শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-৫)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

তুষ্টি পরীক্ষা দিতে বসেছে।

জেএসই পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই। তাই এখন কোচিং-সেন্টারগুলো মডেল-টেস্ট নিচ্ছে অর্থাৎ পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন দিয়ে ওদের প্রস্তুত করতে চাইছে তারা।

তুষ্টির এসব আর ভালো লাগে না। বিজ্ঞান পরীক্ষার মাঝে সে হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়ে। স্কুলের সেই কাঠবিড়ালিটার কথা মনে পড়ে যায়। ল্যাজটা কেন এত বড় তা নিয়ে ওর বিস্ময়ের সীমা নেই। ওটাকে যদি আবার দেখা যেত।  ভয়ও লাগে একটু। নারকেলগাছটা থেকে লাফ দিয়ে যদি ওর ঘাড়ে এসে পড়ে !

রফিক স্যারের সহকারী কানের কাছে এসে বলে ওঠে,‘এ্যাই মেয়ে, কী ভাবছ? পরীক্ষা কিন্তু প্রায় শেষ। তাড়াতাড়ি কর ?’

সম্বিৎ ফিরে পায় তুষ্টি। এবার সে দ্রুত কলম চালাতে শুরু করে। গজগজ করে  কি লিখে চলেছে তা সে  নিজেও বলতে পারবে না। একসময় ওর হাত থেকে সহকারী এসে খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তখন মনে পড়ে, আরে, দুটো প্রশ্নের তো উত্তর বাকি রয়ে গেল !

কিন্তু একথাটা মাকে বলা যাবে না। মা জিজ্ঞাসা করলেই সে হেসে উত্তর দেবে ,‘পরীক্ষা ভাল হয়েছে।’

‘গোল্ডেন এ প্লাস পাবি ?’

এরকম প্রশ্ন তপতী প্রায়ই ওকে করে। উসকে দিতে চায় ওর ভেতরকার উচ্চাশা। কিন্তু  তুষ্টির মন পড়ে থাকে অন্য জায়গায় ।  সেই চঞ্চল কাঠবিড়ালিটা  চোখের সামনে ভাসে।  আগামিকাল স্কুলে গিয়ে সবার আগে সেটি সে খুঁজে বেড়াবে। আচ্ছা, ওটা কি ওর সঙ্গে বন্ধুতা পাতাবে ?

ওর মা ফের বলে,‘কি বলছি শুনছিস তো? গোল্ডেন এ-প্লাস থাকবে তো ?’

‘থাকবে, থাকবে।’ তুষ্টির কণ্ঠে বিরক্তি। ওর মগ্নতা অন্য জায়গায়। ওর বয়সী একটি মেয়ের উপর চোখ। কালিঝুলি মাখা চেহারা। মাথাভরতি জটবাঁধা চুলের গোছ। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে খিলখিল করে হাসছে  মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে। ওর হাতের কাছে  একটা বেড়ালছানা। সে ছানাটিকে খামচে দিচ্ছে আর সেটি ঘাড় ঘুরিয়ে নাকমুখ খিঁচিয়ে রাগী মুখে বাঘের মতো গর্জন করে উঠছে।

বেড়ালটি ওর উপর বিরক্ত হয়ে ভাগতে চাইছে। কিন্তু মেয়েটি নাছোড় ; কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই সে সেটির ল্যাজ ধরে টান দিচ্ছে। ওমনি সে শুঁড় তুলে ভেংেচে দিচ্ছে ওকে।

এরকম একটা বেড়ালছানা তুষ্টির খুব পছন্দ। একবার জোগাড়ও করেছিল ; দেয়াল বেয়ে ওদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় কিভাবে যেন চলে আসে। সে সেটিকে কদিন গরম দুধ খেতে দেয়। ওদের ফেলে দেয়া কাঁটা মেশানো ভাত খেতে দেয়। কিন্তু বেড়ালছানাটি কি এক অজ্ঞাত কারণে অসুস্থ পড়ে একদিন।

তিন-চারদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেড়ালটি। খুব কষ্ট পেয়েছিল তুষ্টি সেদিন। বাড়ির কেয়ার-টেকার যখন একটি ছালার ব্যাগে ঢুকিয়ে  কংকালসার মৃত ছানটিকে ওদের ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিয়ে যায় তখন সে হু-হু করে খুব কেঁদেছিল সেদিন।

সেই স্মৃতিটা মনে পড়ে গেল ওর। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। একটা দুঃখবোধ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

ওরা কখন যে সিদ্ধেশ^রীর গলি থেকে  হেঁটে মালিবাগে ফিরে আসে Ñ বুঝতেই পারেনি।

বাসার কাছে এসে সৃষ্টি ওকে জিজ্ঞাসা করে ফিসফিস করে,‘ তুই কি ভাবছিলি, আমি তা জানি । ’

‘কি ?’

‘ওই মেয়েটাকে দেখে তুই তোর মরা বেড়ালটার কথা ভাবছিলি। জানিস, সেদিন আমারও খুব কষ্ট হয়েছিল। বুঝতে দিই নি কাউরে।’ সৃষ্টির চোখেমুখে বিষণœতার ছায়া ; একটা মড়া বেড়লছানার ছায়া ওদের মুহ্যমান করে তোলে। সারারাত  অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে সকালের দিকে ঘাড় ফেলে দেয় ছানাটা। মা বলল,‘ ওটা মরে গেছে।’

ওদের দু-বোনের কারও বিশ্বাস হয়নি সেকথা। বারবার মাকে ওরা ‘ওই তো কানটা নড়ছে, ওইতো ঠ্যাংটা কাঁপছে ’ বলে আশায় বুক বেঁধে রাখে। কিন্তু একসময় ওরা নিজেরাই টের পায়, এসব ওদের মনের ভুল। বেড়ালশিশুটি সত্যি আর নেই। মরে গেছে।

বেড়ালটার কথা ভাবতে ভাবতে ওরা ওদের মাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে। কখন যে মালিবাগের বাসায় ফিরে আসে, টেরই পায়নি।

চোখের সামনে দেখা জীবনের প্রথম ও একমাত্র মৃত্যুদৃশ্যটি ওদের এখনও আনমনা করে দেয়।

খুব কষ্ট পায় মনে মনে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024