ইউ. ইয়াকভলেভ
বীরব্রতী ভাসিয়া
বন্ধুরা ওকে বলত জরদুর্গব। তার ঢিলে-ঢালা, জবুদ্বুবু, ভ্যাবাচ্যাকা স্বভাবের জন্যে। ক্লাসে কোনো সাপ্তাহিক পরীক্ষার সময় কখনোই ওর সময়ে কুলাত না, প্রশ্নটা মাথায় ঢুকতে ঢুকতে ঘণ্টা পড়ে যেত। চা খেতে বসলে তার টেবিলে পিরিচের চারপাশে জমত চায়ের ডোবা। চলত এদিক-ওদিক হেলে দুলে, নির্ঘাৎ ধাক্কা খেত টেবিলের কানায়, নয়ত উল্টে পড়ত চেয়ার। নতুন জুতো হস্তার মধ্যেই এমন তুবড়ে যেত যেন ওই পরে সে সেনাপতি সুভোরভের সঙ্গে আপ্প্স পর্বত পেরিয়েছে।
মুখের ভাব ঢুলুঢুল, যেন এইমাত্র ঘুম ভাঙল, নয়ত এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে। সবকিছুই ওর খসে পড়ত হাত থেকে, কিছুই উৎরাত না। এক কথায় জরদ্গব। গায়ে আঁট হয়ে বসত কোট, প্যান্টে পা ঢুকত কোনোক্রমে। মুটকো মুখের ওপর থলথলে তিন থাক-মাংস: দুটি চোখের ওপরে, ভুরুর গোড়ায়, তৃতীয়টি নাক আর ওপরের ঠোঁটের মাঝামাঝি। যখন ও উত্তেজিত হয়ে উঠত অথবা বাইরের হিম থেকে ফিরত, তখন এই থাকগুলোই লাল হয়ে উঠত সবার আগে। সবাই ভাবত ওর স্থূলতার কারণ ওর পেটুকত্ব: নইলে অত মোটা সে হল আর কী থেকে। আসলে কিন্তু খেত সে কম। ভালো লাগত না তার খেতে। ও কর্মটি সে সইতেই পারত না।
ও যে জরদুর্গব সেটা লেখা ছিল ওর মুখে, জানানি দিত তার শিখিল, এলিয়ে- পড়া ভাবভঙ্গিতে, শোনা যেত তার চাপা-চাপা গলার স্বরে। অসুন্দর এই মোটা দেহের তলে কী লুকিয়ে ছিল সেটা কেউ জানত না।
অথচ বুকের তলে ওর স্পন্দিত হত বীরব্রতীর মহানুভব হৃদয়। নিজের নিভৃত স্বপ্নে ও নিজেকে দেখতে পেত ঝকমকে ইস্পাতের বর্ম’ পরা, পালক-ওড়ানো শিরস্ত্রাণের মুখ্যবরণ নামানো, চেপে আছে স্ফুরিত-নাসা শাদা ঘোড়ার পিঠে। এই বেশে সে ছুটে বেড়াচ্ছে দুনিয়ায়, দুর্বল ও অন্যায়-পীড়িতদের রক্ষা করে অসংখ্য কীর্তি’ স্থাপন করছে। ও হল নামহীন এক নাইট। কেননা নাইটদের সাধারণত থাকে গালভরা বিদেশী নাম- রিচার্ড কিংবা রোদরিগো অথবা আইভ্যানগো। আর ওকে সবাই ডাকে ভাসিয়া বলে, ও নামটা মোটেই কোনো নাইটকে মানায় না।
স্বপ্নে তার ধুমসো বেঢপ চেহারাটা হয়ে ওঠে সুঠাম আর নম্র, গতিতে দেখা দেয় ক্ষিপ্রতা আর নৈপুণ্য। ঝকমকে বর্মে’র তলে সব ত্রুটি ওর চাপা পড়ে যায় মুহূর্তে। তবে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আবার সবই ফিরে আসত স্বস্থানে। অপরূপ এক নাইটের বদলে সে সামনে দেখতে পেত জালার মতো একটা ছেলে, গোল মুটকো মুখে তার লাল হয়ে উঠেছে থাক তিনটে।
নাইটের অযোগ্য চেহারাটার জন্যে সে এ রকম সময় নিজেকেই ক্ষমা করতে পারত না।
বিদ্রূপ-পরায়ণ আয়নাটা ছাড়াও তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনত তার মা। তার পদপাতে গেলাসগুলো করুণ আর্তনাদ তুলেছে শুনতে পেয়ে মা রান্নাঘর থেকে চোচাত:
‘সাবধান! একেবারে হাতি ঢুকেছে চাঁনেমাটির দোকানে!’
এমন কথা কিনা এক মহানুভব নাইটকে?
বস্তুর কাছে তার সবপ্নের কথা বলতে গিয়েছিল সে, কিন্তু কোনো সমর্থন পেলে না।
বর্মের কথা শুনতেই বন্ধ ঠোঁট বে’কিয়ে বললে:
‘অমন মোটা শরীর কোনো বমে’ই ঢুকবে না।’
বন্ধু ভাবতেও পারে নি সে ভাসিয়ার একেবারে আঁতে ঘা দিয়েছে।
সময় পেলেই সে ছুটত মিউজিয়মে। বড়ো বড়ো হলে এখানে ভারি ভারি সোনালী ফ্রেমে ছবি টাঙানো, কোণে কোণে হলুদ হয়ে আসা মর্মরের মার্তি’। মহাশিল্পীদের ক্যানভাসগুলো সে পেরিয়ে যেত নির্বিকারভাবে, যেন সেগুলো বহুপরিচিত পোস্টার মাত্র, চলে যেত তার স্বপ্নের ঘরটিতে। কোনো ছবি ছিল না এখানে। দেয়ালে টাঙানো তরোয়াল আর বর্শা, মেঝেয় দাঁড়িয়ে বর্মাকৃত সব নাইট- মূর্তি।
ডিউটি-রত বুড়িটাকে লুকিয়ে সে ছায়ে দেখেছিল বর্মে’র ইস্পাৎ, আঙুলে পরখ করেছিল তরোয়ালে ধার কেমন। কালো নাইটের কাছ থেকে সোনালী, সোনালী থেকে রূপোলী নাইটের কাছে সে চলে যেত আপন মনে। কতকগুলোর সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব, কারো প্রতি সংযত উদাসীনতা। মাথা নাড়ত সে তাদের দিকে, তারপর মনে মনে চলত তাদের দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। তার মনে হত, নামানো মুখাবরণের ফাঁক দিয়ে নাইটরা তাকে চেয়ে দেখছে, কেউ তাকে ঠাট্টা করছে না, বলছে না সে জরদ্গব।
কেন যে ভুল হয় প্রকৃতির, ডন-কুইজোটের গর্বিত প্রাণটাকে সে দিয়ে বসে সাঞ্চো-পান্সার মুটকো বেঢপ দেহে?
বীরকীর্তি’র স্বপ্ন দেখত সে, জীবন কিন্তু বয়ে চলল একঘেয়ে মামুলী খাতে। রোজ সকালে ও অনিচ্ছায় বিছানা ছাড়ত, আর ‘তাড়াতাড়ি কর, নইলে দেরি করে ফেলবি’ মায়ের এই ধমকের তাড়ায় প্যান্ট শার্ট চাপাত গায়ে। তারপর মুখ ধুতে গিয়ে নাকটুকু ভেজাত জলে- ‘এই তোর মুখ ধোয়ার ছিরি?!’ এবং অনিচ্ছায় বসত টেবিলে। চামচে দিয়ে কিছু মোহনভোগ ঘে’টে ‘খেতে এসে ঘুমতে হবে না!’ উঠে পড়ত, চলে যেত ইশকুলে। হুড়মুড়িয়ে নামত সিড়ির ধাপ থেকে ধাপে, সবকটি ফ্ল্যাটের জানা থাকত কে যাচ্ছে। ক্লাসে সে পৌঁছত দ্বিতীয় ঘণ্টির পর। বইয়ের ভারি ব্যাগটা ধপ করে ফেলে সোধত বেঞ্চিতে, ডেস্কটা ঠেলে সরিয়ে দিত সামনে।
এ সবই সে করত একঘেয়ে জীবনে অভ্যন্ত এমন একটা লোকের নিরুদ্বেগ প্রশান্তি নিয়ে যে অপ্রত্যাশিতের কোনো আশাই রাখে না।
ক্লাসে সে গোলমাল করত না, কেননা কথা বলা তার এমনিতেই আসে না, তাহলেও অবিরাম ধমক খেতে অসুবিধা হত না কোনো।
‘রীবাকভ, মন তোর কোথায়, কী ভাবছিস?’
‘রীবাকভ, কী বললাম বল।’
‘রীবাকভ, বোর্ডে’ এসে অঙ্কটা বুঝিয়ে দে।’
পা দিয়ে ডেকে ধাক্কা মেরে সে চলে যেত বোর্ডে’, আঙুল দিয়ে খড়িটা চিপত অনেকক্ষণ, যেন তা থেকে রস নিঙড়াতে চাইছে। অঙ্কটা কষার সময় এমন হাঁস- ফাঁস করত, যেন খড়ি নয়, হাতে ওর একটা ভারি পাথর, ক্রমাগত সেটা সে ওঠাচ্ছে আর নামাচ্ছে। ভাবতে তার এত সময় যেত আর কষ্ট হত যে শিক্ষয়িত্রীর ধৈর্যে কুলাত না, ফেরত পাঠাত তার নিজের জায়গায়।
এসে বসত সে, মুহূর্তেই ডেস্কটা পরিণত হত এক জঙ্গী ঘোড়ায়, বে’টে মোটা-মোটা আঙুলগুলো নিজেরাই এ’কে নিত তরোয়াল আর বর্ম’।
ব্যায়ামের ক্লাসে সে ছিল সার্বজনীন উপহাসস্থল। ওর যখন বারে হাঁটার পালা আসত, আগে থেকেই হাসি শুরু হয়ে যেত’ ছেলেদের মধ্যে। বহু কষ্টে কয়েক পা গিয়ে সে ভারসাম্য হারিয়ে অসহায়ের মতো বাতাস খামচে শেষ পর্যন্ত ধপাস করে ঝাঁপিয়ে পড়ত মেঝেয়। ভল্টিং হর্স’ও সে ডিঙিয়ে যেতে পারত না, আটকে যেত তার কালো চামড়ায় বাঁধানো পিঠে। কিছুক্ষণ সেখানেই সে বসে থাকত জিনে বসা সওয়ারের মতো। হেসে উঠত ছেলেরা আর আনাড়ীর মতো পেটে ভর দিয়ে নেমে গিয়ে ও দাঁড়াত তাদের লাইনে।
একেবারে কিছুই তার উৎরাত না। ইশকুলের অনুষ্ঠানে সে আবৃত্তি করে ‘নীপারকে বললে মানুষ’ কবিতাটা, তাতেও গোলমাল ঘটে যায়। গোটা সপ্তাহ ধরে সে কবিতাটা রপ্ত করে। বিশেষ করে শেষ ছত্তগুলো ওর বেশ হত। বুক ভরে দম নিয়ে সে আবেগ ফুটিয়ে বলত:
সরণিতে গৃহকোণে যেন
সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে আলো!
মঞ্চে এসে যখন সে দাঁড়াল, উবে গেল তার সমস্ত ‘আবেগ’। তাড়াতাড়ি করে শেষ ছত্রে পৌঁছবার চেষ্টা করলে সে। কিন্তু ঠিক শেষটাতেই সর্বনাশ হল। হঠাৎ নার্ভাস হয়ে কাঁধ নাচিয়ে সে বলে উঠল:
সরণিতে গৃহকোণে যেন
সন্ধ্যায় নিভে যায় আলো।
হেসে উঠল দর্শকেরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বপ্ করে নেমে এল মন্ড থেকে। ব্যর্থ’কামের ভাগ্যে সে অভ্যন্ত। ব্যর্থ’রা সাধারণত রাগ করে অন্যের ওপর, ওর রাগ হত নিজের ওপরেই। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল স্বভাব বদলাবে, নতুনভাবে চলবে। চেষ্টা করেছিল চটপট হাঁটবে, কথা কইবে প্রায় চে’চিয়ে চোচিয়ে, পেছিয়ে থাকবে না কারো কাছ থেকে। কিন্তু তাতে সুফল কিছু হল না। বাড়িতে পেয়ালা ভাঙতে লাগল, ক্লাসে উলটে পড়তে লাগল কালির দোয়াত, আর চটপটে হতে গিয়ে কোর্তাটা ফেটে গেল বগলের তলায়।
…হেমন্ত আর শীতের মধ্যে সীমারেখা টানা মুশকিল। মাঝে মাঝে এমন হয় যে গাছের পাতা তখনো সব ঝরে যায় নি, অথচ মাটিতে পড়ে আছে প্রথম শীতের মুদে, তুষারকণা। মাঝে মাঝে রাতে খুব ঠান্ডা পড়ে যায়, সকালে দেখা যায় নদী ঢেকে গেছে বরফে। পাতলা আয়নার মতো সে বরফ ছেলেদের হাতছানি দিয়ে ডাকে, মাইকে তখন হাশিয়ার করে দেওয়া হয় যে বরফের ওপর হাঁটা বিপজ্জনক।
কিন্তু সে হুঁশিয়ারি তো আর সব ছেলের কানে যায় না। তাই বরফের ওপর দেখা দেয় প্রথম একদল দুঃসাহসী। দেবে যায় বরফ, ভয়ঙ্কর সব ফাটল দেখা দেয়, আর ওরা ভাবে তাদের সবারই জন্ম খুব শুভলগ্নে। কিন্তু শুভলগ্নও তো মাঝে মাঝে ডোবায়।
নদী থেকে আসা একটা চিৎকার কানে এল জরদ্গবের। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁস-ফাঁস করে সে পৌঁছল তীরে।
সেখানে সে দেখতে পেলে দিমকা কভালেভ হাত নেড়ে চে’চাচ্ছে:
‘ডুবছে! ডুবে যাচ্ছে!’
‘কে ডুবছে?’ এতটুকু তাড়া না দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলে জরদ্গব।
‘দেখতে পাচ্ছিস না?’ খোঁকিয়ে উঠল দিমকা, ‘বাচ্চাটা ডুবে যাচ্ছে। বরফ ভেঙে জলে পড়ে গেছে। দাঁড়িয়ে রইলি যে?!
অন্য কেউ হলে দিমকা কভালেভকেই বলত, ‘আর তুই নিজে যেতে পারছিস না?’ কিন্তু ও যে জরদূগব, তাই এ কথাটা তার খেয়ালই হল না। জমে যাওয়া নদীটার দিকে চাইলে সে, চোখে পড়ল প্রথম শ্রেণীর একটা বাচ্চা কোমর পর্যন্ত জলে ডোবা, কোনো রকমে বরফের কানাটা আঁকড়ে আছে হাত দিয়ে।
দিমকার চেয়ে জরদ্গব মোটা এবং ভারি, তাহলেও সে এগিয়ে গেল বরফের ওপর দিয়ে। বরফের শুরটা সামান্য দেবে গেল, কিন্তু ভাঙল না। তাঁরের কাছাকাছি ন্তরটা নিশ্চয় অনেক শক্ত।
উত্তেজিত হয়ে উঠল দিমকা কভালেভ। হাত নেড়ে সে ফের চেচাতে লাগল:
‘ডাইনে যা!.. সাবধান!.. অমন জোরে জোরে পা ফেলিস না, নইলে নিজেই…’ চে’চাচ্ছিল সে তার নিজের ভয়টাই চাপা দেবার জন্যে।
আর জরদৃদ্গব এগিয়ে গেল বরফের ওপর দিয়ে। চে’চানি তার কানে যাচ্ছিল না। দেখছিল সে কেবল মরণাধিক আতঙ্কিত বাচ্চাটাকে, মুখ দিয়ে যায় একটা কথাও সরছিল না।
কিনারের কাছাকাছি বরফ চাঙের ওপর জল জমেছে। সেখান পর্যন্ত গিয়ে সে এতটুকু দ্বিধা না করে পা বাড়িয়ে দিলে। সঙ্গে সঙ্গেই জুতো ভরে উঠল জলে। মনের কোন গভীরে সে টের পাচ্ছিল, এক্ষুনি বরফটা ভেঙে যেতে পারে, নীল হয়ে যাওয়া বাচ্চাটার সঙ্গে সেও গিয়ে পড়বে জলে। কিন্তু তাতে সে থামলে না। দ্বিতীয় পা-টাও সে এগিয়ে আনলে, জল উঠল গোড়ালি ছাপিয়ে।
এখন আর চে’চাচ্ছিল না কভালেভ, হাত নাড়ছিল না, টান-টান হয়ে অপেক্ষা করছিল কী হয়। দেখতে পাচ্ছিল বাচ্চাটার হাত ধরছে জরদূর্গব, বরফ ভাঙতে
শুরু করেছে।
শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা উঠে এল বরফের ওপর। অবশ হাতে তার পরিত্রাতাকে আঁকড়ে ধরে আসছিল সে। দাঁত ঠক-ঠক করছিল। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল মুখ বেয়ে।
ওরা তাঁরে পৌঁছতে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল কভালেভ।
‘বরফ জলে তোর পা একদম ভিজে গেছে,’ বললে সে বন্ধুকে, ‘শিগগির ছুটে বাড়ি যা। বাচ্চাটাকে আমি পৌঁছে দেব।’
উদ্ধার করা ছেলেটার দিকে চাইলে জরদ্গব, নিজের ভেজা জুতোর দিকে চেয়ে বললে:
‘বেশ, পৌঁছে দে।
আতঙ্কিত ভেজা বাচ্চাটিকে ধরে কভালেভ কোথায় তাকে নিয়ে গেল। বাড়িমুখো ফিরল জরদর্গব। উত্তেজনা ওর দ্রুত চাপা পড়ে গেছে ক্লান্তিতে। এখন আছে শুধু তার ভেজা পা আর হি-হি করা সামান্য কাঁপুনি। বাড়ি ফিরে বহু কষ্টে জুতো খুলল সে। গলগলিয়ে জল বেরল জুতো থেকে।
‘এ আবার কী কান্ড?’ ভেজা মেঝে দেখে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল মা।
‘পা ভিজে গিয়েছিল,’ টেনে টেনে সে জবাব দিলে।
‘কোথায় এসব বাধাস বল তো?’ বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ন্যাতা আনতে গেল মা।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল ঘটনাটা মাকে বলে, কিন্তু ঘুম পাচ্ছিল তার, কেবলি হাই * উঠছিল, গরম ঘরের মধ্যেও গায়ের কাঁপুনি যাচ্ছিল না। কিছুই বললে না সে, সোফায় শুয়ে চোখ বুজলে।
হঠাৎ তার মনে হল, গায়ে তার নাইটের ভারি বর্ম পরা থাকলে তো বরফটা তানি ভেঙে যেত, বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেত না।
চট করেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরের দিন দ্বিতীয় ঘণ্টির পর সে ক্লাসে এসে কাউকেই সেখানে দেখতে পেল না। জানা গেল সবাই ওপরের বড়ো হলে গেছে পাইওনিয়র জমায়েতে। ডেস্কে বইয়ের ব্যাগ ফেলে সে উঠল চারতলায়।
হলে ঢুকে সে দেখল সবাই দাঁড়িয়ে আছে লাইনবন্দী। ঠেলে-ঠুলে সে পেছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন কথা কইছিলেন ইশকুলের হেডমাস্টার। তিনি বললেন যে গতকাল প্রথম শ্রেণীর একটি ছেলে নদীতে বরফ ভেঙে জলে পড়ে যায়, ছাত্র দিমকা কভালেভ তাকে বাঁচিয়েছে, ছাত্রের এই নির্ভীকতায় তিনি, হেডমাস্টার উচ্ছ্বসিত বোধ করছেন। তারপর বক্তৃতা দিলেন জ্যেষ্ঠা পাইওনিয়র পরিচালিকা। তিনি পাইওনিয়রের দায়িত্ব, লাল টাইয়ের মর্যাদার কথা বলে জলে-পড়া বাচ্চাটার মায়ের চিঠি পড়ে শোনালেন, তাতে দিমকাকে তার ছেলের উদ্ধারকর্তা বলা হয়েছে।
চারিদিক থেকে ছেলেপিলেদের চাপে জরদগব দেয়াল ঘোঁসে দাঁড়িয়ে শুনে গেল সবাই তারিফ করছে দিশকা কভালেভের। একসময় তার ইচ্ছে হয়েছিল বলে যে দিমকা মিথ্যে কথা বলেছে, কাউকেই সে বাঁচায় নি, শুধু হাত নেড়ে চে’চিয়েছে। কিন্তু তাতে সবার দৃষ্টি তার ওপর পড়বে এই কথা ভাবতেই তার লজ্জা লাগল, লাল হয়ে উঠল তার তিন-তিনটে থাক।
শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই বিশ্বাস হতে লাগল যে দিমকাই গতকালকার ঘটনার নায়ক: ডুবন্ত ছেলেটাকে ওই তো দেখেছিল প্রথম। আর সবাই যখন হাততালি দিলে দিমকাকে, জরদূর্গবও তাতে যোগ দিলে।
জমায়েত শেষ হল। হুকুম হল যে-যার ক্লাসে যাবার। জরদূগবও বন্ধুদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে ফিরে এল দোতলায়।
কষ্ট করে তার সাঁটে সে’ধল সে, সরে গেল ডেস্কটা, আর পড়া শুরু হতে সে তার মোটা মোটা খাটো আঙুলে সরু, কলম ধরে নাইটের ছবি আঁকতে লাগল অঙ্কের খাতায়। এ নাইটটা হল বেগুনী রঙের, ইশকুলের কালি ওই রঙেরই।
Leave a Reply