সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
লাল সমুদ্রের ঢেউয়ে পরিপূর্ণ গ্যালারি, উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে ফরচুন বরিশালের সমর্থকরা। এর মাঝে নীল রঙের জোয়ার তোলে খাওয়াজা নাফায় ও পরভেজ হোসেন ইমন, দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে চিটাগাং কিংসকে দিয়েছেন শক্তিশালী স্কোর। জবাবে তামিম ইকবালের বিস্ফোরক ইনিংস শুরুটা জমিয়ে তুললেও পরে কাইল মেয়ার্সের ঝোড়ো পারফরম্যান্স দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মোহাম্মদ নবি দ্রুত ফিরে যাওয়ায় বরিশালের জয়ে শঙ্কা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত রিশাদ হোসেন নায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হন। তাঁর দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে এক রোমাঞ্চকর জয় পায় বরিশাল, আর সেই সঙ্গে আসে শিরোপা উৎসবের মুহূর্ত।
শুক্রবার, শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ফরচুন বরিশাল তিন উইকেটের ব্যবধানে চিটাগাং কিংসকে পরাজিত করে। এর ফলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিপিএলে শিরোপা ঘরে তুলল বরিশাল। বারো বছরের বিরতি শেষে বিপিএলে ফিরে চিটাগাং কিংস আবারও শিরোপার খুব কাছে গিয়েও ব্যর্থ হলো। ২০১৩ আসরে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের বিপক্ষে ফাইনালে হারার পর টানা আটটি আসর তারা অংশগ্রহণ করেনি।
টস জিতে বরিশাল প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। চিটাগাং কিংসের দুই ওপেনার পরভেজ হোসেন ইমন ও খাওয়াজা নাফায় দুর্দান্ত সূচনা এনে দেন। দুজনেই অর্ধশতক তুলে নিয়ে একটি রেকর্ড গড়েন—বিপিএল ফাইনালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। এরপর গ্রাহাম ক্লার্কের ছোট কিন্তু গতিময় ইনিংসে চিটাগাং পৌঁছে যায় ১৯৪ রানে, ৩ উইকেট হারিয়ে।
জবাবে ফরচুন বরিশালের ইনিংস শুরু হয় তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে। তামিম ইকবাল চার-ছক্কায় বৃষ্টি ঝরাতে থাকেন, আর তৌহিদ হৃদয় তাঁকে সঙ্গ দেন। পাওয়ারপ্লেতেই দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫৭ রান, যেটির বড় অংশই আসে তামিমের ব্যাট থেকে। নবম ওভারে আরাফাত সানির বলে ছক্কা মেরে তিনি মাত্র ২৪ বলে ফিফটি স্পর্শ করেন। তবে ফিফটির পরই থেমে যায় তাঁর ইনিংস—২৯ বলে ৫৪ রান করে (নয়টি চার ও একটি ছক্কা) বিদায় নেন তিনি।
তামিমের পর একই ওভারে আউট হন ডেভিড মালান। তৌহিদ হৃদয় অবদান রাখার চেষ্টা করলেও ২৮ বলে ৩২ রান করে ফিরে যান। মধ্যপর্যায়ে কাইল মেয়ার্স ও মুশফিকুর রহিমের ১৪ বলে ৩৪ রানের ঝোড়ো জুটি চাপ কিছুটা কমায়। মুশফিক ৯ বলে ১৬ রান (তিনটি চার) করে ফিরলেও মেয়ার্স ব্যাট চালিয়ে যেতে থাকেন।
মেয়ার্সের সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ২৯ বলে ৪২ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন। মনে হচ্ছিল তারা সহজেই দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু ১৮তম ওভারে চিটাগাংয়ের পেসার শরিফুল ইসলাম নাটকীয়ভাবে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন, টানা ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন মেয়ার্স ও মাহমুদুল্লাহকে। শেষ ১২ বলে বরিশালের দরকার ছিল ২০ রান, রোমাঞ্চ তখন তুঙ্গে।
১৯তম ওভারে রিশাদ হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ছক্কা মেরে ১২ রান আদায় করেন। শেষ ওভারে দরকার ছিল ৮ রান। ১৯তম ওভারের শেষ বলে মোহাম্মদ নবি আউট হওয়ায় শেষ কয়েকটি ডেলিভারির চাপ বাড়ে। কিন্তু রিশাদ প্রথম বলেই ছক্কা মেরে সমতায় নিয়ে আসেন স্কোর, পরের বলে এক রান নিয়ে নিশ্চিত করেন দলের জয়। মাত্র ৬ বলে ১৮ রানে অপরাজিত ছিলেন রিশাদ, যার ইনিংসে ছিল দুটি ছক্কা। শরিফুল ইসলাম ৪ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে চারটি উইকেট দখল করে চিটাগাংয়ের সেরা বোলার হন।
এর আগে ব্যাট হাতে চিটাগাং কিংসের শুরু ছিল আক্রমণাত্মক। নাফায় থিতু থাকলেও ইমন শুরু থেকেই বরিশালের বোলারদের আক্রমণ করেন। পরে নাফায় নিজেও খোলসে বেরিয়ে আসেন। পাওয়ারপ্লেতে ৫৭ রান তোলে তারা বিনা উইকেটে। ১১তম ওভারেই চিটাগাং পেরিয়ে যায় একশোর ঘর। ১৩তম ওভারে এসে অবশেষে ভাঙে তাদের ১২১ রানের রেকর্ড উদ্বোধনী জুটি—যা বিপিএল ফাইনালের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। আগের সেরা ছিল ৭৬ রান, তামিম ইকবাল ও মেহেদি হাসান গড়েছিলেন গত আসরের ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে।
ফর্মের চূড়ায় থাকা নাফায় ৪৪ বলে ৬৬ রান করেন, যাতে ছিল সাতটি চার ও তিনটি ছক্কা। তিনি ফিরে যাওয়ার পর গ্রাহাম ক্লার্ক ঝড় তোলেন, ২৩ বলে ৪৪ রান করেন (দুটি চার ও তিনটি ছক্কা)। ইমন অপরাজিত ছিলেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত, তবে শেষ ওভারে মাত্র ৬ রান তুলতে পারে চিটাগাং এবং হারায় দুটি উইকেট। ইমন ৪৯ বলে অপরাজিত ৭৮ রান করেন, যেখানে ছিল ছয়টি চার ও চারটি ছক্কা। বরিশালের পক্ষে একটি করে উইকেট নেন মোহাম্মদ আলী ও এবাদত হোসেন। বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম মাত্র ২ ওভারে ৪০ রান দিয়ে বিধ্বস্ত হন।
এই জয়ে বিপিএলে টানা দুইবার শিরোপা জয়ের তালিকায় তামিম ইকবাল নাম লেখালেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও ইমরুল কায়েসের পাশে। আরেকবার শিরোপার খুব কাছে গিয়েও চিটাগাং কিংসকে খালি হাতে ফিরতে হলো, বিপরীতে ফরচুন বরিশাল তাদের আধিপত্য ধরে রেখে উদযাপন করল মর্যাদার শিরোপা।
Leave a Reply