০৭:০১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
পোল্যান্ডের বনে বিরল কালো নেকড়ের ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য, সংরক্ষণ ও সহাবস্থানের বিতর্ক নতুন করে শিশিতে বন্দি সৌন্দর্যের মোহ: পরীক্ষাহীন পেপটাইড ইনজেকশনের বিপজ্জনক উত্থান তুরস্কের দাবি: আক্কুয়ু পারমাণবিক প্রকল্পে রাশিয়ার নতুন ৯ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৬) শাওমির ১৭ আল্ট্রা ‘লাইকা এডিশন’: স্মার্টফোনে ফিরছে ম্যানুয়াল জুম রিং একাত্তরেও উৎসবের রাজকীয় গ্ল্যামার, লাল শাড়িতে নতুন সংজ্ঞা রচনা রেখার ইউক্রেনের দাবি: রাশিয়ার ওরেনবুর্গে বড় গ্যাস প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ড্রোন হামলা দীপু চন্দ্র দাস হত্যাসহ নির্যাতনের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হিন্দু মহাজোটের মানববন্ধন শৈত্যপ্রবাহে কাঁপছে বাংলাদেশ, ঢাকাসহ সারাদেশে বেড়েছে শীতের দাপট জিয়ার কবর জিয়ারত করলেন তারেক রহমান

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
  • 39

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়িতে বিধুভূষণ ভট্টাচার্য নামে আমাদের ক্লাসে একজন নতুন শিক্ষক আসিলেন। তিনি এত সুন্দর করিয়া পড়াইতেন। গ্রামার ও ব্যাকরণের নিয়মগুলি তিনি বোর্ডে ছবি আঁকিয়া পানির মতো বুঝাইয়া দিতেন। ইংরেজিতে আমি খুব কাঁচা ছিলাম। মাসে দুই টাকা মাত্র বেতন লইয়া তিনি আমাকে প্রাইভেট পড়াইতে রাজি হইয়াছিলেন। স্কুলের ছুটি হইলে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁহার বাসায় যাইয়া পড়াশুনা করিতাম।

তখনকার দিনে অনেক হিজিবিজি কবিতা লিখিয়া তাঁহাকে দেখাইতাম। তিনি পড়িয়া খুব তারিফ করিতেন। বার্ষিক পরীক্ষা দিয়া আমি প্রমোশন পাইয়া ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠিলাম। আমার চাচাতো ভাই নেহাজউদ্দীন পাশ করিতে পারিল না। এই ফেল করিবার ফলে সে স্কুলে আসা বন্ধ করিল। তাহাকে স্কুলে আসিবার জন্য তাহার পিতাও তেমন আগ্রহ দেখাইলেন না। আমার চাচাতো ভাইটি যদিও পড়াশুনা আর করিল না, উপস্থিত বুদ্ধির ব্যাপারে সে চিরকালই আমাকে পরাজিত করিত। মুখে-মুখে হিসাব করিতে তাহার মতো আমাদের গাঁয়ে একজনও ছিল না।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠিলেই আমাদের বাংলা পড়াইতে আসিলেন বাবু যোগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়। কথাবার্তায় সামান্য চট্টগ্রামের টান তাঁহার ছিল। কিন্তু বাংলা পড়াইতে যাইয়া বাংলা সাহিত্যের প্রতি তিনি তাঁর ছাত্রদের মনে একটি গভীর অনুরাগ জাগাইয়া তুলিতে পারিতেন। ব্যাকরণের কঠিন তত্ত্বগুলি তিনি পানির মতো করিয়া বুঝাইয়া দিতেন। তাঁহার ক্লাসে পড়িয়া আমি বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হইয়া পড়িতাম। পণ্ডিত মহাশয়ের এক ভাই আমার সহপাঠী ছিল। ছুটির দিনে পণ্ডিত মহাশয়ের বাসায় যাইয়া আমি পড়াশুনা করিতাম। অবসর সময় তাঁহার বাড়ির আমগাছে উঠিয়া পাকা আম পাড়িতাম, জামরুল গাছে উঠিয়া এ-ডাল ও-ডাল ভাঙিতাম। পণ্ডিত মহাশয় কিছুই বলিতেন না।

আমার সুদীর্ঘ জীবনে যত ভালো ভালো শিক্ষক দেখিয়াছি এই পণ্ডিত মহাশয় তাঁহাদের অন্যতম। অনেক বিদ্যা তিনি জানিতেন না। কিন্তু যেটুকু তিনি জানিতেন তাহা তিনি ছাত্রদের মনে ভরিয়া দিতে পারিতেন।

এই পণ্ডিত মহাশয়ের অতিথি হইয়া আসিলেন ক্ষীরোদবাবু। ইনি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাব-শিষ্য ছিলেন।

খবর পাইয়া একদিন এই কবির সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। আমার জীবনে একজন কবিদর্শন এই প্রথম। মনে মনে তাঁহার প্রতি যেসব কল্পনা আরোপ করিয়াছিলাম তাহাতে আমি ভাবিয়াছিলাম একজন সত্যকার কবি যেন কেমন হইবেন। তাঁর লম্বা চুল থাকিবে।

ক্ষণেক কাঁদিবেন, ক্ষণেক হাসিবেন। কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য হইলাম। আমাদের শিক্ষক মহাশয়দের মতোই তিনি একজন সাধারণ মানুষ। কবি বলিয়া কে চিনিবে? আমাকে তিনি অতি আদরের সঙ্গে গ্রহণ করিলেন। আমার কবিতার খাতাখানি পড়িয়া স্থানে স্থানে সংশোধন করিয়া দিলেন। ইহার পর প্রায়ই পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম।

 

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

পোল্যান্ডের বনে বিরল কালো নেকড়ের ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য, সংরক্ষণ ও সহাবস্থানের বিতর্ক নতুন করে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২১)

১১:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

পঞ্চম শ্রেণীতে পড়িতে বিধুভূষণ ভট্টাচার্য নামে আমাদের ক্লাসে একজন নতুন শিক্ষক আসিলেন। তিনি এত সুন্দর করিয়া পড়াইতেন। গ্রামার ও ব্যাকরণের নিয়মগুলি তিনি বোর্ডে ছবি আঁকিয়া পানির মতো বুঝাইয়া দিতেন। ইংরেজিতে আমি খুব কাঁচা ছিলাম। মাসে দুই টাকা মাত্র বেতন লইয়া তিনি আমাকে প্রাইভেট পড়াইতে রাজি হইয়াছিলেন। স্কুলের ছুটি হইলে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁহার বাসায় যাইয়া পড়াশুনা করিতাম।

তখনকার দিনে অনেক হিজিবিজি কবিতা লিখিয়া তাঁহাকে দেখাইতাম। তিনি পড়িয়া খুব তারিফ করিতেন। বার্ষিক পরীক্ষা দিয়া আমি প্রমোশন পাইয়া ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠিলাম। আমার চাচাতো ভাই নেহাজউদ্দীন পাশ করিতে পারিল না। এই ফেল করিবার ফলে সে স্কুলে আসা বন্ধ করিল। তাহাকে স্কুলে আসিবার জন্য তাহার পিতাও তেমন আগ্রহ দেখাইলেন না। আমার চাচাতো ভাইটি যদিও পড়াশুনা আর করিল না, উপস্থিত বুদ্ধির ব্যাপারে সে চিরকালই আমাকে পরাজিত করিত। মুখে-মুখে হিসাব করিতে তাহার মতো আমাদের গাঁয়ে একজনও ছিল না।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠিলেই আমাদের বাংলা পড়াইতে আসিলেন বাবু যোগেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়। কথাবার্তায় সামান্য চট্টগ্রামের টান তাঁহার ছিল। কিন্তু বাংলা পড়াইতে যাইয়া বাংলা সাহিত্যের প্রতি তিনি তাঁর ছাত্রদের মনে একটি গভীর অনুরাগ জাগাইয়া তুলিতে পারিতেন। ব্যাকরণের কঠিন তত্ত্বগুলি তিনি পানির মতো করিয়া বুঝাইয়া দিতেন। তাঁহার ক্লাসে পড়িয়া আমি বাংলা সাহিত্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হইয়া পড়িতাম। পণ্ডিত মহাশয়ের এক ভাই আমার সহপাঠী ছিল। ছুটির দিনে পণ্ডিত মহাশয়ের বাসায় যাইয়া আমি পড়াশুনা করিতাম। অবসর সময় তাঁহার বাড়ির আমগাছে উঠিয়া পাকা আম পাড়িতাম, জামরুল গাছে উঠিয়া এ-ডাল ও-ডাল ভাঙিতাম। পণ্ডিত মহাশয় কিছুই বলিতেন না।

আমার সুদীর্ঘ জীবনে যত ভালো ভালো শিক্ষক দেখিয়াছি এই পণ্ডিত মহাশয় তাঁহাদের অন্যতম। অনেক বিদ্যা তিনি জানিতেন না। কিন্তু যেটুকু তিনি জানিতেন তাহা তিনি ছাত্রদের মনে ভরিয়া দিতে পারিতেন।

এই পণ্ডিত মহাশয়ের অতিথি হইয়া আসিলেন ক্ষীরোদবাবু। ইনি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাব-শিষ্য ছিলেন।

খবর পাইয়া একদিন এই কবির সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। আমার জীবনে একজন কবিদর্শন এই প্রথম। মনে মনে তাঁহার প্রতি যেসব কল্পনা আরোপ করিয়াছিলাম তাহাতে আমি ভাবিয়াছিলাম একজন সত্যকার কবি যেন কেমন হইবেন। তাঁর লম্বা চুল থাকিবে।

ক্ষণেক কাঁদিবেন, ক্ষণেক হাসিবেন। কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য হইলাম। আমাদের শিক্ষক মহাশয়দের মতোই তিনি একজন সাধারণ মানুষ। কবি বলিয়া কে চিনিবে? আমাকে তিনি অতি আদরের সঙ্গে গ্রহণ করিলেন। আমার কবিতার খাতাখানি পড়িয়া স্থানে স্থানে সংশোধন করিয়া দিলেন। ইহার পর প্রায়ই পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম।

 

চলবে…