০৯:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১১৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • 18

শ্রী নিখিলনাথ রায়

অন্যান্য ইউরোপীরগণও ভারতে প্রাধান্য লাভের যে আশায় উৎফুর হইতেছিল, পলাশীপ্রান্তরে সে আশাও বিকলাঙ্গী হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে ভারত হইতে চিরবিদায় লইতে বাধ্য হয়। পলাশী হইতেই প্রাচ্য জগতে ইংলণ্ডের ক্ষমতা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ হইয়া উঠে, সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য জগতেও তাহার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। পলাশীই উত্তমাশা অন্তরীপ, মরিশশ ও মিসরের বিজয় ও সেই সেই স্থানে উপনিবেশ সংস্থাপনের কারণ। পলাশীর জন্যই সমস্ত পৃথিবীতে ইংলণ্ডের বাণিজ্যস্রোতঃ প্রবাহিত হইয়াছে; তাই নীলসাগরে উত্তাল তরঙ্গরাশি ভেদ করিয়া ব্রিটিশ অর্ণবপোত সদর্পে দেশ বিদেশে গতায়াত করিতেছে। পলাশীই ইংলণ্ড ও তাহার উপনিবেশসমূহের শিল্পকার্য্যের মহোন্নতি সংসাধিত করিয়াছে।
ইংলণ্ডের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া, আপনাদিগের প্রতিভা ও বুদ্ধি- মত্তার পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অগাধ সম্পত্তির অধীশ্বর হইয়া মনে মনে পলাশীকে ধন্যবাদ দিতেছেন! ইংলণ্ডের সম্ভ্রান্ত-বংশীয়গণ শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া নিজ নিজ রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিতেছেন এবং সমস্ত ব্রিটনসন্তানের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব্ব গৌরব সমুদিত হইয়া তাহাদিগকে সমগ্র বসুন্ধরার শ্রেষ্ঠজাতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার প্রয়াস পাইতেছে। পলাশীই ব্রিটিশ জাতির মনে আমেরিকার স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনের সান্ত্বনা দিয়াছে, এবং তাহার প্রতি অন্ত্যান্ত ইউরোপীয় জাতি সমূহের অঙ্গহাবৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।
আর আমাদের-আমাদের অধিক কথা তুলিবার প্রয়োজন নাই। তবে শত শত বৎসর মুসল‌মানের পদানত থাকিয়া, সুশাসনের ছায়া যে জাতির মন হইতে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হইয়াছিল, পলাশী সে জাতিকে যে যথেষ্ট সান্ত্বনা প্রদান করিয়াছে, ইহা কে অস্বীকার করিবে? যে দেশে প্রায়ই বিচারবিভ্রাট ঘটিত, সে দেশে এখন যে রাজার বিরুদ্ধেও বিচার প্রার্থনা করা হয়, ইহা এই হতভাগ্য জাতির পক্ষে কম সান্ত্বনার বিষয় নহে। যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র ইউরোপ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে, পলাশী সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছায়া ভারতবর্ষে আনিয়া দিয়াছে। পলাশী যেমন এক দিকে ভারতের দর্শন, ভারতের সাহিত্য, ইউরোপে লইয়া গিয়াছে সেইরূপ ইউরোপ হইতে পাশ্চাত্য জ্ঞানের আলোকও আনয়ন করিয়াছে। যে দেশের • অধিবাসিগণ সাধারণ তন্ত্রের ও রাজনীতির পরিচয় বহুদিন হইতে জানিত না, পলাশী সেই ইউরোপীয় শাসননীতির শান্তিময় ছায়াতে সে দেশকে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে।
কিন্তু পলাশী হইতে যে আমাদের সম্পূর্ণ লাভ ঘটিয়াছে, এ কথা বলিতে পারা যায় না। পলাশী এক দিকে যেমন ব্রিটিশ-শিল্পের উন্নতি করিয়াছে, অন্য দিকে তেমনি ভারতীয় শিল্পের মস্তকে পদাঘাত ঘটাই- রাছে। এক দিকে যেমন ইউরোপের মধ্যবিত্তগণ ধনকুবের হইতেছেন, অন্যদিকে ভারতের মধ্যবিত্তগণ তেমনি অন্নাভাবে শ্মশানকঙ্কালের ন্যায় হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে যেমন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আমাদিগকে আলোকিত করিয়াছে, আর এক দিকে তেমনি আমাদিগের জাতীর ভাবের অস্তিত্ব লোপ করিতে বসিয়াছে। এক দিকে যেমন আমাদিগের অলস হৃদয় উৎসাহের প্রতপ্ত মদিরাপানে কার্যক্ষম হইতেছে, অন্যদিকে তেমনি হৃদয় হইতে সরল বিশ্বাস অন্তর্হিত হইয়া সন্দেহের স্প্রিনয় বীজ দিন নিদ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে।

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১১৯)

১১:০০:১৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

শ্রী নিখিলনাথ রায়

অন্যান্য ইউরোপীরগণও ভারতে প্রাধান্য লাভের যে আশায় উৎফুর হইতেছিল, পলাশীপ্রান্তরে সে আশাও বিকলাঙ্গী হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে ভারত হইতে চিরবিদায় লইতে বাধ্য হয়। পলাশী হইতেই প্রাচ্য জগতে ইংলণ্ডের ক্ষমতা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ হইয়া উঠে, সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য জগতেও তাহার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। পলাশীই উত্তমাশা অন্তরীপ, মরিশশ ও মিসরের বিজয় ও সেই সেই স্থানে উপনিবেশ সংস্থাপনের কারণ। পলাশীর জন্যই সমস্ত পৃথিবীতে ইংলণ্ডের বাণিজ্যস্রোতঃ প্রবাহিত হইয়াছে; তাই নীলসাগরে উত্তাল তরঙ্গরাশি ভেদ করিয়া ব্রিটিশ অর্ণবপোত সদর্পে দেশ বিদেশে গতায়াত করিতেছে। পলাশীই ইংলণ্ড ও তাহার উপনিবেশসমূহের শিল্পকার্য্যের মহোন্নতি সংসাধিত করিয়াছে।
ইংলণ্ডের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া, আপনাদিগের প্রতিভা ও বুদ্ধি- মত্তার পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অগাধ সম্পত্তির অধীশ্বর হইয়া মনে মনে পলাশীকে ধন্যবাদ দিতেছেন! ইংলণ্ডের সম্ভ্রান্ত-বংশীয়গণ শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া নিজ নিজ রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিতেছেন এবং সমস্ত ব্রিটনসন্তানের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব্ব গৌরব সমুদিত হইয়া তাহাদিগকে সমগ্র বসুন্ধরার শ্রেষ্ঠজাতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার প্রয়াস পাইতেছে। পলাশীই ব্রিটিশ জাতির মনে আমেরিকার স্বাতন্ত্র্য অবলম্বনের সান্ত্বনা দিয়াছে, এবং তাহার প্রতি অন্ত্যান্ত ইউরোপীয় জাতি সমূহের অঙ্গহাবৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।
আর আমাদের-আমাদের অধিক কথা তুলিবার প্রয়োজন নাই। তবে শত শত বৎসর মুসল‌মানের পদানত থাকিয়া, সুশাসনের ছায়া যে জাতির মন হইতে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হইয়াছিল, পলাশী সে জাতিকে যে যথেষ্ট সান্ত্বনা প্রদান করিয়াছে, ইহা কে অস্বীকার করিবে? যে দেশে প্রায়ই বিচারবিভ্রাট ঘটিত, সে দেশে এখন যে রাজার বিরুদ্ধেও বিচার প্রার্থনা করা হয়, ইহা এই হতভাগ্য জাতির পক্ষে কম সান্ত্বনার বিষয় নহে। যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্র ইউরোপ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে, পলাশী সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছায়া ভারতবর্ষে আনিয়া দিয়াছে। পলাশী যেমন এক দিকে ভারতের দর্শন, ভারতের সাহিত্য, ইউরোপে লইয়া গিয়াছে সেইরূপ ইউরোপ হইতে পাশ্চাত্য জ্ঞানের আলোকও আনয়ন করিয়াছে। যে দেশের • অধিবাসিগণ সাধারণ তন্ত্রের ও রাজনীতির পরিচয় বহুদিন হইতে জানিত না, পলাশী সেই ইউরোপীয় শাসননীতির শান্তিময় ছায়াতে সে দেশকে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে।
কিন্তু পলাশী হইতে যে আমাদের সম্পূর্ণ লাভ ঘটিয়াছে, এ কথা বলিতে পারা যায় না। পলাশী এক দিকে যেমন ব্রিটিশ-শিল্পের উন্নতি করিয়াছে, অন্য দিকে তেমনি ভারতীয় শিল্পের মস্তকে পদাঘাত ঘটাই- রাছে। এক দিকে যেমন ইউরোপের মধ্যবিত্তগণ ধনকুবের হইতেছেন, অন্যদিকে ভারতের মধ্যবিত্তগণ তেমনি অন্নাভাবে শ্মশানকঙ্কালের ন্যায় হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে যেমন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আমাদিগকে আলোকিত করিয়াছে, আর এক দিকে তেমনি আমাদিগের জাতীর ভাবের অস্তিত্ব লোপ করিতে বসিয়াছে। এক দিকে যেমন আমাদিগের অলস হৃদয় উৎসাহের প্রতপ্ত মদিরাপানে কার্যক্ষম হইতেছে, অন্যদিকে তেমনি হৃদয় হইতে সরল বিশ্বাস অন্তর্হিত হইয়া সন্দেহের স্প্রিনয় বীজ দিন নিদ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে।