শ্রী নিখিলনাথ রায়
আলিবন্দী খাঁ ভাগীরথীর পূর্ব্ব তীরের প্রাসাদে বাস করিতেন। মুর্শিদাবাদের যে স্থানকে সাধারণতঃ নিজামত কেল্লা বলিয়া থাকে, সেই স্থানে বহুদিন হইতে নবাবদিগের প্রাসাদ ছিল। সৌন্দর্য্যপ্রিয় সিরাজ তথ। হইতে অল্প কোন স্থানে একটি মনোরম প্রাসাদ নির্মাণের কল্পনা করেন। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বর্তমান জাফরাগঞ্জের সম্মুখভাগে তাহার স্থান নির্ণীত হয়। হিন্দু ও মুসলমান-গৌরবের সমাধিস্থল গৌড় হইতে নানাবিধ প্রস্তরাদি আনীত হইয়া প্রাসাদের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির চেষ্টা করা হইয়াছিল। প্রাসাদ সাধারণতঃ ইষ্টকে নিৰ্ম্মিত হয়।
কিন্তু স্থানে স্থানে প্রপ্তর বসাইয়া সিরাজ তাহাকে শোভাশালী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। প্রাসাদের তরঙ্গায়িত পলগুলি কার্ণিসের অপরিসীম সৌন্দর্য্য বিস্তার করিত। ভিন্ন ভিন্ন চত্বরে প্রাসাদটি বিভক্ত হয়, অথবা এক একটি, পৃথক্ চত্বরই, এক, একটি বিভিন্ন প্রাসাদে পরিণত হয়। কোনটি এন্তাজ মহাল, কোনটি বা রঙ্গমহাল প্রভৃতি নামে অভিহিত হইত। সেই সুন্দর প্রাসাদ এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল যে, কাহারও কাহারও মতে তাহাতে তিনটি ইউরোপীয় নরপতি অনায়াসে বাস করিতে পারিতেন।
প্রাসাদের প্রান্তদেশে একটি কৃত্রিম ঝিল খনন করিয়া, তাহাকে হীরাঝিল নাম প্রদান করা হইয়াছিল। সম্ভবতঃ নওয়াজেস্ মহম্মদ খাঁর মোতিঝিলের অনুকরণে সিরাজের হীরাঝিল হইয়া থাকিবে। ঝিলের উত্তর পার্শ্ব ইষ্টকদ্বারা বাঁধান হয়। এই সুচারু প্রাসাদের নিম্মাণ শেষ হওয়ার পূর্ব্বে সিরাজ মাতামহ আলিবন্দী খাঁকে প্রাসাদ দর্শনের জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠান। বৃদ্ধ নবাবের সহিত অনেক কৰ্ম্মচারী, রাজা, জমীদার ও জমীদারদিগের প্রতিনিধিগণও ভাবী নরাবের সুরম্য প্রাসাদ দেখিতে ‘অগ্রসর হইলেন। নবাব আলিবন্দী খাঁ প্রাসাদ দেখিয়া অত্যন্ত চমৎকৃত হন। তাঁহার অনুচরবর্গও বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া, সিরাজের রুচির ভূয়সী প্রশংসা করিতে থাকেন।
কেহ বা ভিন্ন ভিন্ন চত্বরের, কেহ বা সুরম্য কক্ষশ্রেণীর, কেহ বা পলতোলা কার্ণিসের এবং কেহ বা হীরাঝিলের প্রশংসায় সিরাজের বালসুলভ চঞ্চল অন্তরকে অধিকতর স্ফীত করিয়া তুলেন। যখন সকলে ভিন্ন ভিন্ন চত্বরে বা প্রকোষ্ঠে পরিভ্রমণ করিতেছিলেন, সেই সময় বৃদ্ধ নবাব কোন একটি প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে, সিরাজ মাতামহের সহিত কৌতুকচ্ছলে তাঁহাকে সেই প্রকোষ্ঠমধ্যে বন্ধ করিয়া রাখিলেন। নবাব দৌহিত্রের রহস্য বুঝিতে পারিয়া বলিলেন যে, আজ তোমারই জন্ম হইয়াছে, এক্ষণে তোমাকে কি উপহার দিলে আমাকে। মুক্ত করিয়া দিবে? সিরাজও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলেন যে, আমার প্রসাদের জন্য কোন বন্দোবস্ত না করিলে, ইহার নিম্মাণশের ও সৌন্দর্য্যরক্ষা হইবে না। তজ্জন্ত ইহার কোনরূপ উপায় বিধান করিতে হইবে।