খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনের নানা আয়োজন চলছে বাংলাদেশেও, তবে এর মধ্যেও সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি খ্রিস্টান চার্চ এবং ব্যক্তির কাছে ‘তৌহিদী মুসলিম জনতা’ পরিচয়ে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয় গত দোসরা ডিসেম্বর।
ঠিক এক মাস আগেই ঢাকার কয়েকটি চার্চ এবং সেন্ট জোসেফ স্কুলসহ দেশের বেশ কয়েকটি চার্চে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এরইমধ্যে গত ১৮ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন পোশাক শ্রমিককে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক এই ঘটনা এবং পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহে বিচার বা প্রতিকার না পাওয়ার কারণে সংখ্যালঘু হিসেবে শঙ্কা বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতিনিধিরা।
হুমকি-হামলার ঘটনার একটি তালিকা সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়ে নিরাপত্তা চাওয়ার তথ্যও জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু আর্চবিশপ বিজয় এন ক্রুজ এর প্রতিনিধি ফাদার আলবার্ট রোজারিও বিবিসি বাংলাকে জানান, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়েছেন তারা।
কিন্তু ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এক ধরনের শঙ্কা নিয়েই উৎসবের আয়োজন চলছে।
মি. রোজারিও বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রেসপন্স করেছে, কিন্তু যারা এগুলোর হোতা তাদেরকে তো ধরতে পারছে না।”
বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ চতুর্দশ লিও গত ১৬ই নভেম্বর এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে কয়েকটি দেশে খ্রিস্টানদের বৈষম্য এবং নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও ছিল।
অবশ্য গির্জা এবং উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকার দাবি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। তারা বলছে, কেবল খ্রিস্টান চার্চই নয়, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
“সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে,” বলে দাবি করেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও।

হামলা-হুমকির যেসব অভিযোগ উঠেছে
গত সাতই নভেম্বর রাতে ঢাকার রমনা এলাকায় সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রাল চার্চে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এরপর নয়ই নভেম্বর সেন্ট মেরি’স ক্যাথেড্রাল চার্চের ফটকেও ককটেল হামলা হয়।
এর এক মাস আগে আটই অক্টোবর দুটি ককটেল ছোড়া হয় তেজগাঁওয়ের হলি রোজারি চার্চে। পরদিন ঢাকার আর্চবিশপ ও বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনীর সভাপতি আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এ ঘটনায় ভীষণভাবে আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।
এছাড়া গোপালগঞ্জে চার্চের জমি দখলের চেষ্টা এবং চট্টগ্রামে ফিরিঙ্গি বাজার ব্যাপ্টিস্ট চার্চের সামনে দীর্ঘদিন ধরে ময়লার ভাগাড় তৈরির অভিযোগও রয়েছে।
বাংলাদেশ খ্রিস্টান যুব অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব শিমিয়ন জয় হাজরা বলছেন, গোপালগঞ্জের ঘোষের চর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং বেতগ্রাম চার্চের দখল হওয়া জমি উদ্ধারে নানা কর্মসূচিও পালন করেছেন তারা।
এদিকে, গত দোসরা ডিসেম্বর ২১টি চার্চ এবং ব্যক্তির কাছে ‘তৌহিদী মুসলিম জনতা’ পরিচয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন একাধিক চার্চের দায়িত্বরতরা।
কম্পিউটারে লিখে প্রিন্ট করা ঠিকানাবিহীন ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লোভ-লালসা দেখিয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরিত করছে খ্রিস্টান চার্চগুলো”। এ বিষয়ে সাবধান না হলে খ্রিস্টান উপাসনালয়ে হামলার হুমকিও দেওয়া হয় ওই চিঠিতে।
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের আর্চবিশপ বিজয় এন ক্রুজ এর প্রতিনিধি ফাদার আলবার্ট রোজারিও বিবিসি বাংলাকে জানান, ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ডিএমপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন উইংয়ে উড়ো চিঠির বিষয়টি জানানো হয়েছে।
“বিশেষ করে এই চিঠির প্রেক্ষিতে বড় দিনের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা চেয়ে খ্রিস্টান আর্চবিশপের পক্ষ থেকেও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে,” জানান তিনি।
খ্রিস্টান চার্চে হামলা, উড়ো চিঠি কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কাউকে হত্যার মতো ঘটনাগুলো দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও।
তার মতে, যারা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায় তারাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায় বা দখলের অপচেষ্টা করে।
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় হামলা, হুমকির সংখ্যা এখন কমেছে, কিন্তু আগের ঘটনাগুলো নিয়ে আমরা এখনো শঙ্কিত। বিশেষ করে ময়মনসিংহের ভালুকায় হিন্দু যুবকের নির্মম হত্যার ভিডিও দেখার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাজ করাটা স্বাভাবিক,” বলেন মি. রোজারিও।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে
সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন পোশাক শ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। যে ঘটনা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে পুরনো আলোচনা আবারও সামনে এনেছে।
অবশ্য দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে দাবি করে আসছে সরকার।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগে দায়িত্বরত এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন জানান, বড়দিন উপলক্ষে সারাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।
এছাড়া খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার অভিযোগ এবং কয়েকটি চার্চে হুমকি দিয়ে পাঠানো উড়ো চিঠির সঙ্গে কারা জড়িত সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
সম্প্রতি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে দেওয়া এক বার্তায় পুলিশ জানিয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট, মন্তব্য বা ছবি প্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এছাড়া গুজব ও অপপ্রচার প্রতিরোধে সাইবার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে একটি মহল অনেকদিন ধরেই নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে দাবি করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কিংবা হুমকির যেকোনো ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।
“আজকেও (বুধবার) আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে খ্রিস্টান নেতাদের নিয়ে বসবো,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় বা তাদের ওপর হামলা ও হুমকির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না, এই প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে, স্পেসেফিক কোনো অভিযোগ আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই খতিয়ে দেখবে।”
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এই মুহূর্তে সরকার কোনো হুমকির সম্মুখিন নয় বলেও বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হোসেন।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Sarakhon Report 


















