শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৪ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-৬)

  • Update Time : রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

তাপসকে সকাল সাড়ে আটটার ভেতর ছুটে আসতে হয় ওর বস্ত্র-কারখানায়।

নারায়গঞ্জের পাগলার দিকে একটা তিন কামরার বাসা ভাড়া নিয়ে কোনোরকমে কাজ চালাচ্ছে সে। বাচ্চাদের নানারকম জামা-কাপড় এখানে তৈরি হয়। শ্রমিকসহ মোট দশ-বারোজন ওর সঙ্গে কাজ করে। সামনাসামনি না থাকলে কাজ এগোয় না। ফাঁকিবাজ কর্মচারী ও শ্রমিকদল গল্প-গুজবে মেতে থাকতে ভালবাসে। কাজ না করে মাইনে বা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে যত মনোযোগ ওদের। মালিক না থাকা মানে ওদের কাছে একপ্রকার ছুটি Ñ এরকমই মনের গড়ন সবার। তাই তাপসকে শ্রমিকদের চেয়েও আগে পৌঁছুতে হয় কারখানায়।  ছুটতে হয় সবদিকে নজর রেখে ও  সব সামলে নিয়ে।

প্রচÐ প্রতিযোগিতায় ঠাসা এই বাজার। দোকানে-দোকানে সময়মতো জামাকাপড় যোগান দিতে হয়। প্রায়ই টাকা বাকি পড়ে থাকে। সহজে ফেরত দিতে চায় না দোকানদারেরা। নানা টালবাহানা করে আটকে রাখে লক্ষ লক্ষ টাকা। সারাক্ষণ অনুরোধ-উপরোধের উপর নির্ভরশীল তাপসকে ওদের সঙ্গে সুপার-গøু-র মতো আটকে থাকতে হয়। নইলে পুরো পাওনার টাকাই বেহাত হয়ে যাবে।

এসব ঘটনা শুধু তাপসের বেলায় নয়, ওর মতো শত-সহ¯্র ছোটখাটো বস্ত্র-কারখানার বেলায় এটাই দস্তুর। এর ভেতর দিয়ে নিজেদের মানিয়ে চলতে হয়। কিছু করার নেই।

বিদেশী ক্রেতা পেলে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু সেখানেও ঝুঁকি থাবা বসায়। চাহিদার বাইরে একটুখানি এদিক-ওদিক হলেই পুরো লটটা বাতিল বলে গণ্য হয়। স্থানীয় বাজারে তখন সামান্য মূল্য ধরে ছেড়ে দিতে হয় সব  মাল। একই ডিজাইনের হাজার-হজার শার্ট-প্যান্ট Ñ কে আর নিতে চায় তখন ? সাধারণ মানুষ তো দশটা দেখে একটা নিজের জন্যে  কিনতে ভালোবাসে।

এসব নিয়ে সে আছে মহাফাঁপড়ে। সারাক্ষণ একটা টেনশনের ভেতর ওকে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে হয়।

যখন বাসায় ফিরে আসে তখন আর কিছু ভালো লাগে না। অথচ তপতীর একশ আটটা অভিযোগ-অনুযোগ। শুনতেই হবে। তুষ্টিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। সে কেন অত আনমনা Ñ এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা।

‘তুমি তুষ্টিকে কিছু বল ?’

‘বলব । ’ ক্লান্ত কণ্ঠের নিষ্প্রাণ উত্তর তাপসের।

‘বলব কি ? এখনই বল। তুমি বাবা না ?’ তাড়া তপতীর গলায়।

‘একটু জিরিয়ে নিই। সবে তো এলাম। আর তুষ্টিরা তো এখন হাউজ-টিউটরের কাছে পড়ছে। ’

‘আমি ডেকে দিচ্ছি। ’

‘অত উতলা কেন তুমি? সময় আছে তো। বলা যাবে। ’

‘তুমি কোনকিছু গায়ে লাগাও না বলেই মেয়েগুলোর এ অবস্থা।’ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে সে কীচেনে ঢুকে পড়ে।

সাতশত স্কোয়ার ফিটের নিজস্ব ফ্ল্যাট ওদের। গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকায় এখানে এই দিয়াশলাইর বাক্সের মতো ফ্ল্যাটটি ওরা কিনে নিয়েছে। কিন্তু মেয়েরা যত বড় হচ্ছে তত এটি দিনদিন চাহিদার তুলনায়  ছোট হয়ে পড়ছে। কিছুতেই জিনিসপত্র আঁটছে না। তপতীর এজন্য দুঃখের শেষ নেই। সুযোগ পেলেই সে এ ব্যাপারে একটা অভিযোগ ঠুকে দেয় স্বামীর কাছে। তাপস নির্বাক হয়ে সব শোনে।  ওর হাতে কোন সমাধান  নেই। সামান্য রোজগারের এ মানুষটি  বছর সাতেক আগে ঝুঁকি নিয়ে কিনে ফেলেছিল বসবাসের এ ফ্ল্যাটটি। এখন দুর্মূল্যের বাজারে ফ্ল্যাট কেনা কি সহজ কথা ? তখন সাহস করে এটি না কিনে ফেললে হয়তো কখনোই ঢাকায় ফ্ল্যাট আর কেনা হতো না। দিন আনি দিন খাই সংসারটি চালাতেই তো হিমসিম খাচ্ছে সে। আবার বাড়তি বায়না কিভাবে মিটাবে ?

এই ব্যাপারগুলোই তপতী বুঝতে চায় না। সারাদিন যত ক্ষোভ আর অভিমান সে জমিয়ে রাখে, মনে হচ্ছে, এর সবগুলো তাপসকে না বলতে পারলে ওর সুখ নেই। সে প্রতিটি বিষয় নিয়ে রাগ করবে এবং তা ওকে সহ্য করতে হবে নীরবে।

তুষ্টির অংকের স্যার খুবই নিয়ম মেনে চলা লোক। না পারলে তিনি তিন ঘন্টা পর্যন্ত বসে থাকতে রাজি। প্রায়ই তপতীর কাছে তার অভিযোগ থাকে ,‘ তুষ্টির তো মনোযোগ নাই অঙ্কে। আজ বুঝালে কালই ভুলে যায়। ’

‘হোম-টাস্ক দেবেন বেশি বেশি করে। ’

‘তা তো দিচ্ছি বৌদি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে সবকিছু দেখে করে ফেলে। তাতে তো ওর কোন উপকার হচ্ছে না। ’

‘মার লাগান, স্যর। আমি বল্লাম , ছাড়বেন না। ’

একথায় ওদুদ মাস্টার লাজুক হাসে। এ কাজটা যে পাড়ার মাস্টার দিয়ে সম্ভব নয় তা সে জানে। তাই তুষ্টি কিছু না পারলেই বলে ওঠে,‘ তোমার  মা তোমাকে  কি বলেছে জানো ? শোন নাই ? আমাকে ওপথে যেতে বল ?’

তুষ্টি মাথা নুইয়ে থাকে। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু সে কি করবে ? ওর যে এসব ভালো লাগে না। পাটীগণিতের অঙ্ক কষার মাঝখানে হঠাৎ ওর মন উড়–-উড়–  হয়ে পড়ে। ছাদবাগানে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে কোন্ পাখিটা  এসে কচি গাছের ডালে ডালে কিচিরমিচির জুড়ে দিয়েছে।  গাছগুলোর  মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছা করে সেই সময়।

যে গাছটা সারাদিন রোদে পুড়ে বিকেলবেলা কাহিল হয়ে পড়েছে, ওর সারা শরীরে মমতার জল ছিটিয়ে দেবার খুব ইচ্ছে জাগে ।

অন্যদের ছাদে কি হচ্ছে তাও তাকিয়ে  দেখার প্রচÐ কৌতূহল ওর মনে।  একটা ছেলে রোজ বিকালে পাশের ছাদে উঠে ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। চোখে ভারি চশমা। হাতে একটা ট্যাব। ছাদে উঠেও সে সেটা অবিরাম টিপতে থাকে। কাজের  মাঝে ছেলেটার চোখ মাঝে মাঝে নিবিড়ভাবে ওকে পরখ করে।

তুষ্টি ঠিকই টের পায়। শরীর ওর শিরশির করে ওঠে। অস্বস্তি হয় ভীষণ।  ইশকুলে যাওয়া-আসার সময় ছেলেটা মাঝে মধ্যে মুখোমুখি পড়ে যায় ।  ইচ্ছে করে কথা বলতে।  সঙ্গে মা থাকায়  কথা আর  হয়ে ওঠে না।

অঙ্ক কষতে এসে এসব যখন মনে পড়ে  তখন সব গোলমাল হয়ে যায়। যোগ করতে গিয়ে বিয়োগ করে ফেলে। পূরণের জায়গায় ভাগ করে ক্রমাগত স্যরের বকা খেতে হয়।  এসব কারণে  চোখ ওর ছলছল করে ওঠে।  এত অপমান  আর সহ্য হয় না। পাটিগণিত, এলজাবরা আর  জ্যামিতির সমস্যাগুলো ছাদবাগানের গাছগুলোর মতো আরও সহজ  হয়ে ওর কাছে কেন ধরা দেয় না তা নিয়ে মনে ভাবনার অন্ত নেই।

তপতী এসে দাঁড়াল। মুখে বলল,‘ স্যর, ওকে ওর বাবা একটু ডাকছে।’

‘ঠিকাছে।’

তুষ্টি মায়ের সঙ্গে বাবার ঘরে এল। বাবা তখন চানাচুর দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। অফিস থেকে ফেরার পর তিনি এগুলো খান। তারপর নাক ডেকে ঘুম দেন। আবার রাতের খাওয়ার সময়  উঠে পড়েন।

তপতী বলল‘,এই যে মেয়ে এসেছে । তুমি না কি বলবে ওকে ?’

‘ও হ্যা।’ বলে একটু ঢোক গিলল। তারপর ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না।

‘কি বল ?’ তাড়া দেয় তপতী।

‘ও। আচ্ছা তুষ্টি, তুমি নাকি পড়ায় খুব অমনোযোগী ? এভাবে কি চলবে, বল ? বাপীর কি অত সম্পদ আছে যে তোমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবো ? একটু মনোযোগী হও, মা। তুমি তো আগে এরকম ছিলে না।  বুঝতে তো পারো, টানাটানির সংসার। অনেক কষ্টে তোমাদের টানতে হচ্ছে আমাদের। ’ খুব নরোম করে বাবা কথাগুলো বলে ফের কড়মড় করে মুড়ি- চানাচুর চিবোতে থাকে।

তুষ্টি মাথা নুয়ে সব শুনে স্যারের কাছে চলে যেতেই তপতী রাগে ফেটে পড়ল,‘তোমাকে এমন মিষ্টি করে কথা বলতে বলেছি ? তোমার আস্কারা পেয়ে তো মেয়েটা আরও বখে যাবে।’

ভাবলেশহীনভাবে মুড়ি-চানাচুর চিবোতে থাকে তাপস। এসময় কথা বলা সত্যি খুব কঠিন কাজ। এরকম করতে গেলে দাঁতের কামড় বসে যেতে পারে জিহŸায়। বারবার বারণ করা সত্তে¡ও ঠিক এসময় তপতীকে কথা বলতেই হবে। আগে রাগ হত। এখন সব গা-সওয়া।

তাপসের জীবন এখন গরু-গাধার মতো। কোনকিছুতেই আর সাড়া মেলে না।

‘কি হল ? মেয়েকে এভাবে অত আদর দিলে চলবে ?’

কোনরকমে চিবানো বন্ধ করে মৃদু কন্ঠে উত্তর দিল,‘এই মেয়েটাই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। দেখো।’ বলে ফের খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে ওঠে সে।

‘ঘোড়ার ডিম। তুমি তো জ্যোতিষী। এক কাজ কর ; লাল সালু পরে রাস্তায় বসে যাও। গার্মেন্টস কোম্পানীর চেয়ে বেশি কামাতে পারবে।’ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়।

তাপসের শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসে।

সে পাশবালিশ জড়িয়ে নাক ডেকে ঘুম দেয় একটা। জগৎ সংসারের সকল চিন্তা আপাতত অফ।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024