শ্রী নিখিলনাথ রায়
তাঁহাদের পার্শ্বে তাঁহাদের অন্যান্য পরিবারবর্গ অনন্ত শান্তি উপভোগ করিতেছেন। মহারাষ্ট্রীয় ও আফগানগণের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া, যিনি জীবনে শান্তি ভোগ করিতে পারেন নাই, অথচ বঙ্গরাজ্যের প্রজাদিগকে শান্তিসুখ আস্বাদন করাইবার জন্য সর্ব্বদা যাঁহার চেষ্টা ছিল, মুর্শিদাবাদের অলঙ্কার ও বাঙ্গলার আদর্শ নবাব সেই আলিবর্দী খাঁ মহবৎ জঙ্গ এক্ষণে এই বৃক্ষবাটিকার ছায়ায় চির শান্তি লাভ করিতেছেন।
পদতলে তাঁহার মহীয়সী মহিলা শায়িত হইয়া আছেন। আবার যে হতভাগ্য ষড়যন্ত্রকারিগণের চক্রে রাজ্যচ্যুত হইয়া খণ্ড-বিখণ্ডিত দেহে জীবন বিসর্জন দিয়াছিলেন, আলিবর্দীর প্রিয়তম ও ইংরেজের মহাকণ্টক সেই সিরাজও মাতামহের পার্শ্বে নিদ্রিত। তাঁহারও পদতলে তাঁহার সেই সুখদুঃখের একমাত্র সঙ্গিনী লুৎফ উন্নেসাও মহা- শান্তিতে নিমগ্না। এই স্নিগ্ধচ্ছায়াসমন্বিত শান্তিনিকেতন খোশবাগ মুর্শিদাবাদের মধ্যে একটি প্রধান বৈরাগ্যোদ্দীপক স্থান। এখানে আসিলে, স্মৃতি আলিবর্দী ও সিরাজের অনেক কথা মনে উদয় করিয়া দেয়।
অষ্টা- দশ শতাব্দীর সমস্ত চিত্র ধীরে ধীরে মানসপটে বিকাশ পাইতে থাকে। সেই মহারাষ্ট্রীয়যুদ্ধ, সেই আফগানসমর, পলাশী রণক্ষেত্রে মুসল্মান রাজ- লক্ষ্মীর সেই মর্ম্মভেদী দৃশ্য-সমস্তই মনে হয়, এবং সেই বঙ্গাধীশ্বরগণের বর্তমান ধূলিপরিণতি দেখিয়া কালরহস্যেও চমৎকৃত হইতে হয়। খোশবাগের কিছু দূরে ভাগীরথী সিকতাস্তূপে আত্মবিলয় করিয়া চলিয়া যাইতেছেন; বর্ষাকালে, না জানি কি উচ্ছাসে, উচ্ছসিত হইয়া, খোশবাগের প্রাচীরপ্রান্ত স্পর্শ করিয়া থাকেন।
চারিদিকে আম্র, বাদাম প্রভৃতি বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ আপনাদিগের দূরব্যাপী শাখা বিস্তার করিয়া ছায়ায় ছায়ায় সমাধি-ভবনটি ছাইয়া ফেলিয়াছে। প্রভাতে, মধ্যাহ্নে ও সায়াহ্নে ঘুঘুর দল সেই সমস্ত বৃক্ষশাখার পত্রান্তরালে বসিয়া, গম্ভীর বিষাদসঙ্গীতে সমাধিভবনটিকে আরও বিষাদময় করিয়া উপস্থিত জনগণের চিত্তপটে কেমন এক উদাসভাবোদ্দীপক চিত্র অঙ্কিত করিয়া তুলে। কুন্দ, কামিনী প্রভৃতি কুসুমরাজি প্রস্ফুটিত হইয়া নীরবে সেই সমাধিভবনতলে ঝরিয়া পড়িতেছে; কচিৎ তাহারা সমাধিগুলির উপর স্থান পাইয়া থাকে।
Leave a Reply