প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ এবেয়ের চারপাশের অগভীর পানিতে ছড়িয়ে রয়েছে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও মরিচা ধরা যন্ত্রপাতি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আশপাশের পানির মাছ দূষিত। এসব ধ্বংসাবশেষের একটির ওপর বসে আছে কয়েকজন কিশোর।
এবেয়ে দ্বীপের প্রায় দশ হাজার মানুষ কাছের একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যা চীন বা রাশিয়ার সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ধরনের ঢাল। কিন্তু দ্বীপটির বাস্তবতা অত্যন্ত কঠোর। এখানে ডায়াবেটিস মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে, আশপাশের পানির মাছ দূষিত, আর মানুষের গড় আয়ু অস্বাভাবিকভাবে কম। এই দীর্ঘদিনের অবহেলা বেইজিংয়ের জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
প্রতি শুক্রবার এই ছোট দ্বীপে নিজের দায়িত্ব পালন করতে বের হন কোরাব লানওয়ে। যাদের তিনি দেখতে যান, তাদের কারও পা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে ও রং বদলে গেছে, কারও ক্ষত সারছে না, কেউ কেউ অঙ্গ হারিয়েছেন। তারা এতটাই অসুস্থ যে পাতলা পাত ও ধাতব শিটে তৈরি ঘর ছেড়ে বেরোতে পারেন না। লানওয়ে খোঁজ নেন, তারা ওষুধ খাচ্ছেন কি না, রক্তচাপ মাপেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফলাফল হতাশাজনক।
পচে যাওয়া ছাদ আর কাঠ দিয়ে আটকানো জানালার একটি অফিস থেকে কাজ করেন লানওয়ে। তিনি এবেয়ের ডায়াবেটিস সমন্বয়কারী। তার বাড়িতে শুয়ে থাকা রোগীরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে দ্বীপের প্রাথমিক হাসপাতাল খুব বেশি কিছু করতে পারে না। রোগীদের অঙ্গ পচে যাচ্ছে, কিডনি বিকল হচ্ছে। ডায়ালাইসিসের কোনো ব্যবস্থা নেই, কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির ল্যাবও নেই। ফলে অনেকেই পঞ্চাশের আগেই মারা যান।
বিয়াল্লিশ বছর বয়সী লানওয়ে বলেন, এই অবস্থা তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। তিনি নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তার আশঙ্কা, দ্বীপটি ধীরে ধীরে তার মানুষ হারাচ্ছে।
প্রতিদিন সকালে বন্দরে জড়ো হন তারা, যারা কাজ করতে সক্ষম। সেখান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীর ফেরিতে করে প্রায় তিন মাইল দূরের কওয়াজালিন দ্বীপে যান তারা। কওয়াজালিন এবেয়ের তুলনায় দশ গুণ বড়। সেখানে তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, যখন আমেরিকানরা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় ও চীনের রকেট উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করে।
কওয়াজালিন ঘাঁটিতে থাকা প্রায় তেরশো মার্কিন সেনা ও ঠিকাদাররা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর, সুসজ্জিত পামগাছ, সুইমিং পুল, কান্ট্রি ক্লাব, গলফ কোর্স ও বোলিং অ্যালির সুবিধা ভোগ করেন। সেখানে হাসপাতাল ও পশুচিকিৎসা কেন্দ্রও রয়েছে। আমেরিকানরা দ্বীপটিকে ডাকেন ‘প্রায় স্বর্গ’।
এই বৈষম্য স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কালানি কানেকোর কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা এই নেতা বলেন, এবেয়ে ও কওয়াজালিনের জীবনযাত্রার পার্থক্য দিন আর রাতের মতো। একজন সৈনিক হিসেবে এই পরিস্থিতি তাকে বিব্রত করে, বিশেষ করে নিজের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সামনে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
এবেয়ের চল্লিশের বেশি বাসিন্দা ও মার্শালিজ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং মার্কিন সামরিক নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটি এক গভীর মানবিক সংকট। এই জনপদটি তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রই, পঞ্চাশের দশকে, আর আজও তাদের ঘাঁটি চালাতে এখানকার শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে।
২০০৮ সাল থেকে মার্কিন সামরিক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হচ্ছে যে ঘাঁটি থেকে বিষাক্ত দূষণ সাগরে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এবেয়ের আশপাশের মাছের মধ্যে আর্সেনিক ও ভারী রাসায়নিকের মাত্রা এত বেশি যে সেগুলো খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
দ্বীপটিতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়মিত ঘটনা। ২০২১ সালের এক জরিপে প্রায় অর্ধেক পরিবার জানায়, টাকার অভাবে তারা খাবার বাদ দিতে বাধ্য হয়। এসব কঠোর বাস্তবতা চীনের জন্য প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে দ্বীপের অনেক বাসিন্দার গড় আয়ু মাত্র বাহান্ন বছর। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এবেয়েতে হওয়া মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকের সঙ্গে এই রোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব মোকাবিলায় উদ্বিগ্ন। কংগ্রেস মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের জন্য দুই দশকে দুই দশমিক তিন বিলিয়ন ডলারের সহায়তা অনুমোদন করেছে, যার একটি অংশ এবেয়ের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ। চীন অবশ্য বলছে, তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতায় নেই।
এবেয়ের মেয়র বা ঐতিহ্যবাহী প্রধান এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও পেন্টাগনও প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
ডায়াবেটিস সংকট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লানওয়ে নিজ পরিবারের মধ্যেও এই রোগের বিস্তার দেখেছেন। তার বাবা, চাচা ও খালাও আক্রান্ত। প্রতিদিন সকালে তিনি নিশ্চিত করেন, তার বাবা ওষুধ নিয়েছেন কি না, তারপর দ্বীপজুড়ে রোগীদের দেখতে বের হন।
এবেয়ে দ্বীপের এই স্বাস্থ্য ও সামাজিক সংকট যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের পেছনে লুকিয়ে থাকা এক কঠিন বাস্তবতার ছবি তুলে ধরে।
পিট ম্যাকেনজি ও হলি অ্যাডামস 


















