০১:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল মার্কো রুবিওর উপস্থিতিতে ডিআরসি-রুয়ান্ডা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর কংগ্রেসের বহু নেতা ইন্দিরা জি ও জেপি-র সংলাপ চেয়েছিলেন, তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল তা হতে দেয়নি হিউএনচাঙ (পর্ব-১৩২) ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৭) সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি

শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সংকট কাটছে না কেন?

  • Sarakhon Report
  • ১২:৫২:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪
  • 17

তারেকুজ্জামান শিমুল

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ইসলামি ধারার বা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি কমে গেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার স্থিতিকে ‘তারল্য’ বলা হয়ে থাকে। কোনও কারণে ব্যাংকে নগদ টাকার সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে তখন তারল্য সংকট তৈরি হয়।

এমন পরিস্থিতিতে পড়লে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে যে দশটি ইসলামি ধারার ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ছয়টিই বর্তমানে তারল্য সংকটে রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ব্যাংকগুলো হচ্ছে: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

অথচ তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংকসহ সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধার হিসেবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো কেন তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না?

(ইসলামি ধারার ব্যাংকের মধ্যে ছয়টিই বর্তমানে তারল্য সংকটে রয়েছে)

তারল্য পরিস্থিতির অবনতি কেন?

আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ বেশি করায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো তারল্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বরের শেষে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মোট আমানত ছিল প্রায় চার লাখ তিন হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।

চলতি বছরের মার্চ মাসে সেটি কমে তিন লাখ ৯৯ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংগুলোর আমানত কমেছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।

অন্যদিকে, গত ডিসেম্বরে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল চার লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।

এ বছরের মার্চে সেই ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বড় আকার ধারণ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।

“আমানত কমে ব্যাংকগুলোকে ঋণ কায়ক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই যারা ঋণ নিচ্ছেন, তারা নিয়মিতভাবে সেই টাকা পরিশোধ করছেন না। যার কারণে তারল্য সংকট বাড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

(বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়েছে)

আরও যত কারণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-আমানত অনুপাতের (আইডিআর) সর্বোচ্চ সীমা ৯২ শতাংশ। অর্থ্যাৎ ১০০ টাকা আমানত থাকলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯২ টাকা বিনিয়োগ বা ঋণ দিতে পারবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-আমানতের অনুপাত ৯৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

এর আগে, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যখন ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল, তখন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আইডিআর ছিল ৯৬ শতাংশ।

এছাড়া ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় যথাযথভাবে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

(বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিক হিসেবে কাজ করে থাকে)

“এসব অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণেও তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, যার প্রভাব পুরো ব্যাংকিং সেক্টরেই পড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

এসব অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষেরও দায় রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংককে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এবং লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হতো।

২০১৭ সালে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটিকে অধিগ্রহণ করে। মূলতঃ এরপরেই প্রতিষ্ঠানটিতে সংকট দেখা দিতে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

“ভালো পারফর্মার ব্যাংকগুলো কেন দ্রুত ব্যাড পারফর্মার হচ্ছে, সেটি খতিয়ে দেখাটা জরুরি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান।

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনেই এসব ঘটনা ঘটছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদেরকে আরও সক্রিয় হতে হবে।”

(অস্থিরতার কারণে অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছেন)

কী বলছে ব্যাংকগুলো?

ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের।

কিন্তু তারপরও অতিরিক্ত বিনিয়োগসহ নানান কারণে তারল্য সংকটে অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটির।

“এখান থেকে বের হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমরা ইতোমধ্যেই শর্ট টার্ম, লং টার্ম বিভিন্ন ধরনের স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।

এসব কৌশলের অংশ হিসেবে, ব্যাংকটি আপাতত বড় অঙ্কের বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে বলেও জানাচ্ছেন তিনি।

“বিনিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেজন্য ঋণ কার্যক্রণ চালু রেখেছি এবং আমাদের বিতরণকৃত বিনিয়োগের বেশিরভাগই কৃষি, ক্ষুদ্র ও এসএমই খাতে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. মওলা।

(গ্রাহকদের চিন্তার কোনও কারণ নেই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক)

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড সংখ্যক বেড়ে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকেরও অনেক টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা হচ্ছে বলেও জানান ইসলামী ব্যাংকের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

“চলতি জুলাই মাস থেকেই আমরা এসব পদক্ষেপের সুফল পেতে শুরু করবো এবং শিগগিরই তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে আশা করছি।”

এছাড়া গত কয়েক মাসে আমানতের প্রবাহ কিছুটা কমলেও এখন সেটি ধীরে ধীরে আবার বাড়তে শুরু করেছে বলেও জানান মি. মওলা।

একই বিষয়ে জানতে শরিয়াহভিত্তিক অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে রাজী হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, ইসলামী ব্যাংকের মতোই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মেনে সংকট উত্তোরণের চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তদারকির ক্ষেত্রে আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি নেই বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

“যা কিছু করার এবং যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই আমরা করছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।

কিন্তু তারপরও কেন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না?

“সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বর্তমানে আমরা যে মুদ্রানীতি অনুসরণ করছি, সেটির প্রভাবেই ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হক।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে।

(মূল্যস্ফীতি কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক)

এই মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানার লক্ষ্যে গতবছরের মতো এবারও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

“এর ফলে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা লক্ষ্য রাখছি যেন এর প্রভাবে খুব বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।

এছাড়া ব্যাংকিংখাতের এই তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের উদ্বেগের কিছু হওয়ার নেই বলেও জানাচ্ছেন তিনি।

“গ্রাহকদের এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দেশে ব্যবসায়িক লেনদেন বাড়ছে। কাজেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আবারও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

তবে তারল্য সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে ঠিক কতদিন লাগতে পারে, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিবিসি নিউজ বাংলা

ডেমোক্র্যাটদের নীতির ব্যর্থতা যেভাবে মামদানিকে জয়ী করল

শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সংকট কাটছে না কেন?

১২:৫২:২২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই ২০২৪

তারেকুজ্জামান শিমুল

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ইসলামি ধারার বা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি কমে গেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার স্থিতিকে ‘তারল্য’ বলা হয়ে থাকে। কোনও কারণে ব্যাংকে নগদ টাকার সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গেলে তখন তারল্য সংকট তৈরি হয়।

এমন পরিস্থিতিতে পড়লে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে নিজেদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে যে দশটি ইসলামি ধারার ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ছয়টিই বর্তমানে তারল্য সংকটে রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ব্যাংকগুলো হচ্ছে: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।

অথচ তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংকসহ সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধার হিসেবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু তারপরও ব্যাংকগুলো কেন তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না?

(ইসলামি ধারার ব্যাংকের মধ্যে ছয়টিই বর্তমানে তারল্য সংকটে রয়েছে)

তারল্য পরিস্থিতির অবনতি কেন?

আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ বেশি করায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো তারল্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বরের শেষে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মোট আমানত ছিল প্রায় চার লাখ তিন হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।

চলতি বছরের মার্চ মাসে সেটি কমে তিন লাখ ৯৯ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংগুলোর আমানত কমেছে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।

অন্যদিকে, গত ডিসেম্বরে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল চার লাখ ১৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।

এ বছরের মার্চে সেই ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে প্রায় চার লাখ ২৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বড় আকার ধারণ করেছে বলে জানা যাচ্ছে।

“আমানত কমে ব্যাংকগুলোকে ঋণ কায়ক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই যারা ঋণ নিচ্ছেন, তারা নিয়মিতভাবে সেই টাকা পরিশোধ করছেন না। যার কারণে তারল্য সংকট বাড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

(বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেড়েছে)

আরও যত কারণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-আমানত অনুপাতের (আইডিআর) সর্বোচ্চ সীমা ৯২ শতাংশ। অর্থ্যাৎ ১০০ টাকা আমানত থাকলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯২ টাকা বিনিয়োগ বা ঋণ দিতে পারবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ-আমানতের অনুপাত ৯৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

এর আগে, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যখন ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল, তখন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আইডিআর ছিল ৯৬ শতাংশ।

এছাড়া ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় যথাযথভাবে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

(বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অন্যান্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিক হিসেবে কাজ করে থাকে)

“এসব অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণেও তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, যার প্রভাব পুরো ব্যাংকিং সেক্টরেই পড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

এসব অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষেরও দায় রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংককে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এবং লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করা হতো।

২০১৭ সালে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটিকে অধিগ্রহণ করে। মূলতঃ এরপরেই প্রতিষ্ঠানটিতে সংকট দেখা দিতে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

“ভালো পারফর্মার ব্যাংকগুলো কেন দ্রুত ব্যাড পারফর্মার হচ্ছে, সেটি খতিয়ে দেখাটা জরুরি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান।

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনেই এসব ঘটনা ঘটছে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদেরকে আরও সক্রিয় হতে হবে।”

(অস্থিরতার কারণে অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছেন)

কী বলছে ব্যাংকগুলো?

ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের।

কিন্তু তারপরও অতিরিক্ত বিনিয়োগসহ নানান কারণে তারল্য সংকটে অর্থ ধার করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটির।

“এখান থেকে বের হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, আমরা ইতোমধ্যেই শর্ট টার্ম, লং টার্ম বিভিন্ন ধরনের স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।

এসব কৌশলের অংশ হিসেবে, ব্যাংকটি আপাতত বড় অঙ্কের বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছে বলেও জানাচ্ছেন তিনি।

“বিনিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেজন্য ঋণ কার্যক্রণ চালু রেখেছি এবং আমাদের বিতরণকৃত বিনিয়োগের বেশিরভাগই কৃষি, ক্ষুদ্র ও এসএমই খাতে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. মওলা।

(গ্রাহকদের চিন্তার কোনও কারণ নেই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক)

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড সংখ্যক বেড়ে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকেরও অনেক টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা হচ্ছে বলেও জানান ইসলামী ব্যাংকের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

“চলতি জুলাই মাস থেকেই আমরা এসব পদক্ষেপের সুফল পেতে শুরু করবো এবং শিগগিরই তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবো বলে আশা করছি।”

এছাড়া গত কয়েক মাসে আমানতের প্রবাহ কিছুটা কমলেও এখন সেটি ধীরে ধীরে আবার বাড়তে শুরু করেছে বলেও জানান মি. মওলা।

একই বিষয়ে জানতে শরিয়াহভিত্তিক অন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে রাজী হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, ইসলামী ব্যাংকের মতোই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ মেনে সংকট উত্তোরণের চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক যা বলছে

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তদারকির ক্ষেত্রে আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি নেই বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

“যা কিছু করার এবং যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই আমরা করছি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।

কিন্তু তারপরও কেন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না?

“সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বর্তমানে আমরা যে মুদ্রানীতি অনুসরণ করছি, সেটির প্রভাবেই ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হক।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে।

(মূল্যস্ফীতি কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক)

এই মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানার লক্ষ্যে গতবছরের মতো এবারও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

“এর ফলে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে, যা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা লক্ষ্য রাখছি যেন এর প্রভাবে খুব বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।

এছাড়া ব্যাংকিংখাতের এই তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকদের উদ্বেগের কিছু হওয়ার নেই বলেও জানাচ্ছেন তিনি।

“গ্রাহকদের এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দেশে ব্যবসায়িক লেনদেন বাড়ছে। কাজেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আবারও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

তবে তারল্য সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে ঠিক কতদিন লাগতে পারে, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিবিসি নিউজ বাংলা