০৮:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
‘আমেরিকার শুল্ক সময়সীমা বাড়ানো হবে না’: ১৪টি দেশকে ট্রাম্প ডলার কি সত্যিই কিং হতে চলেছে ? দুই শত বছরের সাক্ষ্য বহন করা সুরমা নদী ইপিজেড-এর নামে সাঁওতাল কৃষক উচ্ছেদ বন্ধ ও দুর্নীতির তদন্তের দাবি বিবিসির অনুসন্ধানে ৫ই অগাস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের যে চিত্র উঠে এসেছে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে জিএম কাদেরের পাশে- শামীম পাটোয়ারী সীমান্তে ‘পুশ ইন’: যাবতীয় আইন ভেঙেও ভারত কেন এত নির্বিকার? পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা ও মানসিক দৃঢ়তায় শ্রীলঙ্কার সিরিজ জয় রাজনীতি ও রাজধানীতে বস্তিবাসীর প্রভাব, সংকুচিত মধ্যবিত্ত “মানবতার ঢাল: হলি আর্টিজানে জঙ্গী রুখতে এসসি রাবিউল করিমের আত্মত্যাগ”

হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন লাদাখের আইসম্যান ছেওয়াং নোরফেল

  • Sarakhon Report
  • ০৬:০০:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪
  • 21

'লাদাখের আইস ম্যান' ছেওয়াং নোরফেল।

কণিকা গুপ্তা

ভারতের লাদাখের কৃষকদের সেচের জন্য জলের যোগান দিতে কৃত্রিম হিমবাহ বানিয়েছেন এক স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এই এলাকায় তুষারপাত এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েছে।

ভারতের উত্তরে অবস্থিত লাদাখের থিকসে গ্রামের বাসিন্দা ডোলকর। তার পরিবারের সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এই একই পেশায় রয়েছেন।

“আমার মনে আছে ছেলেবেলায় এখানে প্রচুর বরফ পড়ত। প্রায় আমার হাটুর সমান উঁচু হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তেমন বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না,” বলেছেন ৫৮ বছরের ডোলকর পেশায় আলু চাষি।

বছরের পর বছর ধরে তার পরিবারের আয় ক্রমশ হ্রাস পেতে দেখেছেন ডোলকর-ঠিক যেমন ভাবে তার গ্রামকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের বরফের টুপির মতো অংশকে চোখের সামনে একটু একটু করে গলে যেতে দেখেছেন।

লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে ১৯ কিলোমিটার (১১.৮ মাইল) পূর্বে অবস্থিত থিকসে।

“আলু চাষ করে আমরা প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা আয় করতাম। কিন্তু এখন ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি আয় করি।”

         (লাদাখের মতো অঞ্চলে চাষের জন্য জলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কৃষকদের।)

ক্রমহ্রাসমান হিমবাহ

হিমালয় পর্বতমালার প্রায় ৩০ লক্ষ হেক্টর জুড়ে আছে ৫৫ হাজার হিমবাহ, যা পৃথিবীর বৃহত্তর (মেরু ক্যাপের বাইরে) বরফে আবৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু হিমালয় পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশও।

এভাবে চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর শেষ নাগাদ হিমালয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

এর তীব্র প্রভাব পড়বে এশিয়ার নদী ব্যবস্থায় উপর যা প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের জন্য জল সরবরাহ করে। প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদন ও জীবিকার উপরেও। হিমবাহের বরফ গলা জলের উপর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২ কোটি ৯০ লক্ষ কৃষক।

তেমনই একটা অঞ্চল হলো ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত লাদাখ যেখানে ডোলকরের বাড়ি।

ঠান্ডা এবং শুষ্ক জলবায়ুযুক্ত লাদাখে বছরে ন্যূনতম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আনুমানিক ৮৬.৮ মিমি (৩.৪ ইঞ্চি)। এই অঞ্চলের ৮০% কৃষক সেচের জন্য হিমবাহের বরফ গলা জলের উপর নির্ভর করে।

এদিকে, গত ৩০ বছরে, তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। যার ফলে তুষার আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে। যে কারণে হিমবাহ পশ্চাদপসরণ করেছে, প্রবাহে জলের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়েছে এবং হিমালয় অঞ্চলের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র জলের ঘাটতি।

কিন্তু ডোলকরের গ্রামে এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য একটা উদ্ভাবনী কৌশল বের করেছেন একজন স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। থিকসের কাছেই নাং নামের এক গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করেছেন ওই ইঞ্জিনিয়ার । নাম ছেওয়াং নোরফেল। তিনি অবশ্য লাদাখের ‘আইস ম্যান’ বলেই পরিচিত।

তার পেশাগত কাজের অংশ হিসাবে, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হতো তাকে। সেই সময় মি. নোরফেল আবিষ্কার করেন ৮০% কৃষক চাষের জন্য জলের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

হিমবাহের বরফ গলা জল যা চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রবাহিত হতে শুরু করে যদিও বীজ বপনের মরসুম শুরু হয় এপ্রিল মাসে। দীর্ঘ শীতের কারণে অব্যবহৃত হিমবাহের বরফ গলা জল স্থানীয় ঝোরাতে বয়ে যেতে থাকে।

ওই জল যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অত্যাবশ্যক সম্পদ, তা সংরক্ষণের জন্য একটা কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন মি. নোরফেল। ধীরে ধীরে লাদাখের আরও ১০টা গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরী করে ফেলেন তিনি। নাং ওই গ্রামগুলোর মধ্যে একটা।

লাদাখ অঞ্চলের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (১৮.৬ মাইল) দূরে নাং গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৭৮০ মিটার (১২,৪০২ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত।

এই গ্রামে বাস করেন মাত্র ৩৩৪ জন যাদের প্রাথমিক জীবিকা হল কৃষি। মূলত আলু এবং গম চাষ করেন তারা।

এই অঞ্চলের অনেক গ্রামের মতোই, নাংয়ে কোনও স্থায়ী হিমবাহ নেই এবং জল সরবরাহের উৎস প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং স্থানীয় ঝোরা। তবে তার জল চাষের জন্য যথেষ্ট নয়। বীজ বপনের মরসুমে বিশেষত এপ্রিল এবং মে মাসে কৃষি কাজের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জলের যোগান দরকার।

চাষের জন্য বিশেষত বসন্তকালে গম, আলু এবং অন্যান্য ফসলের সেচের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ তইরি করে। কারণ গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত হিমবাহের বরফ গলে না।

অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে স্থানীয় কৃষকরা পরের বছরের জন্য তাদের কৃষিকার্যের পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন। অনিশ্চয়তা তাদের ভাবতে বাধ্য করেছিল আগামী মরসুমের জন্য আদৌ বীজ বপন করবেন কি না।

এতে একদিকে যেমন অনিশ্চয়তার কারণে বপন না করলে সম্ভাব্য আয় হ্রাসের ঝুঁকি থাকে, তেমনই বীজ বপন করার পর পর্যাপ্ত জল না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।

তার সম্প্রদায়ের মানুষেরা উপর যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে তা নজর এড়ায়নি ৮৭ বছরের ছেওয়াং নোরফেলের।

                                                        (বরফ ধরে রাখার জন্য তৈরি পাঁচিল।)

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এবং সাবেক গ্রামোন্নয়ন কর্মকর্তা, একটা অভিনব কৌশল বের করেন যাতে ফলনে ঘাটতি না হয়, কৃষকেরা ক্ষতির শিকার না হন আর একইসঙ্গে হিমবাহকে তাদের গ্রামের ‘কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়’।

তিনি বলেন, “মূল হিমবাহ থেকে জল পাওয়া শুরু হয় জুন মাস থেকে।”

“আমরা জল বানাতে পারব না। সুতরাং আমাদের কাছে থাকা উৎসকে ব্যবহার করাটাই হলো একমাত্র বিকল্প পথ।”

মি. নোরফেল জানিয়েছেন যে হিমবাহের জলকে সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল এমন একটা জায়গা থেকে, যেখানে এমন একটা ভাবনা আসার কথা তিনি একেবারেই কল্পনা করেননি।

বাড়ির পিছনের বাগানের একটা কল দেখে এই অভিনব কৌশল মাথায় আসে তার।

তার কথায়, “শীতকালে জলের প্রবাহ ঠিক রাখতে আমরা কল চালু রাখি। নয়তো পাইপে জল জমে সেটা ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।”

তবে এই জল থাকে না। মি. নোরফেল চালু করা কলের নিচে তৈরি হওয়া পাতলা বরফের একটি ছোট চাদর লক্ষ্য করেন। কলের নীচে ছায়ায় ঢাকা জায়গায় জল জমে জমে বরফ হয়ে গেছে, কারণ ওই অংশে সরাসরি রোদ্দুর পড়েনি।

ছেওয়াং নোরফেল বুঝতে পারেন তিনি যদি নষ্ট হওয়া জল ধরে রাখতে এবং জমাতে সক্ষম হন তা হলে পুরো গ্রামের জন্য কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করা যাবে।

গ্রামবাসীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সুকৌশলে বিভিন্ন উচ্চতায় কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন তিনি।

তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রামের সবচেয়ে কাছের হিমবাহ যা সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত তার বরফ প্রথমে গলবে। বসন্তে কালে প্রাথমিক বপনের সময় প্রয়োজনীয় সেচের জল সরবরাহ করে এই কৃত্রিম হিমবাহের বরফ গলা জল।

তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আরও বেশি উচ্চতায় থাকা পরবর্তী কৃত্রিম হিমবাহ গলতে শুরু করলে তা নিচের জমিতে সেচের জলের অবিচ্ছিন্ন ও সময়মতো জলের সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

অভিনব পন্থা

উঁচু পর্বতমালার নীচে অবস্থিত নাং। এই গ্রামে আসা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে যে বোর্ড টাঙানো রয়েছে সেখানে নাংয়ের বিখ্যাত কৃত্রিম হিমবাহের দিকনির্দেশ দেওয়া আছে।

ওই হিমবাহে পৌঁছতে হলে ৩০ মিনিটের সফর শেষে পৌঁছানো যায় ওই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যযুক্ত পর্বতমালার কাছে। প্রথম ১০ মিনিটের সফরের পরেই বরফের প্যাচগুলো একেএকে আসতে থাকে।

সূর্যনারায়ণন বালাসুব্রহ্মণ্যম কৃত্রিম হিমবাহ সহ জল ব্যবস্থাপনার সমাধান সরবরাহকারী সংস্থা ‘একরস অফ আইস’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সুইজারল্যান্ডের ফ্রাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বরফের জলাধারের উপর পিএইচডি করছেন এবং হিমবাহ কীভাবে জল সংরক্ষণ বাড়িয়ে তুলতে পারে তা নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছেন।

নাং গ্রামে সময় কাটিয়ে আসা এই গবেষক বলেন, “এই গ্রামে জল সংরক্ষণের জন্য এক অভিনব কাঠামো আছে যার অন্তর্গত হলো পাহাড়ের উপরে থাকা একটা হিমায়িত খাল, যা উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত।”

“খালের পাশে বিশেষ কৌশলে রাখা পাথরের দেয়াল জলের গতি কমিয়ে দেয়, যার ফলে জল হিমায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই শিলা প্রাচীরের উদ্দেশ্য হিমাঙ্কের হার বাড়ানো, যাতে উপত্যকা জুড়ে বরফের চাদর তৈরি হয়।”

মি. বালাসুব্রহ্মণ্যম জানিয়েছেন, এই অভিনব পদ্ধতি কাজে দিয়েছে। তার মতে, গ্রামের জল সরবরাহ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে।

“এখনও পর্যন্ত,এই হিমবাহ এপ্রিল মাসের গুরুত্বপূর্ণ মাসগুলোতে প্রায় ১০টি গ্রামকে জল সরবরাহ করে উপকৃত করছে। আমরা আরও দুটো (কৃত্রিম হিমবাহ) তৈরী করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“লাদাখে বহুল পরিমাণ পর্যটনের কারণে দ্রুত নেমে যাওয়া ভূগর্ভস্থ জল পুনরুজ্জীবিত করার জন্যও এটা একটা ভাল সমাধান,” মি. নরফেল বলেছেন।

 কৃত্রিম হিমবাহ থেকে বয়ে আসা জল পান করছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল।
           (কৃত্রিম হিমবাহ থেকে বয়ে আসা জল পান করছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল।)

নাংয়ের কৃষকরা এই কৃত্রিম হিমবাহের পেয়ে কৃতজ্ঞ।

“কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির আগে পর্যাপ্ত জল পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল,” বলেছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল। নাং গ্রামেই বাস করেন ৪৪ বছরের এই ব্যক্তি যিনি পেশায় কৃষক ।

তিনি বলেন, “প্রচুর তুষারপাত হলেও তা আমাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে হয়েছিল। ওই বরফ গলতে অনেকটা সময় লেগেছিল। এবং সেই জল আমাদের কাছে এমনকি কাছে এসে পৌঁছতে আরও বেশি সময় লেগেছে। “

“এই বিলম্বের অর্থ হলো আমাদের ফসল কাটাতে দেরি হবে এবং কখনও কখনও পর্যাপ্ত জল না থাকার কারণে জমি শুষ্ক হয়ে যায়।”

লাদাখের গ্রামগুলোতে এই কৃত্রিম হিমবাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা স্থানীয় অলাভজনক সংস্থা লেহ নিউট্রিশন প্রোগ্রাম (এলএনপি) ২০১৩ সালে প্রাথমিক ভাবে যে দল তৈরী করেছিল মি. ওয়াংগিয়াল তার সদস্য ছিলেন।

সেই সময়ে কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। মি. ওয়াংগিয়ালের কথায়, “আমরা শুধুমাত্র একটা বেলচা নিয়ে শূন্যের নিচে তাপমাত্রায় কাজ করেছি যাতে জলের প্রবাহকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। “

“সেই সময় আমার কাছে পা গরম রাখার মতো জুতোও ছিল না। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের জন্য আমি কাজ করেছি। এখন এই কৃত্রিম হিমবাহই আমাদের জলের প্রাথমিক উৎস।”

কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির এই কাজ আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রসারিত করতে ১৯৯৫ সালে অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে হাত মেলান মি. নোরফেল। তার কৃতিত্বের জন্য প্রশংসাও অর্জন করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে পদ্মশ্রী যা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বেসামরিক পুরস্কার।

তার উদ্ভাবনী ধারণা সোনম ওয়াংচুকের মতো অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সোনম ওয়াংচুক ‘আইস স্তূপ’ বা বরফের স্তূপ প্রজেক্টে হিমায়িত জল গলানোর আগে একটি শঙ্কুর মতো স্তূপের আকার ধারণ করে। পরে তা চাষের মরসুমে বিতরণ করা হয়।

যদিও মি. ওয়াংচুকের এই সৃষ্টিকে কিছুটা সংশয়ের চোখে দেখেন ছেওয়াং নোরফেল।

তার মতে, “বরফের স্তূপও একটা সমাধান বটে আর এক্ষেত্রে কাজের জন্য নির্দিষ্ট সাইট বেছে নিতে হবে না (যেমনটা কৃত্রিম হিমবাহের ক্ষেত্রে করা হয়)। তবে এটা কৃত্রিম হিমবাহের তুলনায় অনেকটাই ব্যয়বহুল এবং জটিল। কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করা সহজ এবং এটা কম খরচে করা যায়।”

বৈশ্বিক সমস্যার স্থানীয় সমাধান

বিশেষজ্ঞদের মতে জলসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম হিমবাহ অত্যন্ত শক্তিশালী কৌশল।

এই কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী হিমবাহ গলনের সমস্যার সমাধান হয়তো হবে না কিন্তু পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ যারা হিমবাহের উপর নির্ভর করেন তাদের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে ।

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডেভিড রাউন্সের গবেষণা অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের সমগ্র হিমবাহের ২৫%-৪০% ভর লুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই গবেষক মনে করেন,কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির কৌশল “অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা”।

“এই অঞ্চলে বরফের স্তূপ এবং (কৃত্রিম) হিমবাহ তৈরির মতো পদ্ধতি ভাল কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে,” বলেছেন ডেভিড রাউন্স।

“এই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে জল সঞ্চয় হয়, যার ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মানুষকে জল সরবরাহ করা যায়।”

এই প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়েরও উল্লেখ করেছেন তিনি । তার কথায়, “আমরা যদি সমস্যাটাকে দেখি তাহলে বুঝব তাপমাত্রা কিন্তু বাড়তেই থাকবে যদি না আমরা সবাই মিলে বিশ্বব্যাপী সমাজ হিসাবে কোনও পদক্ষেপ নিই।”

                                           (লাদাখের নাং গ্রামের বাইরে ঝোলানো সাইনবোর্ড।)

হিমালয়ে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে কাজ করা নেপালের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) সম্প্রতি একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে নীতিনির্ধারকদের জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে লড়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

মানব জীবন ও প্রকৃতির উপর এর ‘মারাত্মক প্রভাব’ পড়বে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইসিআইএমওডির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ইজাবেলা কোজিয়েল বলেন, “এশিয়ার ২০০ কোটি মানুষ যে জলের উপর নির্ভর করে তা ধারণ করে এখানকার হিমবাহ ও তুষার। সেই ক্রায়োস্ফিয়ারকে হারানোর পরিণতি কিন্তু ব্যাপক।”

মি. রাউন্সের ২০২৩ সালের সমীক্ষা জল সরবরাহ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনধারণের ক্ষেত্রে ছোট হিমবাহের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়, বিশেষত মধ্য ইউরোপ এবং উচ্চ-পর্বত এশিয়ার মতো অঞ্চলগুলোতে। এই ছোট হিমবাহগুলো পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ থিকসে বা নাংয়ের মতো গ্রামের কথা বলেছে মি. রাউন্স।

“বিশ্বব্যাপী স্তরে এই কৌশল (ছেওয়াং নোরেফেলের কৃত্রিম হিমবাহের) বিবেচনা করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিলি এবং মধ্য ইউরোপে বসবাসকারীসহ পৃথিবীর বহু সম্প্রদায় কিন্তু এই জল সম্পদের উপর নির্ভর করে। তাই, জল-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এটা একটা কার্যকর স্থানীয় সমাধান হতে পারে,” বলেছেন মি. রাউন্স।

তবে, রাউন্সের উল্লেখ করেছেন যে এই ছোট আকারের প্রকল্পগুলো জলবায়ু সমাধানের পরিবর্তনের মতো সমস্যার সমাধান করে না। তার কথায়, “যদি আমরা ভেবে থাকি এটা বিশ্বব্যাপী হিমবাহের ক্ষয় ঠেকাবে, তাহলে সেটা কিন্তু হবে না।”

লাদাখের ‘আইস ম্যান’ নোরফেল বিশ্বাস করেন যে তার সহজ, স্বল্প ব্যয়ের কৌশল একটা দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি।

তিনি বলেছেন, “আমরা জল তৈরি করতে পারি না, তবে আমরা আমাদের হাতের কাছে থাকা উৎস ব্যবহার করতে পারি। গ্রামের মানুষকে এই কাজে সামিল করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কৃত্রিম হিমবাহের রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করতে পারি।

“এই কৃত্রিম হিমবাহ গ্রামের আশপাশের ঝোরাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে সাহায্য করে করে, যেগুলো জলের গৌণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠে। “

বিবিসি সংবাদদাতা

‘আমেরিকার শুল্ক সময়সীমা বাড়ানো হবে না’: ১৪টি দেশকে ট্রাম্প

হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন লাদাখের আইসম্যান ছেওয়াং নোরফেল

০৬:০০:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪

কণিকা গুপ্তা

ভারতের লাদাখের কৃষকদের সেচের জন্য জলের যোগান দিতে কৃত্রিম হিমবাহ বানিয়েছেন এক স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এই এলাকায় তুষারপাত এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েছে।

ভারতের উত্তরে অবস্থিত লাদাখের থিকসে গ্রামের বাসিন্দা ডোলকর। তার পরিবারের সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এই একই পেশায় রয়েছেন।

“আমার মনে আছে ছেলেবেলায় এখানে প্রচুর বরফ পড়ত। প্রায় আমার হাটুর সমান উঁচু হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তেমন বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না,” বলেছেন ৫৮ বছরের ডোলকর পেশায় আলু চাষি।

বছরের পর বছর ধরে তার পরিবারের আয় ক্রমশ হ্রাস পেতে দেখেছেন ডোলকর-ঠিক যেমন ভাবে তার গ্রামকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের বরফের টুপির মতো অংশকে চোখের সামনে একটু একটু করে গলে যেতে দেখেছেন।

লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে ১৯ কিলোমিটার (১১.৮ মাইল) পূর্বে অবস্থিত থিকসে।

“আলু চাষ করে আমরা প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা আয় করতাম। কিন্তু এখন ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি আয় করি।”

         (লাদাখের মতো অঞ্চলে চাষের জন্য জলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কৃষকদের।)

ক্রমহ্রাসমান হিমবাহ

হিমালয় পর্বতমালার প্রায় ৩০ লক্ষ হেক্টর জুড়ে আছে ৫৫ হাজার হিমবাহ, যা পৃথিবীর বৃহত্তর (মেরু ক্যাপের বাইরে) বরফে আবৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু হিমালয় পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশও।

এভাবে চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর শেষ নাগাদ হিমালয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

এর তীব্র প্রভাব পড়বে এশিয়ার নদী ব্যবস্থায় উপর যা প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের জন্য জল সরবরাহ করে। প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদন ও জীবিকার উপরেও। হিমবাহের বরফ গলা জলের উপর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২ কোটি ৯০ লক্ষ কৃষক।

তেমনই একটা অঞ্চল হলো ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত লাদাখ যেখানে ডোলকরের বাড়ি।

ঠান্ডা এবং শুষ্ক জলবায়ুযুক্ত লাদাখে বছরে ন্যূনতম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আনুমানিক ৮৬.৮ মিমি (৩.৪ ইঞ্চি)। এই অঞ্চলের ৮০% কৃষক সেচের জন্য হিমবাহের বরফ গলা জলের উপর নির্ভর করে।

এদিকে, গত ৩০ বছরে, তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। যার ফলে তুষার আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে। যে কারণে হিমবাহ পশ্চাদপসরণ করেছে, প্রবাহে জলের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়েছে এবং হিমালয় অঞ্চলের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র জলের ঘাটতি।

কিন্তু ডোলকরের গ্রামে এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য একটা উদ্ভাবনী কৌশল বের করেছেন একজন স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। থিকসের কাছেই নাং নামের এক গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করেছেন ওই ইঞ্জিনিয়ার । নাম ছেওয়াং নোরফেল। তিনি অবশ্য লাদাখের ‘আইস ম্যান’ বলেই পরিচিত।

তার পেশাগত কাজের অংশ হিসাবে, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হতো তাকে। সেই সময় মি. নোরফেল আবিষ্কার করেন ৮০% কৃষক চাষের জন্য জলের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

হিমবাহের বরফ গলা জল যা চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রবাহিত হতে শুরু করে যদিও বীজ বপনের মরসুম শুরু হয় এপ্রিল মাসে। দীর্ঘ শীতের কারণে অব্যবহৃত হিমবাহের বরফ গলা জল স্থানীয় ঝোরাতে বয়ে যেতে থাকে।

ওই জল যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অত্যাবশ্যক সম্পদ, তা সংরক্ষণের জন্য একটা কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন মি. নোরফেল। ধীরে ধীরে লাদাখের আরও ১০টা গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরী করে ফেলেন তিনি। নাং ওই গ্রামগুলোর মধ্যে একটা।

লাদাখ অঞ্চলের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (১৮.৬ মাইল) দূরে নাং গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৭৮০ মিটার (১২,৪০২ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত।

এই গ্রামে বাস করেন মাত্র ৩৩৪ জন যাদের প্রাথমিক জীবিকা হল কৃষি। মূলত আলু এবং গম চাষ করেন তারা।

এই অঞ্চলের অনেক গ্রামের মতোই, নাংয়ে কোনও স্থায়ী হিমবাহ নেই এবং জল সরবরাহের উৎস প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং স্থানীয় ঝোরা। তবে তার জল চাষের জন্য যথেষ্ট নয়। বীজ বপনের মরসুমে বিশেষত এপ্রিল এবং মে মাসে কৃষি কাজের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জলের যোগান দরকার।

চাষের জন্য বিশেষত বসন্তকালে গম, আলু এবং অন্যান্য ফসলের সেচের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ তইরি করে। কারণ গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত হিমবাহের বরফ গলে না।

অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে স্থানীয় কৃষকরা পরের বছরের জন্য তাদের কৃষিকার্যের পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন। অনিশ্চয়তা তাদের ভাবতে বাধ্য করেছিল আগামী মরসুমের জন্য আদৌ বীজ বপন করবেন কি না।

এতে একদিকে যেমন অনিশ্চয়তার কারণে বপন না করলে সম্ভাব্য আয় হ্রাসের ঝুঁকি থাকে, তেমনই বীজ বপন করার পর পর্যাপ্ত জল না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।

তার সম্প্রদায়ের মানুষেরা উপর যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে তা নজর এড়ায়নি ৮৭ বছরের ছেওয়াং নোরফেলের।

                                                        (বরফ ধরে রাখার জন্য তৈরি পাঁচিল।)

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এবং সাবেক গ্রামোন্নয়ন কর্মকর্তা, একটা অভিনব কৌশল বের করেন যাতে ফলনে ঘাটতি না হয়, কৃষকেরা ক্ষতির শিকার না হন আর একইসঙ্গে হিমবাহকে তাদের গ্রামের ‘কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়’।

তিনি বলেন, “মূল হিমবাহ থেকে জল পাওয়া শুরু হয় জুন মাস থেকে।”

“আমরা জল বানাতে পারব না। সুতরাং আমাদের কাছে থাকা উৎসকে ব্যবহার করাটাই হলো একমাত্র বিকল্প পথ।”

মি. নোরফেল জানিয়েছেন যে হিমবাহের জলকে সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল এমন একটা জায়গা থেকে, যেখানে এমন একটা ভাবনা আসার কথা তিনি একেবারেই কল্পনা করেননি।

বাড়ির পিছনের বাগানের একটা কল দেখে এই অভিনব কৌশল মাথায় আসে তার।

তার কথায়, “শীতকালে জলের প্রবাহ ঠিক রাখতে আমরা কল চালু রাখি। নয়তো পাইপে জল জমে সেটা ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।”

তবে এই জল থাকে না। মি. নোরফেল চালু করা কলের নিচে তৈরি হওয়া পাতলা বরফের একটি ছোট চাদর লক্ষ্য করেন। কলের নীচে ছায়ায় ঢাকা জায়গায় জল জমে জমে বরফ হয়ে গেছে, কারণ ওই অংশে সরাসরি রোদ্দুর পড়েনি।

ছেওয়াং নোরফেল বুঝতে পারেন তিনি যদি নষ্ট হওয়া জল ধরে রাখতে এবং জমাতে সক্ষম হন তা হলে পুরো গ্রামের জন্য কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করা যাবে।

গ্রামবাসীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সুকৌশলে বিভিন্ন উচ্চতায় কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন তিনি।

তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রামের সবচেয়ে কাছের হিমবাহ যা সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত তার বরফ প্রথমে গলবে। বসন্তে কালে প্রাথমিক বপনের সময় প্রয়োজনীয় সেচের জল সরবরাহ করে এই কৃত্রিম হিমবাহের বরফ গলা জল।

তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আরও বেশি উচ্চতায় থাকা পরবর্তী কৃত্রিম হিমবাহ গলতে শুরু করলে তা নিচের জমিতে সেচের জলের অবিচ্ছিন্ন ও সময়মতো জলের সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

অভিনব পন্থা

উঁচু পর্বতমালার নীচে অবস্থিত নাং। এই গ্রামে আসা পর্যটকদের স্বাগত জানাতে যে বোর্ড টাঙানো রয়েছে সেখানে নাংয়ের বিখ্যাত কৃত্রিম হিমবাহের দিকনির্দেশ দেওয়া আছে।

ওই হিমবাহে পৌঁছতে হলে ৩০ মিনিটের সফর শেষে পৌঁছানো যায় ওই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যযুক্ত পর্বতমালার কাছে। প্রথম ১০ মিনিটের সফরের পরেই বরফের প্যাচগুলো একেএকে আসতে থাকে।

সূর্যনারায়ণন বালাসুব্রহ্মণ্যম কৃত্রিম হিমবাহ সহ জল ব্যবস্থাপনার সমাধান সরবরাহকারী সংস্থা ‘একরস অফ আইস’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সুইজারল্যান্ডের ফ্রাইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বরফের জলাধারের উপর পিএইচডি করছেন এবং হিমবাহ কীভাবে জল সংরক্ষণ বাড়িয়ে তুলতে পারে তা নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছেন।

নাং গ্রামে সময় কাটিয়ে আসা এই গবেষক বলেন, “এই গ্রামে জল সংরক্ষণের জন্য এক অভিনব কাঠামো আছে যার অন্তর্গত হলো পাহাড়ের উপরে থাকা একটা হিমায়িত খাল, যা উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত।”

“খালের পাশে বিশেষ কৌশলে রাখা পাথরের দেয়াল জলের গতি কমিয়ে দেয়, যার ফলে জল হিমায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই শিলা প্রাচীরের উদ্দেশ্য হিমাঙ্কের হার বাড়ানো, যাতে উপত্যকা জুড়ে বরফের চাদর তৈরি হয়।”

মি. বালাসুব্রহ্মণ্যম জানিয়েছেন, এই অভিনব পদ্ধতি কাজে দিয়েছে। তার মতে, গ্রামের জল সরবরাহ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে।

“এখনও পর্যন্ত,এই হিমবাহ এপ্রিল মাসের গুরুত্বপূর্ণ মাসগুলোতে প্রায় ১০টি গ্রামকে জল সরবরাহ করে উপকৃত করছে। আমরা আরও দুটো (কৃত্রিম হিমবাহ) তৈরী করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“লাদাখে বহুল পরিমাণ পর্যটনের কারণে দ্রুত নেমে যাওয়া ভূগর্ভস্থ জল পুনরুজ্জীবিত করার জন্যও এটা একটা ভাল সমাধান,” মি. নরফেল বলেছেন।

 কৃত্রিম হিমবাহ থেকে বয়ে আসা জল পান করছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল।
           (কৃত্রিম হিমবাহ থেকে বয়ে আসা জল পান করছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল।)

নাংয়ের কৃষকরা এই কৃত্রিম হিমবাহের পেয়ে কৃতজ্ঞ।

“কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির আগে পর্যাপ্ত জল পাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল,” বলেছেন রিংজেন ওয়াংগিয়াল। নাং গ্রামেই বাস করেন ৪৪ বছরের এই ব্যক্তি যিনি পেশায় কৃষক ।

তিনি বলেন, “প্রচুর তুষারপাত হলেও তা আমাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে হয়েছিল। ওই বরফ গলতে অনেকটা সময় লেগেছিল। এবং সেই জল আমাদের কাছে এমনকি কাছে এসে পৌঁছতে আরও বেশি সময় লেগেছে। “

“এই বিলম্বের অর্থ হলো আমাদের ফসল কাটাতে দেরি হবে এবং কখনও কখনও পর্যাপ্ত জল না থাকার কারণে জমি শুষ্ক হয়ে যায়।”

লাদাখের গ্রামগুলোতে এই কৃত্রিম হিমবাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা স্থানীয় অলাভজনক সংস্থা লেহ নিউট্রিশন প্রোগ্রাম (এলএনপি) ২০১৩ সালে প্রাথমিক ভাবে যে দল তৈরী করেছিল মি. ওয়াংগিয়াল তার সদস্য ছিলেন।

সেই সময়ে কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। মি. ওয়াংগিয়ালের কথায়, “আমরা শুধুমাত্র একটা বেলচা নিয়ে শূন্যের নিচে তাপমাত্রায় কাজ করেছি যাতে জলের প্রবাহকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। “

“সেই সময় আমার কাছে পা গরম রাখার মতো জুতোও ছিল না। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের জন্য আমি কাজ করেছি। এখন এই কৃত্রিম হিমবাহই আমাদের জলের প্রাথমিক উৎস।”

কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির এই কাজ আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রসারিত করতে ১৯৯৫ সালে অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে হাত মেলান মি. নোরফেল। তার কৃতিত্বের জন্য প্রশংসাও অর্জন করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে পদ্মশ্রী যা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বেসামরিক পুরস্কার।

তার উদ্ভাবনী ধারণা সোনম ওয়াংচুকের মতো অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সোনম ওয়াংচুক ‘আইস স্তূপ’ বা বরফের স্তূপ প্রজেক্টে হিমায়িত জল গলানোর আগে একটি শঙ্কুর মতো স্তূপের আকার ধারণ করে। পরে তা চাষের মরসুমে বিতরণ করা হয়।

যদিও মি. ওয়াংচুকের এই সৃষ্টিকে কিছুটা সংশয়ের চোখে দেখেন ছেওয়াং নোরফেল।

তার মতে, “বরফের স্তূপও একটা সমাধান বটে আর এক্ষেত্রে কাজের জন্য নির্দিষ্ট সাইট বেছে নিতে হবে না (যেমনটা কৃত্রিম হিমবাহের ক্ষেত্রে করা হয়)। তবে এটা কৃত্রিম হিমবাহের তুলনায় অনেকটাই ব্যয়বহুল এবং জটিল। কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করা সহজ এবং এটা কম খরচে করা যায়।”

বৈশ্বিক সমস্যার স্থানীয় সমাধান

বিশেষজ্ঞদের মতে জলসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম হিমবাহ অত্যন্ত শক্তিশালী কৌশল।

এই কৌশলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী হিমবাহ গলনের সমস্যার সমাধান হয়তো হবে না কিন্তু পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ যারা হিমবাহের উপর নির্ভর করেন তাদের সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে ।

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডেভিড রাউন্সের গবেষণা অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বের সমগ্র হিমবাহের ২৫%-৪০% ভর লুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই গবেষক মনে করেন,কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির কৌশল “অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা”।

“এই অঞ্চলে বরফের স্তূপ এবং (কৃত্রিম) হিমবাহ তৈরির মতো পদ্ধতি ভাল কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে,” বলেছেন ডেভিড রাউন্স।

“এই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে জল সঞ্চয় হয়, যার ফলে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মানুষকে জল সরবরাহ করা যায়।”

এই প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়েরও উল্লেখ করেছেন তিনি । তার কথায়, “আমরা যদি সমস্যাটাকে দেখি তাহলে বুঝব তাপমাত্রা কিন্তু বাড়তেই থাকবে যদি না আমরা সবাই মিলে বিশ্বব্যাপী সমাজ হিসাবে কোনও পদক্ষেপ নিই।”

                                           (লাদাখের নাং গ্রামের বাইরে ঝোলানো সাইনবোর্ড।)

হিমালয়ে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে কাজ করা নেপালের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) সম্প্রতি একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে নীতিনির্ধারকদের জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে লড়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

মানব জীবন ও প্রকৃতির উপর এর ‘মারাত্মক প্রভাব’ পড়বে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইসিআইএমওডির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ইজাবেলা কোজিয়েল বলেন, “এশিয়ার ২০০ কোটি মানুষ যে জলের উপর নির্ভর করে তা ধারণ করে এখানকার হিমবাহ ও তুষার। সেই ক্রায়োস্ফিয়ারকে হারানোর পরিণতি কিন্তু ব্যাপক।”

মি. রাউন্সের ২০২৩ সালের সমীক্ষা জল সরবরাহ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনধারণের ক্ষেত্রে ছোট হিমবাহের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়, বিশেষত মধ্য ইউরোপ এবং উচ্চ-পর্বত এশিয়ার মতো অঞ্চলগুলোতে। এই ছোট হিমবাহগুলো পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ থিকসে বা নাংয়ের মতো গ্রামের কথা বলেছে মি. রাউন্স।

“বিশ্বব্যাপী স্তরে এই কৌশল (ছেওয়াং নোরেফেলের কৃত্রিম হিমবাহের) বিবেচনা করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চিলি এবং মধ্য ইউরোপে বসবাসকারীসহ পৃথিবীর বহু সম্প্রদায় কিন্তু এই জল সম্পদের উপর নির্ভর করে। তাই, জল-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এটা একটা কার্যকর স্থানীয় সমাধান হতে পারে,” বলেছেন মি. রাউন্স।

তবে, রাউন্সের উল্লেখ করেছেন যে এই ছোট আকারের প্রকল্পগুলো জলবায়ু সমাধানের পরিবর্তনের মতো সমস্যার সমাধান করে না। তার কথায়, “যদি আমরা ভেবে থাকি এটা বিশ্বব্যাপী হিমবাহের ক্ষয় ঠেকাবে, তাহলে সেটা কিন্তু হবে না।”

লাদাখের ‘আইস ম্যান’ নোরফেল বিশ্বাস করেন যে তার সহজ, স্বল্প ব্যয়ের কৌশল একটা দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি।

তিনি বলেছেন, “আমরা জল তৈরি করতে পারি না, তবে আমরা আমাদের হাতের কাছে থাকা উৎস ব্যবহার করতে পারি। গ্রামের মানুষকে এই কাজে সামিল করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কৃত্রিম হিমবাহের রক্ষণাবেক্ষণ আমরাই করতে পারি।

“এই কৃত্রিম হিমবাহ গ্রামের আশপাশের ঝোরাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে সাহায্য করে করে, যেগুলো জলের গৌণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠে। “

বিবিসি সংবাদদাতা