে রাজধানী ছিল উত্তেজনায় টইটম্বুর। তার আসন্ন আগমনের প্রথম খবর ছড়াতেই মানুষ রাস্তায় নেমে আসে—চিৎকার, নাচ, গান, আকাশে গুলি আর মুক্তির সেই পরিচিত স্লোগান “জয় বাংলা”। অনেকেই গিয়েছিলেন সেই ছোট বাংলোয়, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা মুজিবের স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দি করে রেখেছিল। বেগম সেদিন উপবাসে ছিলেন। “মার্চে যখন গুলির শব্দ শুনেছিলাম, তা ছিল বাংলাদেশের মানুষ হত্যার জন্য,” অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেন তিনি। “এখন গুলি ছোড়া হচ্ছে আনন্দ প্রকাশের জন্য।”
আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের খুব প্রয়োজন হবে। বিশ্বের নবতম রাষ্ট্রটি একই সঙ্গে অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্রও।
গত মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের পর বিশ্বব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শক দল জানায়, কিছু শহরকে দেখাচ্ছিল “পারমাণবিক হামলার পরের সকাল”। এরপর ধ্বংস আরও বেড়েছে। আনুমানিক ৬০ লাখ বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, প্রায় ১৪ লাখ কৃষক পরিবার কাজের উপকরণ ও পশু হারিয়েছে। যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত—রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত, সেতু ভেঙে পড়েছে, নৌপথ বন্ধ।

পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করার এক মাস আগ পর্যন্ত লুটপাট চালিয়েছে। যুদ্ধের শেষ দিকে পশ্চিম পাকিস্তান মালিকানাধীন প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের তহবিল পশ্চিমে পাঠিয়ে দেয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের হিসাবে পড়ে থাকে মাত্র ১১৭ রুপি। সেনারা ব্যাংক নোট ও কয়েনও ধ্বংস করে, ফলে অনেক এলাকায় নগদ টাকার তীব্র সংকট দেখা দেয়। ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় তুলে নেওয়া হয় অথবা ডিলারদের কাছ থেকে জব্দ করে পশ্চিমে পাঠানো হয়।
ধ্বংসস্তূপের বাগান। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস পাট—১৯৬৯-৭০ সালে যার আয় ছিল ২০৭ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু অভ্যন্তরীণ পরিবহন সচল না হওয়া পর্যন্ত মিল থেকে বাজারে পাট পৌঁছানো যাচ্ছে না। শিল্পযন্ত্র মেরামত তুলনামূলক সহজ হলেও ধ্বংসপ্রাপ্ত চা-বাগান আবার উৎপাদনক্ষম করা কঠিন। তদুপরি, নিম্নমানের যে চা প্রায় পুরোপুরি পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি হতো, তার জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। বাংলাদেশকে নিজস্ব মুদ্রা ছাপাতে হবে এবং তার পেছনে স্বর্ণভাণ্ডার জোগাড় করতে হবে। ঢাকার এক ব্যাংকার বলেন, “আমাদের কঠিন মুদ্রা দরকার। তার মানে মিলের পাট দ্রুত বিক্রি করা, রুপিতে নয়, নগদে। বিদেশি সহায়তা, খাদ্য সাহায্য, পরিবহনব্যবস্থা—সব একসঙ্গে ঠিক করতে হবে। আমদানিও কমাতে হবে।”
পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব আরও নির্দিষ্ট। দেশকে ১৯৬৯-৭০ সালের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেই লাগবে ৩০০ কোটি ডলার, যখন মাথাপিছু আয় ছিল বছরে মাত্র ৩০ ডলার। স্বাধীনতার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে—পাউন্ডের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন, মাসিক বেতনসীমা ১৪০ ডলার নির্ধারণ এবং ব্যাংক থেকে উত্তোলনে সীমা আরোপ। এসব ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগের শহুরে মধ্যবিত্ত সমর্থকেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তেমন বিরোধিতা নেই; কারণ অনেকেই সরকারের মধ্যপন্থী সমাজতান্ত্রিক পথকে সমর্থন করছেন। গত সপ্তাহে নজরুল ইসলাম ঘোষণা দেন, শিগগিরই ব্যাংকিং, বীমা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও মৌলিক শিল্প জাতীয়করণ করা হবে—“শোষণমুক্ত অর্থনীতি” গড়ার লক্ষ্যে।
নতুন রাষ্ট্রের বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটিরও বেশি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন। গত সপ্তাহে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ ফিরেছেন। প্রত্যাবর্তনে উৎসাহ দিতে পরিবারপ্রতি রান্নার বাসন, তেল, কয়লা, চকলেট, দুই সপ্তাহের চাল-ডাল ও সামান্য নগদ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্প করা হয়েছে। সরকার স্বীকার করছে, বিদেশি সহায়তা ও জাতিসংঘের সাহায্য অপরিহার্য।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। আপাতত মুজিবের প্রতি প্রায় সর্বজনীন আস্থা থাকলেও তিনি কত দ্রুত সংস্কার আনতে পারবেন, তা প্রশ্ন। মুক্তিবাহিনীর অনেক তরুণ যোদ্ধা মধ্যপন্থী রাজনীতিতে সন্তুষ্ট নাও থাকতে পারেন। গ্রামাঞ্চলে ঢাকার ক্ষমতা এখনও দূরবর্তী।

ইতিমধ্যে গেরিলারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত। মুজিব বাহিনী এখন নিজেদের “মিশন” বলছে। এক কমান্ডার বলেন, “আমাদের সামাজিক আদর্শ বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র নামাব না।” অন্যজনের ভাষায়, “বিপ্লব শেষ হয়নি, শুরু হয়েছে।” তবে এখন পর্যন্ত মুজিব বাহিনী বিহারিদের রক্ষা করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। সরকার তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে পুলিশ ও মিলিশিয়া বাহিনীতে রূপান্তরের পরিকল্পনা করছে।
সামনের কাচে মুজিব
অতীতের ধ্বংস আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশ এখনও সুন্দর। ঢাকার পথে যুদ্ধের ক্ষত কম চোখে পড়ে। বাজারে ফল ও নিত্যপণ্যের বেচাকেনা চলছে। ঢাকা এক প্রাদেশিক শহরের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ—রঙিন রিকশা, সর্বত্র নতুন পতাকা, গাড়ির সামনে মুজিবের ছবি। শহরজুড়ে অর্ধসমাপ্ত ভবন—একদিন হয়তো এগুলো সম্পূর্ণ হবে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানবন্দর হোক বা কলকাতা-ঢাকা সড়ক—সবচেয়ে চোখে পড়ে শান্ত পরিবেশ। আমেরিকান পরিচয় জানাজানি হলে প্রশ্ন আসে—নিক্সন প্রশাসন এমন আচরণ করল কেন? তবু বিশ্বাস আছে, আমেরিকার মানুষ তাদের পাশে। তাজউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “নিক্সন প্রশাসন গভীর ক্ষত দিয়েছে। সময় ক্ষত সারায়, কিন্তু দাগ থাকে। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা আমেরিকানদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা স্থায়ী শত্রুতা পোষণ করি না।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























