০৩:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
স্লো-লিভিং: শহরের ছোট বদলে বড় স্থিতি ঢাকায় দিনের আলোয় গুলিতে নিহত একজন স্ট্রিমিং যুগে হলিউড: নাম নয়, কারিগরি ও ধারাবাহিকতা শিক্ষায় সরলীকৃত চীনা: অনমনীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজন বাস্তব সংস্কার মাইক্রো-ড্রামা: ছোট পর্বে পূর্ণ কাহিনি সমাধিক্ষেত্রের পদচিহ্নে ইতিহাস ও কল্পনার ছায়া যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উঠছে ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ — ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা ঢাল নাকি এক মহাকল্পনার সাম্রাজ্য? তানজিন তিশা: আলো, প্রতিভা আর আত্মনির্ভরতার দীপ্ত গল্প জাপানের ট্রেডিং হাউসগুলো ট্রাম্পের শুল্ক চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলছে অ্যানথ্রপিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবসা: ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধি ও উদ্বেগ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 22

ধীরেনদের বাসায়

ধীরেনদের বাড়িতে বাংলা বই-এর খুব ভালো একটি লাইব্রেরি ছিল। এখানে হিতবাদী প্রকাশিত একখানা রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী ছিল। পড়ার অবসরে সেই পুস্তকখানা আমি পড়িয়া শেষ করিলাম। তারপর মোহিতচন্দ্র সম্পাদিত রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী পড়িলাম। সব বুঝিতে পারিতাম না। কিন্তু ভালো লাগিত। ধীরেনের দাদারা ভালো কবিতা আবৃত্তি করিতে পারিতেন, বিশেষ করিয়া ধীরেনের বড় দাদা শ্রীইন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের বই হইতে আবৃত্তি করিতেন। পুরাতন ভৃত্য, বন্ধু, সোনার তরী, দুই বিঘা জমি প্রভৃতি কবিতাগুলি তিনি অতি সুন্দরভাবে আবৃত্তি করিতেন। মাঝে মাঝে থিয়েটারের বই হইতে অংশবিশেষ য্যাক্ট করিয়া শুনাইতেন। সেই পড়ার কোনো তুলনা মেলে না। মাঝে মাঝে তিনি শেস্পিয়ারের নাটক হইতেও অংশবিশেষ পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি খুব রাগী মানুষ ছিলেন। কাছে ভিড়িবার উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি যখন কবিতা বা নাটকের অংশবিশেষ আবৃত্তি করিতেন তখন তিনি আমার অন্তরের অন্তরঙ্গ হইয়া পড়িতেন।

বাড়ি যাইয়া পদ্মার তীরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার সেই আবৃত্তির অংশগুলি অনুকরণ করিতাম। সঙ্গে বই থাকিত না। ইচ্ছামতো বানাইয়া বানাইয়া ইন্দ্রদাদার মতো আবৃত্তি করিতে চেষ্টা করিতাম। ইহাতে আমার বাংলা উচ্চারণের সমস্ত জড়তা কাটিয়া গেল।

আমাদের পড়াশুনা শেষ হইলে ধীরেনের খুড়াতো ভাই রাসমোহন দাদা নভেল পড়িয়া শুনাইতেন। মন্ত্রশক্তি, দিদি, শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ প্রভৃতি বহু বই আমরা এইভাবে রাত জাগিয়া উপভোগ করিয়াছিলাম।

ধীরেনের বাবা খুব অল্প খরচে সংসার চালাইবার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি প্রতি সপ্তাহের খরচের জন্য একটি নির্দিষ্ট অর্থ ধীরেনের মায়ের হাতে দিতেন। মা আবার সেখান হইতে কিছু বাঁচাইয়া জমা করিতেন। প্রতি সপ্তাহে কতটা কেরোসিন তৈল ব্যবহার হইবে তাহা তিনি পরিমাণ করিয়া লইতেন।

ধীরেন আর তাহার দাদারা উপরতলায় থাকিত। রাসমোহন দাদা নিচের তলায় থাকিতেন। আমরা যখন অনেক রাত্রে নভেল পড়িতাম মা পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া আমাদিগকে নভেল পড়িতে দেখিয়া আমাদের হারিকেন বাতিটি নিবাইয়া দিয়া যাইতেন, তখন হয়তো নভেলের নায়িকা এমন একটি অবস্থার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, তারপর কি হইবে জানিবার জন্য আমরা নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ করিয়া আছি। মা বাতি নিবাইয়া দিলে তাঁকে দেখাইয়া দেখাইয়া আমরা শুইয়া পড়িয়া কৃত্রিম নাক ডাকাইতাম। তিনি অনেকক্ষণ আড়ালে থাকিয়া তাহা নিরীক্ষণ করিয়া উপরে চলিয়া যাইতেন। তখন আমরা ধীরে ধীরে দেয়াশলাই জ্বালাইয়া হারিকেন ধরাইতাম। তারপর রাসমোহন দাদা আবার পড়া আরম্ভ করিতেন। এইভাবে কোনো কোনো সময় আমরা সারারাত জাগিয়া নভেল পড়িতাম।

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

স্লো-লিভিং: শহরের ছোট বদলে বড় স্থিতি

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩০)

১১:০০:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

ধীরেনদের বাড়িতে বাংলা বই-এর খুব ভালো একটি লাইব্রেরি ছিল। এখানে হিতবাদী প্রকাশিত একখানা রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী ছিল। পড়ার অবসরে সেই পুস্তকখানা আমি পড়িয়া শেষ করিলাম। তারপর মোহিতচন্দ্র সম্পাদিত রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী পড়িলাম। সব বুঝিতে পারিতাম না। কিন্তু ভালো লাগিত। ধীরেনের দাদারা ভালো কবিতা আবৃত্তি করিতে পারিতেন, বিশেষ করিয়া ধীরেনের বড় দাদা শ্রীইন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের বই হইতে আবৃত্তি করিতেন। পুরাতন ভৃত্য, বন্ধু, সোনার তরী, দুই বিঘা জমি প্রভৃতি কবিতাগুলি তিনি অতি সুন্দরভাবে আবৃত্তি করিতেন। মাঝে মাঝে থিয়েটারের বই হইতে অংশবিশেষ য্যাক্ট করিয়া শুনাইতেন। সেই পড়ার কোনো তুলনা মেলে না। মাঝে মাঝে তিনি শেস্পিয়ারের নাটক হইতেও অংশবিশেষ পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি খুব রাগী মানুষ ছিলেন। কাছে ভিড়িবার উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি যখন কবিতা বা নাটকের অংশবিশেষ আবৃত্তি করিতেন তখন তিনি আমার অন্তরের অন্তরঙ্গ হইয়া পড়িতেন।

বাড়ি যাইয়া পদ্মার তীরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার সেই আবৃত্তির অংশগুলি অনুকরণ করিতাম। সঙ্গে বই থাকিত না। ইচ্ছামতো বানাইয়া বানাইয়া ইন্দ্রদাদার মতো আবৃত্তি করিতে চেষ্টা করিতাম। ইহাতে আমার বাংলা উচ্চারণের সমস্ত জড়তা কাটিয়া গেল।

আমাদের পড়াশুনা শেষ হইলে ধীরেনের খুড়াতো ভাই রাসমোহন দাদা নভেল পড়িয়া শুনাইতেন। মন্ত্রশক্তি, দিদি, শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ প্রভৃতি বহু বই আমরা এইভাবে রাত জাগিয়া উপভোগ করিয়াছিলাম।

ধীরেনের বাবা খুব অল্প খরচে সংসার চালাইবার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি প্রতি সপ্তাহের খরচের জন্য একটি নির্দিষ্ট অর্থ ধীরেনের মায়ের হাতে দিতেন। মা আবার সেখান হইতে কিছু বাঁচাইয়া জমা করিতেন। প্রতি সপ্তাহে কতটা কেরোসিন তৈল ব্যবহার হইবে তাহা তিনি পরিমাণ করিয়া লইতেন।

ধীরেন আর তাহার দাদারা উপরতলায় থাকিত। রাসমোহন দাদা নিচের তলায় থাকিতেন। আমরা যখন অনেক রাত্রে নভেল পড়িতাম মা পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া আমাদিগকে নভেল পড়িতে দেখিয়া আমাদের হারিকেন বাতিটি নিবাইয়া দিয়া যাইতেন, তখন হয়তো নভেলের নায়িকা এমন একটি অবস্থার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, তারপর কি হইবে জানিবার জন্য আমরা নিশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ করিয়া আছি। মা বাতি নিবাইয়া দিলে তাঁকে দেখাইয়া দেখাইয়া আমরা শুইয়া পড়িয়া কৃত্রিম নাক ডাকাইতাম। তিনি অনেকক্ষণ আড়ালে থাকিয়া তাহা নিরীক্ষণ করিয়া উপরে চলিয়া যাইতেন। তখন আমরা ধীরে ধীরে দেয়াশলাই জ্বালাইয়া হারিকেন ধরাইতাম। তারপর রাসমোহন দাদা আবার পড়া আরম্ভ করিতেন। এইভাবে কোনো কোনো সময় আমরা সারারাত জাগিয়া নভেল পড়িতাম।

চলবে…