১০:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-৮০)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
  • 19
শশাঙ্ক মণ্ডল

কৃষি ও কৃষক

চতুর্থ অধ্যায়

১৮৯০-১৯৪৭ পর্যন্ত কৃষিউৎপাদনে বন্ধ্যাগতির প্রতি লক্ষ করে Dr. Daniel এবং Mrs. Alice Thorner কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন নদীর জলনিকাশী ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া, ম্যালেরিয়ার আক্রমণ, অসংখ্য নদীর মজে যাওয়ার ফলে জলাজমির সৃষ্টি হয়েছে। হাড়োয়া কুলটি এলাকার লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি জলমগ্ন হয়েছে, ডায়মন্ডহারবার, আলিপুর, খুলনা, বরিশালের বিভিন্ন প্রান্তে বিংশ শতাব্দীর ১ম দশকের মধ্যে অসংখ্য বিল, বাওড়, জলাভূমির সৃষ্টি হল। ধাপা, সল্টলেক প্রায় ৩০ স্কোয়ার মাইল জায়গা জুড়ে। বয়রার বিল, দাঁতভাঙা, হাড়োয়া গোবেড়িয়া বিলবল্লী, পদ্মার বিল, তেড়েমারি বিল, মথুরাপুর বিল, গড়িয়ার বিল প্রভৃতি, এর সঙ্গে ভাঙড়, ক্যানিং, জয়নগর, খুলনা, বাগেরহাট ভোলা পটুয়াখালি প্রভৃতি এলাকায় অসংখ্য বিল ও জলা এলাকা লক্ষ করা গেল।

২৪ পরগনা জেলার আদিগঙ্গা বিদ্যাধরী মাতলা, পিয়ালী, পদ্মা, সুটি নদী মজে যাবার ফলে এবং আরো অনেক নদী গভীরতা হারানোর ফলে পূর্বের মতো জল নিকাশ হত না। এ সব বিলে জলনিকাশী ব্যবস্থা না থাকার ফলে সব সময় জলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত এবং ম্যালেরিয়া বৃদ্ধির কারণ হয়ে দেখা দিল। যশোরের ভৈরব এক সময় প্রবল নদী, বিশাল এলাকার জল সমুদ্রে পৌঁছে দিত। জনৈক নীলকর সাহেব ভৈরব নদীতে বাঁধ দিলেন যার ফলে দ্রুত শ্যাওলা পরিপূর্ণ জলভূমিতে পরিণত হল। ‘a filthy floating morass on the edges as choked with weeds and mud.'(Report Sanitary Commission 1888) ১৮৭১-৭২ এ ম্যালেরিয়া গ্রামাঞ্চলে তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছিল এবং এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ডঃ জ্যাকসন মন্তব্য করেছেন কৃষি ও কৃষকের জীবনে সুখ ও স্বস্তি আনার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সুপেয় পানীয় জল এবং জলসেচ।

এর অভাব সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় দারুণভাবে ছিল, বৃষ্টির জলই ছিল একমাত্র সুপেয় পানীয় জল। গ্রামাঞ্চলে সেদিন মহামারী লেগেই থাকত গ্রামের পর গ্রাম কলেরা বসন্ত রোগে শেষ হয়ে যেত। বারবার বন্যা জলোচ্ছ্বাস ঝড় মহামারী রুটিনমাফিক সুন্দরবনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও জমির উর্বরতা, বেশি জমি পাবার লোভ নিশ্চিত চাষের সুযোগ চাষিদের উৎসাহিত করেছিল সুন্দরবনের জমি উদ্ধার করার ব্যাপারে। সেন্সাস রিপোর্টগুলিতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকাতে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছিল উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে।

২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার থানাগুলিতে ১৮৯১-১৯০১ সালের মধ্যে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে ২৪.২% এবং এক দশক পূর্বেও এই বৃদ্ধি ছিল ৬.৯ শতাংশ। খুলনা জেলার ক্ষেত্রে এ সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে- জঙ্গলকে দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রচুর কৃষিযোগ্য ভূমি বের করা হয়েছে। ১৮৭২-৮১ এর মধ্যে মরেল সাহেবের জমিদারি খুলনার পূর্বপ্রান্তে বাগেরহাট এলাকায় উঠিত করা হয়েছে এবং প্রচুর জনবসতি লক্ষ করা যাচ্ছে। খুলনার জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে ১৮৯১-১৯০১ এর মধ্যে মাত্র ৬.৪ শতাংশ কিন্তু একমাত্র পাইকগাছা থানাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে ৪৯.৭ শতাংশ এবং এবং এই থানার সব এলাকার জঙ্গল তখন পরিষ্কার করা হচ্ছিল। জমির উর্বরতার জন্য একজন চাষী এক লাঙলে ১৫/২০ বিঘা জমি চাষবাস করতে পারত অন্যত্র একটা লাঙলে ১০ বিঘার বেশি করা সম্ভব হত না। এছাড়া দূরের চাষিরা বর্ষার শুরুতে সুন্দরবনের জমিচাষ করে অন্য এলাকায় গিয়ে নিজেদের জমি চাষবাস করতে পারত।

 

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-৮০)

১২:০০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
শশাঙ্ক মণ্ডল

কৃষি ও কৃষক

চতুর্থ অধ্যায়

১৮৯০-১৯৪৭ পর্যন্ত কৃষিউৎপাদনে বন্ধ্যাগতির প্রতি লক্ষ করে Dr. Daniel এবং Mrs. Alice Thorner কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন নদীর জলনিকাশী ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া, ম্যালেরিয়ার আক্রমণ, অসংখ্য নদীর মজে যাওয়ার ফলে জলাজমির সৃষ্টি হয়েছে। হাড়োয়া কুলটি এলাকার লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি জলমগ্ন হয়েছে, ডায়মন্ডহারবার, আলিপুর, খুলনা, বরিশালের বিভিন্ন প্রান্তে বিংশ শতাব্দীর ১ম দশকের মধ্যে অসংখ্য বিল, বাওড়, জলাভূমির সৃষ্টি হল। ধাপা, সল্টলেক প্রায় ৩০ স্কোয়ার মাইল জায়গা জুড়ে। বয়রার বিল, দাঁতভাঙা, হাড়োয়া গোবেড়িয়া বিলবল্লী, পদ্মার বিল, তেড়েমারি বিল, মথুরাপুর বিল, গড়িয়ার বিল প্রভৃতি, এর সঙ্গে ভাঙড়, ক্যানিং, জয়নগর, খুলনা, বাগেরহাট ভোলা পটুয়াখালি প্রভৃতি এলাকায় অসংখ্য বিল ও জলা এলাকা লক্ষ করা গেল।

২৪ পরগনা জেলার আদিগঙ্গা বিদ্যাধরী মাতলা, পিয়ালী, পদ্মা, সুটি নদী মজে যাবার ফলে এবং আরো অনেক নদী গভীরতা হারানোর ফলে পূর্বের মতো জল নিকাশ হত না। এ সব বিলে জলনিকাশী ব্যবস্থা না থাকার ফলে সব সময় জলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত এবং ম্যালেরিয়া বৃদ্ধির কারণ হয়ে দেখা দিল। যশোরের ভৈরব এক সময় প্রবল নদী, বিশাল এলাকার জল সমুদ্রে পৌঁছে দিত। জনৈক নীলকর সাহেব ভৈরব নদীতে বাঁধ দিলেন যার ফলে দ্রুত শ্যাওলা পরিপূর্ণ জলভূমিতে পরিণত হল। ‘a filthy floating morass on the edges as choked with weeds and mud.'(Report Sanitary Commission 1888) ১৮৭১-৭২ এ ম্যালেরিয়া গ্রামাঞ্চলে তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছিল এবং এর কারণ খুঁজতে গিয়ে ডঃ জ্যাকসন মন্তব্য করেছেন কৃষি ও কৃষকের জীবনে সুখ ও স্বস্তি আনার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সুপেয় পানীয় জল এবং জলসেচ।

এর অভাব সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় দারুণভাবে ছিল, বৃষ্টির জলই ছিল একমাত্র সুপেয় পানীয় জল। গ্রামাঞ্চলে সেদিন মহামারী লেগেই থাকত গ্রামের পর গ্রাম কলেরা বসন্ত রোগে শেষ হয়ে যেত। বারবার বন্যা জলোচ্ছ্বাস ঝড় মহামারী রুটিনমাফিক সুন্দরবনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু তা সত্ত্বেও জমির উর্বরতা, বেশি জমি পাবার লোভ নিশ্চিত চাষের সুযোগ চাষিদের উৎসাহিত করেছিল সুন্দরবনের জমি উদ্ধার করার ব্যাপারে। সেন্সাস রিপোর্টগুলিতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকাতে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছিল উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে।

২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার থানাগুলিতে ১৮৯১-১৯০১ সালের মধ্যে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে ২৪.২% এবং এক দশক পূর্বেও এই বৃদ্ধি ছিল ৬.৯ শতাংশ। খুলনা জেলার ক্ষেত্রে এ সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে- জঙ্গলকে দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রচুর কৃষিযোগ্য ভূমি বের করা হয়েছে। ১৮৭২-৮১ এর মধ্যে মরেল সাহেবের জমিদারি খুলনার পূর্বপ্রান্তে বাগেরহাট এলাকায় উঠিত করা হয়েছে এবং প্রচুর জনবসতি লক্ষ করা যাচ্ছে। খুলনার জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে ১৮৯১-১৯০১ এর মধ্যে মাত্র ৬.৪ শতাংশ কিন্তু একমাত্র পাইকগাছা থানাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে ৪৯.৭ শতাংশ এবং এবং এই থানার সব এলাকার জঙ্গল তখন পরিষ্কার করা হচ্ছিল। জমির উর্বরতার জন্য একজন চাষী এক লাঙলে ১৫/২০ বিঘা জমি চাষবাস করতে পারত অন্যত্র একটা লাঙলে ১০ বিঘার বেশি করা সম্ভব হত না। এছাড়া দূরের চাষিরা বর্ষার শুরুতে সুন্দরবনের জমিচাষ করে অন্য এলাকায় গিয়ে নিজেদের জমি চাষবাস করতে পারত।