শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৪ অপরাহ্ন

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-৩)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪, ৪.০০ পিএম

ইউ. ইয়াকভলেভ

পাশা সেদভের উত্তরাধিকার

পাইওনিয়র শিবিরের ব‍্যাস ব্যান্ড বাজিয়েদের মধ্যে পাশা সেদভ ছিল সবার ছোটো। কিন্তু তার ড্রামটি ছিল প্রকান্ড। এমনকি যে রামশিঙাটা তার পেতলের অজগর পাকে ঢ্যাঙা কারাভায়েভ’কে জড়াত, সেটাও হার মানত ড্রামের কাছে। কাঁধে তারপলিনের স্ট্যাপ গলিয়ে পাশা ঝুলিয়ে নিত ভারি ড্রামটা, ভারসাম্য রাখার জন্যে সামান্য পেছনে হেলতে হত তাকে। হাতে তার থাকত বিস্ময়চিহ্নের মতো হালকা সরু কাঠি নয়, ফেল্ট মোড়া বাঁটুল লাগানো রীতিমতো বাজন-ডাণ্ডা। তা দিয়ে পাশা নিপুণ বোল তুলত, প্রকাণ্ড যন্ত্রটা দিয়ে তান ধরত ট্রাম্পেটের সঙ্গে। যে জানে না, তার কাছে মনে হবে ড্রাম বাজাতে সবাই পারে। একেবারে ভুল কথা! যে-সুরলিপি দেখে পাশা বাজাত তাতে লেখা ছিল: ‘ড্রামের পালা’। গোটা ব্যান্ডই চলত তার তালে তালে।

ড্রামটা পুরনো, রঙচটা, তোবড়ানো, মন্ত্রো একটা কালচে তালিমারা। তার ধাতব পাতে সাবেকী ধাঁচের, আধো-মুছে যাওয়া হরফে লেখা ছিল ‘বজ্র ঝাঁপে, দুনিয়া কাঁপে!’ নিশ্চয় অদ্ভুত এই নীতিবাণীটায় বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে ড্রামের প্রাণটা বজ্রের।

হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল পাশার ড্রাম।

সাধারণত তা টাঙানো থাকত পাশার খাটের শিয়রে। দেয়ালে পোঁতা একটা মজবুত পেরেক থেকে। সবাই ঠাট্টা করত পাশাকে:

‘দেখিস, খসে মাথায় না পড়ে!’

পাশা জানত যে পড়বে না। যখন বৃষ্টি নামত, বাজ ডেকে উঠত জানলার ওপাশে, ড্রাম তখন তাতে সাড়া দিত চাপা গুঞ্জন তুলে। রাত্রে ওটাকে দেখাত যেন ঝিকিমিকি চাঁদ, কেমন করে যেন তা নেমে এসেছে চতুর্থ দলের শোবার ঘরে, আটকে গেছে পাশা সেদভের শিয়রে।

রিহার্সালে যাবার সময় পাশা টুলে চেপে কাথে কাঁথে ড্রামটা নামাত দেয়াল থেকে। সাবধানে এগুত যাতে খাটের বাজুর সঙ্গে ওটার ধাক্কা না লাগে। কোনো দিন দেরি হয়ে গেলে যখন ছুটতে হত, তখন ড্রামের ভার পাশাকে ঠেলে সরিয়ে দিত এক-এক দিকে। ব্যান্ডে পাশা গিয়ে দাঁড়াত সবার শেষে। সেটা মাথায় সে সবার চেয়ে খাটো বলে নয় স্রেফ এই জন্যে যে ড্রামের জায়গাটা সবার পেছনে, আর ট্রাম্পেটগুলো থাকার কথা সামনে, যদিও কোনো একটা ট্রাম্পেট, এমনকি সবকটা ট্রাম্পেট একসঙ্গে মিলেও চাপা দিতে পারত না ড্রামের ঢিপ স্পন্দন, তার জোরালো দরাজ বজ্রনাদ। বজ্র ঝাঁপে, দুনিয়া কাঁপে! ড্যাং! ড্যাং! ড্যাং। কদমে কদমে তাল দিত ড্রাম, ড্রাম-বাজিয়েকে কিন্তু দেখা যেত না। দূর থেকে মনে হত, প্রকাণ্ড ড্রামটা যেন জীর্ণ জুতো পরা ছাল-ছড়ে-যাওয়া হাঁটু সমেত দুই পায়ে নিজেই হে’টে যাচ্ছে…

কোথায় গেল ড্রামটা? দুপুরের খাওয়ার আগে পর্যন্ত ড্রামটা দিব্যি ঝুলে ছিল দেয়ালে, কিন্তু চতুর্থ দল যখন খাওয়া সেরে ফিরল, তখন আর ওটাকে দেখা গেল না। উ’চিয়ে ছিল শুধু পেরেকটা। সঙ্গে সঙ্গেই সেটা নজরে পড়ে পাশার। তৎক্ষণাৎ সে খুঁজে দেখলে গোটা ঘরটা, উ’কি দিলে প্রতিটি খাটের নিচে, বার কয়েক গোটা বাড়িটাও ঘুরে এল। এ তো আর খড়ের গাদায় সাই হারানো নয় একটা জিনিস। ড্রামের মতো পাশা ওটা সঙ্গে করে এনেছিল অনেক দূর থেকে। পাইওনিয়র শিবিরে এসে পৌঁছতে তার লেগেছিল পুরো তিনটে দিন। রেলের কামরায় ওটা রাখার মতো জায়গা মেলে নি। ফলে নিজের বাঙ্কের ওপরেই রেখে তাকে শুতে হয়েছিল বাকি জায়গাটুকুতে। ঘুমিয়েছেও সে ওইভাবে গুটিসুটি মেরে। গোটা পথটা সে বাক ভাগাভাগি করে গেছে তার ড্রামটার সঙ্গে।

‘লাগেজ ওয়াগনে দিলেই পারতিস,’ বলেছিল প্যাসেঞ্জাররা।

লাগেজ-ওয়াগন। বলে দেওয়া তো খুবই সোজা। আর যদি তা হাত থেকে পড়ে যায়, কিংবা মালপত্তর চাপিয়ে দেয় তার ওপর, থেবড়ে যায়? না বাপু, খুব হয়েছে! এ তো আর লটবহর ভরা ট্রাঙ্ক নয়, ব্যান্ডের যন্ত্র।

আর দেখুন, খোয়া গেল যন্ত্রটা।

সারা দিন পাশা খুঁজে বেড়ালে। গোটা শিবিরটাই সে ঘুরলে। উ’কি দিলে সবকটি আড়ালে-আবডালে। জিজ্ঞেস করলে সবাইকে:

‘আচ্ছা, ড্রামটা দেখেছেন কোথাও?’

সবাই কাঁধ ঝাঁকালে। কেউ দেখে নি।

তাদের দলটা রাতের খাবার খেতে গেল, পাশা গেল না। বললে:

‘ড্রামটা না পাওয়া পর্যন্ত খাব না।’

‘সে কী, অনশন ধর্মঘট করবি নাকি?’

‘না, অনশন ধর্মঘট নয়। তবে ড্রাম না পাওয়া পর্যন্ত খাব না।’

ড্রাম ছাড়া সেদিনকার ব‍্যাস ব্যান্ডে মার্চের অভ্যন্ত বাজনাটা কেমন এলিয়ে গেল। তাল কেটে কেটে বাজল ট্রাম্পেটগুলো, ঠিক প্রধান যন্ত্রটারই ফাঁক কিছুতে

ভরল না।

‘মন খারাপ করিস নে,’ পাশাকে বললে পাইওনিয়র দলপতি কিম, ‘নতুন ড্রাম তোকে আমরা কিনে দেব।’

‘নতুন ড্রাম নিয়ে আমার কী হবে?’ জবাব দিলে পাশা সেদভ, ‘নতুন আমার দরকার নেই। এটা যে আমার উত্তরাধিকার।’

উত্তরাধিকার… সে কী, জমিদার হয়ে উঠলি কবে?’

চুপ করে রইল পাশা। ভেতরে ঢুকে না খেয়েই শুয়ে পড়ল ঘুমতে।

আর সকালে ছেলেদের চোখে পড়ল এবার হারিয়ে গেছে পাশা সেদভ নিজেই। বিছানাটি ওর পরিপাটী করা গোছানো, শয়ে, পাশাই নেই। সকালের কুচকাওয়াজের সময় ঘোষণা করে হল যে প্রাতরাশের পর গোটা শিবিরই খুঁজতে বেরবে হারিয়ে- যাওয়া ড্রাম-বাজিয়েকে।

ফাঁকা হয়ে গেল শিবির। বেরল সবকটা দলই। সবাই পরিণত হল এক একটি গোয়েন্দায়। সবাই গালাগালি দিলে পাশাকে। গেল কোথায়? কোথায় খাজে বেড়াচ্ছে তার অদ্ভুত উত্তরাধিকারটা?

শিবিরে পাশা সেদভ যখন ফিরল তখন বহুক্ষণের নিষ্ফল তল্লাসিতে হয়রান হয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফটক দিয়ে সে ঢুকল খোঁড়াতে খোঁড়াতে, চোখ বসে গেছে। চেহারাখানা যুদ্ধজয়ীর মতো, যেন ছাউনিতে ফিরছে লড়াই শেষে। কাঁধ থেকে ড্রামটা ঝুলছে এক মন্তো ঢালের মতো, বাজাবার ডাণ্ডাটা চেপে ধরেছে মুষলাস্তের মতো। লম্বা পথ হেটে আসায় ড্রামের ভারে সে সামান্য দুলছে এপাশে- ওপাশে।

পাশাকে দেখে উল্লসিত হয়ে উঠল দলপতি কিম:

‘পাওয়া গেল তাহলে!’

‘পেয়েছি…’ আস্তে জবাব দিলে পাশা।

‘কোথায় ছিলি তুই?’পাশাকে নজর করে দেখে বললে কিম, ‘গোটা শিবির এদিকে নেমে পড়েছিল, সর্বত্র খাঁজে বেড়ালে তোকে।’

‘একটু খেতে পেলে হত,’ বললে পাশা।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়। চল, ক্যান্টিনে যাই। দে. আমি বইছি… ড্রামটা।’

‘আমি নিজেই বইব,’ দলপতির পেছ ধরতে ধরতে বললে পাশা, ‘নিয়ে গিয়েছিল ওই… ক্লাবের ছেলেরা। তবে খুজে বার করলাম…’

ফাঁকা ক্যান্টিনে ও ক্লান্তিতে চেয়ারে বসল, মেঝেতে ড্রামটা রাখল নিজের পাশেই, আর খাওয়ার গোটা সময়টা ধরে চেয়ে চেয়ে দেখল ওটাকে, যেন ভয় পাচ্ছিল জামটা বুঝি গড়িয়ে গিয়ে ফের হারিয়ে যাবে। জাউটা ছিল ঠান্ডা, কিন্তু ক্ষুধার্ত পাশা তা খেলে অবর্ণনীয় তৃপ্তির সঙ্গে।

দলপতি কিম ছিল তার সামনে বসে, কিছুই সে জিজ্ঞেস করলে না, বকলে না। তারপর পাশা যখন তার কম্পোট খাওয়া শেষ করে মুখ মুছলে হাত দিয়ে, দলপতি জিজ্ঞেস করলে:

‘ড্রামটার ওপর তোর এত টান কেন বল তো?’

দলপতির দিকে পাশা সেদভ এমনভাবে তাকালে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে।

বললে:

‘এটা দুর্নিতি ফিয়োদরোভিচের ড্রাম। আমার পাশের ফ্ল্যাটের লোক এটা আমায় দিয়ে গেছেন। উত্তরাধিকার।’

দলপতি কিম কিছুই বুঝতে পারল না। পাশা সেদভ তাকে বুঝিয়ে বললে। ‘দুমিত্রি ফিয়োদরোভিচ বাজনা বাজাতেন। সে সময় শহর দখল করে শাদারা। ব্যান্ড-দলকে অফিসার ‘জারকে বাঁচিও ভগবান’ বাজাবার হকুম দেয়। কিন্তু দুমিত্রি ফিয়োদরোভিচ ছিলেন লালেদের পক্ষে। বাকি বাজিয়েরাও। তাদের ইচ্ছে ছিল না ভগবান জারকে বাঁচিয়ে রাখুক। তারা বাজালে: গড়ে যাব নিজেদের এক নয়া বিশ্ব, তারা হবে সবকিছ, যারা ছিল নিঃস্ব।’ গালাগালি দিলে অফিসারটা, হম্বিতম্বি করলে। শেষে হাঁকলে: মেসিনগান।’ টেনে আনা হল মেসিনগান। ওরা কিছু বাজিয়েই চলল: ‘আমাদের এই শেষ চূড়ান্ত যুদ্ধ।’ র‍্যাস ব্যান্ডের ড্রাম-বাজিয়ে দুমিত্রি ফিয়োদরোভিচও বাজালেন: ‘আমাদের এই শেষ চূড়ান্ত যুদ্ধ!’ অফিসার হুকুম দিলে: ‘ফায়ার!’ গুলি চালালে লাল বাজিয়েদের ওপর।’

ড্রামটার দিকে চাইলে পাশা সেদভ, মন্তো কালচে তালিটার ওপর সে হাত বুলাল। বললে:

‘এইখানটায় গুলি লেগেছিল।’

ক্যান্টিনটা একেবারে চুপচাপ। দলপতি কিম নিচু হয়ে হাত দিয়ে ছায়ে দেখল ড্রামটা, দুমিত্রি ফিয়োদরোভিচ যা লিখে গিয়েছিল সেটা পড়লে: ‘বজ্র ঝাঁপে, দুনিয়া কাঁপে!’ বাবুর্চি’ও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল পাশা সেদভের উত্তরাধিকারের দিকে।

‘আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের লোকটি তখন ছিলেন ছোটো,’ বললে পাশা, ‘দুমিত্রি ফিয়োদরোভিচকে তিনি চিনতেন। ড্রামটা তিনি কুড়িয়ে আনেন…’

‘এটা মিউজিয়মে দেওয়া দরকার,’ বললে দলপতি কিম।

‘উ’হঃ,’ আপত্তি করলে পাশা, ‘মিউজিয়মে ওটা চুপ করে থাকবে। আর এটার দরকার বাজা… বজ্র ডাকানো…’

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল পাশা সেদভ। একটা খালি ডিশের পাশেই ছিল তার বাজন-ডাণ্ডা, তা দিয়ে সে হালকা ঘা দিলে ড্রামে। একটা গাঢ় চাপা আওয়াজ ভেসে গেল ক্যান্টিনে। আবার ঘা দিলে পাশা। আওয়াজ উঠল জোরে। হঠাৎ ছেলেটা ড্রাম ঝোলালে কাঁধে, সামান্য পেছনে হেলে বাজন-ভাণ্ডা হাঁকাল। আর র‍্যাস ব্যান্ডের বাজিয়ের। তখন অঘোরে ঘুমলেও, ট্রাম্পেট তাদের নীরব থাকলেও দলপতি কিম আর বাবুর্চি’ বেশ চিনতে পারলে পাশার বাজনাটা। বিশাল হৃদয় আর ছোটো ছোটো হাতে ধ্বনিত পরিচিত রণসঙ্গীতটা উঠতে লাগল ড্রামের গভীর থেকে। সংহত হয়ে উঠল সুরটা, ক্যান্টিনঘরটা পূর্ণে’ করে বাইরে ভেসে গেল এক প্রভাতী সঙ্কেতের মতো। এটা সেই সঙ্গীত যা মেসিনগানের অগ্নিবর্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে বাজিয়ে গিয়েছিলেন লাল বাজনদাররা, চান নি ভগবান জারকে বাঁচিয়ে রাখুক, নিজেদের নয়া বিশ্ব গড়ার জন্যে জীবন দিয়ে গেছেন শেষ যুদ্ধে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024