শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের ভয়ংকর বিষধর সাপগুলো কেমন ও কোথায় থাকে

  • Update Time : শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪, ৭.৩৪ পিএম

ফয়সাল আহমেদ 

বাংলাদেশে মোট ৭৮টি প্রজাতির সাপ রয়েছে; এর মধ্যে ২৬টি বিষধর। তবে এই ২৬টি প্রজাতির বিষধর সাপ সবই মানুষের জীবনের জন্য আশঙ্কাজনক নয়। অবশ্য এসবের মধ্যে মাত্র চারটি প্রজাতি মানুষের জন্য সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। যেমন: গোখরো, কালকেউটে, সানকিনী ও চন্দ্রবোড়া সাপ। বাংলাদেশের বিষধর সাপের তালিকা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এখানকার আনুমানিক ১২টি প্রজাতি সমুদ্রে ও সমুদ্রসৈকতের সীমারেখার মধ্যে বসবাস করে। এগুলো ডাঙায় আসতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। মানুষ বা অন্য কোনো স্থলচর প্রাণীকে এরা কখনো ঘায়েল করেছে বা এদের আঘাত করেছে, এমন কথা শোনা যায় না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘন বনাঞ্চল, সুন্দরবন, চা-বাগান ও পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাঁতসেঁতে বনভূমি বা ঝরনাধারার ধারেকাছে প্রায় পাঁচটি প্রজাতির বিষধর সবুজবোড়া সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লোকালয়ের সঙ্গে এ অঞ্চলগুলোর খুব একটা সম্পর্ক না থাকায় এগুলোর কামড়ে লোক মরে না। দু-তিনটি প্রজাতির প্রবাল সাপ বা প্যান্থার সাপের বেলায় সম্ভবত একই কথা প্রযোজ্য।

এ দেশে ইলাপিডি পরিবারের উপপরিবার ইলাপিনি-জাতীয় সাপগুলোর মধ্যে গোখরো, শঙ্খচূড়, নানা ধরনের কেউটে, শাকিনী ও প্রবাল সাপ অন্যতম।

 

গোখরো:

এ জাতের সাপের জীববিজ্ঞানভিত্তিক পরিচিতি হচ্ছে ‘নাজা নাজা’। গো-খুরা থেকে এর সাধারণ নামকরণ ‘গোখরা’ করা হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস অনুসরণ করলে এ রকমেরই সাক্ষ্য মেলে। ভারতীয় গোখরো বা ‘কোবরা’ নামের এই সাপ সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় । এগুলো আমাদের দেশের বিষধর সর্পগোষ্ঠীর মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় বলে সাধারণ মানুষ এর নামে ভীতসন্ত্রস্ত। কোনো কোনো এলাকায় এদের জাতি সাপ বা পানস সাপও বলা হয়। এ ছাড়া এ জাতের সাপের এলাকাভিত্তিক নানা ধরনের অপ্রচলিত নামও রয়েছে।

গোখরো সাপ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত ফুট লম্বা হয়ে থাকে। আমাদের পরিচিত সাপ প্রজাতিগুলোর মধ্যে গোখরোর ফণা সবচেয়ে বড় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গোখরোর ক্ষিপ্র ফণা দেখার অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের অনেকেরই আছে। এবং সেটা বাস্তব পরিবেশে না হলেও সাপুড়ে-বেদের সাপের খেলার আসরের সুবাদে তো বটেই। গোখরোর ফণার ওপরে সাধারণত দুটি চশমা আকৃতির কালো বলয় থাকে এবং এই যুগল বলয় থেকে দুটি রেখা নিচের দিকে নেমে গিয়ে একত্রে যুক্ত হয়ে ইংরেজি ‘ইউ’ (U) অক্ষরের আকার ধারণ করেছেন অন্য জাতের গোখরোর বেলায় দুটি বলয়ের জায়গায় একটি বলয় থাকতে পারে। বলয়ের মাঝখানের অংশটি সাধারণত কালো হয়ে থাকে। ফণার এই দুই এবং এককের ওপর ভিনকেকরণ পদ্ধতির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চিহ্ন। এই চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে ‘নাজা নাজা’ প্রজাতির দুটি উপপ্রজাতি শনাক্ত করা গেছে। ‘নাজা’ উপপ্রজাতির সদস্যভুক্ত সাপেদের ‘চশমা পরা’ ও ‘খড়ম পাইয়া’র মতো আঞ্চলিক নামেও ডাকা হয়। কেননা, গরুর পায়ের খুরাকৃতি বা বৈলওয়ালা খড়মের সামনের নিচের দিকে যে উল্টো ইউ’ আকৃতির গঠন দেখা যায়, তা গোখরো সাপের ফণার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলয় রেখাচিত্রের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায় । হিন্দুধর্ম আখ্যানমতে, মহাদেব তাঁর বৈলওয়ালা খড়ম পায়ে গোখরোর মাথায় পা রেখেছিলেন বলে এসব সাপের মাথা চ্যাপটা ও তাতে খড়মের চিহ্ন আঁকা।

ঢাকা জেলার মির্জাপুর, টাঙ্গাইল বা তৎসংলগ্ন কিছু কিছু এলাকায় এই চশমা-পরা-জাতীয় গোখরোকে ‘খৈয়া গোখরা’ বলে। এজাতীয় গোখরো লোকালয়ের কাছে-কিনারে, বিশেষ করে কৃষকের ঘরবাড়ি, পাট বা শস্যগুদাম এবং পাটখড়ির স্তূপ ইত্যাদিতে থাকতে দেখা যায়। এদের প্রিয় খাবার ইঁদুর ও ব্যাঙ। এই প্রজাতির অন্য উপপ্রজাতি কিছুটা লোকালয় ছাড়িয়ে কোনো ঢিবি বা উঁচু জায়গায় থাকতে ভালোবাসে। অনেক ক্ষেত্রে এরা এদের বসবাসের জায়গা হিসেবে উইয়ের ঢিবি বা অন্য কোনো প্রাণীর বাসা ও ঢিবি বেছে নেয়। এদের পছন্দের খাবার মাছ, ব্যাঙ ও ইঁদুর। তবে এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, সব ধরনের গোখরো সাপের প্রধান আকর্ষণীয় খাবার ইঁদুর। এদের এই খাদ্যাভ্যাসটি কৃষকের জন্য উপকারী।

গোখরো সাপকেও অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর মতো জোড় বেঁধে বসবাস করতে দেখা যায়। ডিম দেওয়ার মৌসুমে এরা ইঁদুর বা সমপর্যায়ের কোনো প্রাণীর গর্ত বেছে নেয়। সেখানে স্ত্রী সাপ ডিম দেয় এবং স্ত্রী ও পুরুষ সাপ সেগুলোকে পাহারা দেয়।

গোখরো দিনের উজ্জ্বল আলোয় ভালো দেখে না। এদের চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহের কাজ চলে হয় গোধূলিবেলায়, নয়তো কাকডাকা ভোরে। ফলে ওই দুটি সময়েই গ্রামাঞ্চলের লোকজন গোখরো সাপের কবলে পড়ে থাকে। সন্ধ্যার কাজ শেষে বা হাটবাজার ফেরা কৃষক-জেলে এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয় বেশি। কাকডাকা ভোরে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে, ওজু করতে গিয়ে কিংবা খেতখামারে কাজ করতে যাওয়ার সময়ও গোখরোর ছোবলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রচুর। বর্ষা বা বন্যায় সাপের বসবাসের গর্ত বা ফোকর ইত্যাদি পানিতে নিমজ্জিত হলে এরা এদের শিকার ইঁদুর-ব্যাঙের পাশাপাশি গৃহস্থের ঘরবাড়ির চালা ও গাছগাছালিতেও গিয়ে ওঠে। এই সময় গৃহপালিত প্রাণীদের প্রায়শ সাপের কামড়ে প্রাণ হারাতে শোনা যায়। শীতের শুরুতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ধান কুড়াতে যায়। এ সময় এরা ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে ধান আনতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা পড়ে। এ ধরনের ঘটনাও খুব একটা বিরল নয়। ভাঙা দালানকোঠার ইটপাটকেল সরাতে গিয়েও অনেকের সাপের কামড় খেতে শোনা যায়।

এই শব্দবাণে কাজ না হলে সবশেষে আসে ছোবল মারার পালা। মনে রাখা দরকার, গোখরো সাপের দিনের কামড়ের চেয়ে রাতের কামড় বেশি ভয়াবহ। কেননা, সাপগুলো দিনে ভালো করে চোখে দেখে না বলে দিনে কাউকে কামড়াতে গেলে এর নিজেরই আহত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ফলে দিনের বেলা সাধারণত এরা মুখ বন্ধ করে ছোবল মেরে থাকে। অন্যদিকে, রাতের বেলা এরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয় বলে একই সঙ্গে ক্ষতস্থানে সজোরে দুটি বিষদাঁত বসিয়ে দেওয়াও এদের পক্ষে সহজ হয়।

 

রাজগোখরা:

এজাতীয় গোখরোকে শঙ্খচূড় বা ‘কিংকোবরা’ নামে অভিহিত করা হয়। প্রজাতি পরিচয়ে এর নাম ‘নাজা হান্নাহ’। সম্ভবত এগুলো বিষধর সাপের মধ্যে আকারে দীর্ঘতম। রাজগোখরোর দু- একটি আঞ্চলিক নামও রয়েছে। যেমন, টেকনাফে এগুলো ‘কালান্দর’ নামে পরিচিত। আমাদের দেশে এ সাপের স্বাভাবিক দৈর্ঘ্য ১২ থেকে ১৩ ফুট পর্যন্ত হয় বলে জানা গেছে। থাইল্যান্ড ও ভারতবর্ষের কোনো কোনো অঞ্চলে তা যথাক্রমে ২২ ও ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

বিশ্বজনীন পরিচয়ে রাজগোখরোকে ‘অফিওফ্যাগাস’ বলা হয়। এর আভিধানিক অর্থ সাপখেকো। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়। এগুলোর একমাত্র খাবার সাপ-সেটা বিষধর বা অবিষধরই হোক। আপন প্রজাতির ছোট ছোট বাচ্চা সাপকেও এরা বিনা দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে থাকে। সম্ভবত এ কারণেই সাপুড়ে ও বেদেরা রাজগোখরো ধরতে পারলেও নিজেদের ঘরে এদের জিইয়ে রাখতে পারে না। রাজগোখরোর বিষ অন্যান্য গোখরো প্রজাতির বিষের চেয়ে কম কার্যকর। কিন্তু আকারে বড় বলে এদের বিষথলিতে জমিয়ে রাখা বিষের পরিমাণ বেশি।

হিসাব করে দেখা গেছে, রাজগোখরোর বিষথলিতে এককালীন যে পরিমাণ বিষ থাকে, এর পুরোটা কোনো বিশালদেহী (তিন-চার টন) হাতির দেহে ছেড়ে দিলে অল্প সময়ের মধ্যে সেটি ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে।

অন্য দুটি গোখরো উপজাতির মতো শঙ্খচূড় বা রাজগোখরো ফণায় চশমাকৃতি বা গোলাকার দাগ নেই। ফণাটি তুলনামূলকভাবে অপ্রশস্তও। তবে সেখানে ইংরেজি অক্ষর ‘ইউ’ (U)-এর মতো জায়গায় একটি ওল্টানো ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ (V)-এর মতো একটা আকৃতি চোখে পড়ে। এদের দেহ হালকা হলুদ থেকে জলপাই রঙা এবং ক্রমশ সরু হওয়া লেজ কুচকুচে কালো হয়ে থাকে। এদের পৃষ্ঠদেশজুড়ে বহু হলদে বলয় রয়েছে। বলয়গুলো দুই পাশ পর্যন্ত নেমে গেছে। অঙ্কীয় দিকে বা পেটে এ ধরনের কোনো গোলাকার চিহ্ন থাকে না। সেখানকার রং হলদে।

শঙ্খচূড় প্রজাতির স্ত্রী সাপ মরা-পচা লতা-পাতা ও ডালপালা দিয়ে বাসা তৈরি করে। সেই বাসার গভীর প্রকোষ্ঠে এরা ডিম পাড়ে এবং লতা-পাতা দিয়ে ডিমগুলোকে ঢেকে রাখে। পৃথিবীর অন্য কোনো সাপ প্রজাতির বেলায় এ ধরনের বাসা তৈরির প্রবণতা দেখা যায় না। শুধু ডিমগুলো ঢেকে আড়াল করেই এরা নিরস্ত হয় না, বরং এরা নিয়মিত পাহারারও বন্দোবস্ত করে। স্ত্রী সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে সেই পাতার ঢিবিতে শুয়ে থাকে। এই পর্বে সহানুভূতিশীল পুরুষ সাপগুলো স্ত্রী সাপের কাছাকাছি থাকে। এদেরকে তখন খুব একটা দূরে কোথাও যেতে দেখা যায় না। ফলে এদের ডিম মানুষ বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী নষ্ট করতে পারে না। বর্ষার প্রাক্কালে এসব সাপ প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। প্রজননের সময় প্রায় সব প্রাণিকূলের মতো এসব সাপও মেজাজি হয়ে থাকে। এ সময় এদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও থাকে বেশি।

প্রায় সারা দেশে এই জাতের সাপ কমবেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও সুন্দরবনে এদের সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। চিরসবুজ বনে এদের কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়।

গোখরো সাপের বিষ স্নায়ুতন্ত্রের ওপর কাজ করে। এই বিষ প্রধানত স্নায়ুকেন্দ্রগুলোকে অকেজো করে ফেলতে থাকে। ফলে তাৎক্ষণিক শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং পরিণামে হৃৎপিণ্ড এর কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। রোগীর খিঁচুনি দেখা দেয়। পরিশেষে সে মারা যায়।

 

কেউটে:

বাংলাদেশের মানুষের কাছে কেউটে, কালকেউটে; কালসাপ বা কমন ক্রেইট অনেকটা প্রবাদের মতো। এই নাম এমন এক প্রাণীর যে, আমাদের কাছে অজ্ঞাত, আপাতনিরীহ কিন্তু ভয়াবহ শত্রু। এই সাপ অনেকটা মেটে রঙের এবং সচরাচর আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এদের মাথা ঘাড়ের
চেয়ে মোটা এবং তেলতেলে কালো ও মসৃণ হয়। দেহে অস্পষ্ট সাদা জোড়া অর্ধ বলয়াকার দাগ রয়েছে। এমন দাগের সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২৪ জোড়া। কেউটের মাথার ওপর বড় বর্ম বা শিশু থাকে। পিঠের মাঝখানের আঁশের সারি অন্য অংশের চেয়ে আকারে বড়। এদের চোখ খুব ছোট। দৈর্ঘ্যে তিন থেকে ছয় ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আমাদের দেশের প্রায় সর্বত্র এই জাতের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। দেশ- গ্রামে এদের সবচেয়ে পছন্দের বাসস্থান হলো ইটের পাঁজা, টালির গাদা, পুরোনো ভাঙা বাড়ি বা দালানের ফাঁকফোকর। এদের অনেক সময় কাঠ- খড়ির কাঁড়ি, ইঁদুরের গর্ত এবং উইয়ের ঢিবিতে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়।

কেউটে সাধারণত দিনের বেলায় বিশ্রাম নেয় এবং রাতে কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। খাবার জোগাড়ে নেমে পড়ে। দিনের বেলায় ইঁদুর বা অন্য কোনো খোঁড়ক প্রাণীর গর্তে এরা লুকিয়ে থাকে। এদের উঁচু অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। কেউটের খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইঁদুর, ছোট আকারের সাপ। এমনকি এগুলো নিজের প্রজাতিসহ অন্যান্য সাপও ধরে খেয়ে ফেলে। এদের দাঁত তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও শত্রুর দেহে এমনভাবে কামড় বসায় যে রীতিমতো ক্ষত হয়ে যায়। যাকে কামড় দেয়, ভালোমতো দাঁত বসিয়েই কামড়ে দেয়। কেউটে খুব দ্রুত গতিতে ছোবল মারে। রাতে বিষধর সাপে কাটা রোগীর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই এই কেউটে কাটা। এদের গায়ের রং কালো বা মেটে হওয়ায় রাতের অন্ধকারে সচরাচর এদের চোখে না পড়ার কারণ।

কেউটের বিষ গুণগত মানে গোখরোর মতো দেখা গেলেও বিষাক্ততার ঘনত্বে তা গোখরোর চেয়ে দুই থেকে আট গুণ বেশি। এরা কামড়ে দেওয়ার প্রথম চার-পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত রোগীর বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো গোখরোর মতোই। তবে কেউটের ছোবলে গোখরোর ছোবলের মতো ক্ষতস্থান ফুলবে না, কোনো ব্যথাও হবে না। এমনকি, প্রথম কয়েক ঘণ্টা রোগীর দেহে বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ না-ও দেখা দিতে পারে। ছোবলের ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে পাকস্থলী এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জোড়ায় জোড়ায় ভীষণ ব্যথা অনুভূত হতে দেখা যায়। সাপে কাটা রোগীর মধ্যে কেবল কেউটে কাটা রোগীই নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কথায় বলে-আর রক্ষে নেই, কাল কেউটেতে কেটেছে।

 

শাকিনী সাপ:

আমাদের দেশের কেউটে দলের প্রধান প্রজাতি শাকিনী, শঙ্খিনী বা দুমুখো সাপ। অবিষধর দুমুখো সাপ দেখতে প্রায় কেঁচোর মতো হলেও একটু বেশি চঞ্চল। সামগ্রিকভাবে এই দলভুক্ত সাপগুলোকে ঠিক অর্থে কেউ কেউটের মর্যাদা দিতে অভ্যস্ত নয়। শাকিনী সাপ দেখতে বেশ সুন্দর। এদের দেহাবরণে স্পষ্টতর কালো হলুদ বলয় অঙ্কিত। বলয়গুলো বেশ গাঢ় ও মনোরম। এমন বর্ণাঢ্য সাপ আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। এ কারণেই হয়তো এই সাপ সম্প্রদায় আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। এগুলো দৈর্ঘ্যে পাঁচ থেকে সাড়ে সাত ফুট হয়ে থাকে।

শাকিনী বা শঙ্খিনী সাপের লেজ কিছুটা ভোঁতা ও তুলনামূলকভাবে মোটা। অনেকটা কৃত্রিম উপায়ে কেটে ভোঁতা করে দেওয়ার মতো। এই সুযোগে সাপুড়েরা অনেক সময় সেই ভোঁতা লেজে চোখ আঁকে ও সিঁদুরের ফোঁটা দেয়। তখন সেটিকে সহজে দর্শক মহলে বিরল দুমুখো সাপ বলে চমক লাগিয়ে দেয়। স্বভাবে এসব সাপ খুব শান্ত। এগুলোই একমাত্র বিষধর সাপ, যাদের দাঁত না ফেলে সাপুড়ে বা বেদেরা খেলা দেখাতে সাহস পায়।

সাকিনী কেউটের মতোই নিশাচর। জলাশয়ের ধারেকাছে, ইঁদুরের গর্ত, উইয়ের ঢিবি ও ইটের পাঁজা এদের পছন্দের আবাসস্থল। দিনের বেলা এগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়লে এদের গায়ের উজ্জ্বল রঙের জন্য সহজে লোকজনের চোখে পড়ে যায়। তখন এগুলো মারা পড়ে।

শাকিনী সাপ বর্ষাকালে প্রজননক্ষম হয়। একটি স্ত্রী সাপ প্রায় ১৫টির মতো ডিম দেয় এবং সেগুলো থেকে বাচ্চা তোলে। ডিমের উপ্তিকাল বা ‘ইনকিউবেশন’-এর সময় প্রায় দুই মাস। স্ত্রী সাপ ডিমের যত্ন নিতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের প্রায় সব উপকূলবর্তী এলাকার সমতল ভূমি এ সাপ সম্প্রদায়ের বিচরণক্ষেত্র।

প্রবাল সাপ: প্রবাল সাপ নামটি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর। নাম দেখে ধারণা হতে পারে, সামুদ্রিক ও প্রবালদ্বীপ বা পাথুরে জলাভূমি বুঝি এই সাপের আবাসস্থল। এ ধারণা ঠিক নয়। আমাদের দেশে এই সম্প্রদায়ের সাপগুলো নির্জন বনভূমি অঞ্চলে বসবাস করে। এটি বিরল ধরনের সাপ।

প্রবাল সাপের মাথা কালো ও ভোঁতা। মাথার ওপর দুটো স্পষ্ট হলুদ বিন্দু আছে। পেটের রং সিঁদুরে লাল। লেজের দিকটা নীলচে রঙের। সূর্যকিরণে এদের লালচে নীলাভ রং ধরতে দেখা যায়। এগুলো নরম বালু মাটিতে থাকতে পছন্দ করে। এদেরকে শুকনো ও ঝরা পাতার নিচে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায়। পোকা ও কেঁচো আকৃতির দুমুখো সাপগুলো এদের সাধারণ খাদ্য। এ অপেক্ষাকৃত বিরল বলে এদের জীবনচক্র এবং বিষক্রিয়ার কার্যকারিতা বা ধরন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি।

 

চন্দ্রবোড়া:

চন্দ্রবোড়া ‘ভাইপারিডীয়’ জাতের সাপ। এদের বা ‘রাসেলস ভাইপার’দের হঠাৎ করে দেখলে অজগরের বাচ্চা বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এদের মাথা ও পৃষ্ঠদেশীয় রূপ ভিন্নতর। মাথা তুলনামূলকভাবে বড়, ত্রিকোণাকৃতি এবং ঘাড় সরু। এদের বুক থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত মোটা, লেজ সরু এবং আকারে ছোট। দেহাবরণের আঁশ শুকনো খসখসে এবং পেছনের দিকে ওল্টানো। আঁশগুলো তিনটি পাশাপাশি শেকলের মতো সারি করে সাজানো। প্রতি সারির সংযুক্ত শেকল-বলয়গুলো গোলাকার, ডিম্বাকৃতি বা বরফি আকৃতির। গায়ের সাধারণ রং বাদামি থেকে হলদেটে। পেট বাদামি বা হলদে চিতিযুক্ত।

চন্দ্রবোড়া সাপের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। সময় সময় এগুলোকে পাখিও ধরে খেতে দেখা যায়। শিকার ধরার জন্য এরা ওত পেতে বসে থাকে। শরীর ভারী হওয়ার দরুন এগুলো দৌড়ে শিকার ধরতে পারে না। শিকার নাগালের মধ্যে এলে কালবিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে কামড়ে ধরে। ধরার পরপরই শিকারের দেহে বিষ ছেড়ে দেয়। এরপর আহত প্রাণীটির গন্ধ শুঁকে সেটিকে সংগ্রহ করে খায়। অন্যান্য সাপের মতো এদের জিব শব্দ শোনে না। বাতাস ও মাটি থেকে এরা দ্রবীভূত রাসায়নিক দ্রব্যের গন্ধ গ্রহণ করে। এরপর সেই গন্ধ ‘জ্যাকবসন অঙ্গে’ পাঠিয়ে দিয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এরা আওয়াজ শনাক্ত করে।

ইঁদুরভর্তি ধান ও পাটখেতের আল, পাথর-নুড়ি ভর্তি রেললাইন, ইটের ভাটা ও বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় এদের পছন্দের আবাসস্থল। লোকালয়ের গাছগাছালির নিচে জমে থাকা শুকনো লতা-পাতা এবং ইঁদুরের গর্ত বা উইয়ের ঢিবিতেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। চন্দ্রবোড়া সাপ কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও রাজশাহীতে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। যমুনার পূর্ব দিকে ঢাকা অঞ্চলেও এদের সন্ধান পাওয়া যায়।

স্ত্রী চন্দ্রবোড়া সাপ ডিম না পেড়ে সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। সিঞ্চিত ডিম স্ত্রী সাপের পেটের বিশেষ থলিতে আবদ্ধ থাকে। বাচ্চা না ফোটা পর্যন্ত ডিমগুলো (ভ্রূণ) পেটের থলিতেই বাড়তে থাকে। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ২০ থেকে ৪০টি পরিণত সাপের অবিকল বাচ্চা বেরিয়ে আসে।

চন্দ্রবোড়া আমাদের দেশের মারাত্মক বিষধর সাপগুলোর অন্যতম। এগুলো রেগে গেলে বা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে কোণঠাসা হয়ে পড়লে প্রথমত তীব্র হিস্ হিস্ শব্দ করে শত্রুপক্ষকে ভয় দেখায়। তাতে যথেষ্ট কাজ না হলে এরা ছোবল মারে। চন্দ্রবোড়া কামড়ালে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।

এদের বিষ গোখরোর বিষের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ কম বিষাক্ত হলেও মাথা বড় থাকায় এদের বিষখলিতে বিষের পরিমাণ বেশি থাকে। সেই বিষ একবার শত্রুর দেহে পুরো মাত্রায় ঢেলে দিতে পারলে রোগীর অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় সঙ্গিন। চন্দ্রবোড়ার বিষ প্রাণিদেহের রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে। রক্তের অন্তঃক্ষরণ বা জমাট বেঁধে যাওয়ার জন্য রক্তে যে রাসায়নিক উপাদান থাকে, তা ভেঙে অন্য বস্তুতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় রোগী সহজেই মৃত্যুমুখী হয়ে পড়ে। এই সাপের কামড়ে জ্বালাপোড়া অনুভূত হয় এবং ক্ষতস্থান ফুলে ওঠে। রোগীর থুতু-বমি, প্রস্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও বৃক্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

 

সবুজবোড়া:

সবুজ বাঁশবোড়া বা পিট-ভাইপার ‘ক্রোটালিনি’ উপপরিবারের একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়। এই উপপরিবারের পাঁচটি প্রজাতি বাংলাদেশে আছে বলে ধারণা করা হয়। স্বভাবে-বৈশিষ্ট্যে এগুলো এর সহ-উপপরিবার ‘ভাইপারিনি’র মতোই। তবে এদের নাক ও চোখের মাঝখানে আছে একটি স্পর্শকাতর ছিদ্র। কারও কারও মতে চন্দ্রবোড়া ও সবুজবোড়ার মধ্যে মাথা ও গলার আকৃতিগত গরমিল রয়েছে। তবে এই মতের অনুকূলে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণাদি এখনো সংগৃহীত হয়নি। কমবেশি সবুজ বলেই এর নাম সবুজবোড়া। আমাদের দেশে এ জাতের আরও দুই ধরনের সাপ দেখা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের বাড়বাড়ন্ত ও বিচরণক্ষেত্র। লাউডগা ও অন্যটির নাম সবুজডোরা। লাউডগা সাপের মাথা সরু ও সম্মুখভাগ কোণাকৃতি। দেহ বেশ চিকন ও লম্বা। সবুজডোরা সাপ দেখতে অনেকটা আমাদের ঢোঁড়া সাপের মতো, কিন্তু দেহ সবুজ রঙের। এগুলোর কোনোটার মাথা তিন কোনাচে নয় এবং এদের ঘাড় বোড়ার মতো সরু হয় না।

স্বভাবের দিক দিয়ে এগুলো নিশাচর। তবে দিনের বেলা এদের গাছের ডালে লেজ পেঁচিয়ে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। সবুজবোড়ার পছন্দের খাবার হচ্ছে ব্যাঙ, টিকটিকি ও গিরগিটি। বর্ষা মৌসুমে বোড়া সাপ পাঁচ থেকে আটটি বাচ্চা দিয়ে থাকে। পরিণত সাপের তুলনায় এদের দেহ বেশি উজ্জ্বল। এ জাতের সাপগুলো জলাশয়, ঝরনাধারা, পাহাড়ি ছড়া বা গভীর বনের ঝোপঝাড় ও বাঁশবনে থাকতে পছন্দ করে। এ কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন ও সিলেটের চা-বাগান এলাকায় এদের সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে।

আঞ্চলিক জরিপে দেখা যায়, এ সাপগুলোকে অনেকে মারাত্মক বলে গণ্য করে না। সবুজবোড়ার ছোবলে প্রাণহানি ঘটেছে, এমন খবরও খুব একটা শোনা যায় না। এরা আকারে চন্দ্রবোড়ার চেয়ে খাটো এবং এদের বিষথলিও অপেক্ষাকৃত ছোট। কিন্তু বড় ধরনের একটি সবুজবোড়া সাপ কামড়ালে মানুষের না মরার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। তবে ছোট সাপের বেলায় এটা ততটা মারাত্মক না-ও হতে পারে। এ কারণে সাধারণ লোকজনের এই সাপের ব্যাপারে তেমন বৈরী মনোভাব নেই। উপরন্তু এগুলো বেশ নরম মেজাজের হয়ে থাকে। বেশি বিরক্ত না করলে এরা উত্তেজিত হয় না এবং ছোবলও মারে না। ভয় পেলে বা কোণঠাসা হয়ে পড়লে এদেরকে বিব্রত হয়ে কেবল লেজ দোলাতে দেখা যায়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024