(ইউএনবি থেকে অনূদিত)
ঢাকা, সংকীর্ণ গলি ও ব্যস্ত সড়ক-নালার শহর, এখনো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর অন্যতম। বাসিন্দারা ধোঁয়ার মধ্যে আটকে পড়েছেন এবং শুদ্ধ বাতাস শ্বাস নেওয়ার দিনগুলো স্মৃতিতে ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কতায় জানা যাচ্ছে, মারাত্মক দূষণের কারণে জীবনহানিকর রোগের ঝুঁকি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকার ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নেয়া ভার
ঢাকার বায়ু শত শত ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেল, সিএনজি চালিত অটো-রিকশা এবং ডাবল-ডেকার বাস থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় অতিরিক্ত দূষিত। পাশাপাশি চলমান নির্মাণ কাজ, ইঁটের চুল্লি ও শিল্প কারখানার নির্গমনও বায়ুর মানকে আরও খারাপ করে তুলছে।
সীমান্ত পারাপার দূষণের সমস্যা
প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা দূষণ ঢাকার বিষাক্ত বায়ুর সাথে মিশে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মোট বায়ু দূষণের প্রায় ৩৫% অংশ বহিরাগত উৎস থেকে আসে, কিন্তু এখনও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ।
ঢাকার ইতিহাস ও যানবাহনের অবস্থা
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনে, রাজধানীর যানবাহনের গড় গতি মাত্র ৪.৫ কিমি/ঘন্টা, যা প্রায় হাঁটার গতির সমান। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) অনুযায়ী, ঢাকা নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ঢাকা একটি AQI স্কোর ২০৯-এর অবস্থানে পৌঁছেছিল, যা বাসিন্দাদের জন্য “অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর” হিসাবে চিহ্নিত।
দূষণের মাত্রা ও পরিসংখ্যান
সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (CAPS) এর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বর মাসে দূষণের মাত্রা গত নয় বছরে সর্বোচ্চ ছিল। জানুয়ারিতে এই মাত্রা আরো বেড়ে দশকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়, অনেকদিন ধরে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, যা “বিপজ্জনক” হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ।
সীমান্ত পারাপার বায়ু দূষণ: কী তা?
ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আবদুস সালাম ব্যাখ্যা করেন, “সীমান্ত পারাপার বায়ু দূষণ বলতে সেই দূষকগুলি বোঝায় যা দেশের সীমানা পেরিয়ে ঢুকে আসে। হিমালয়সহ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও চীন থেকে আসা দূষণ আমাদের বায়ুর মানে গুরুতর প্রভাব ফেলে।” শীতকালে প্রতিবেশী দেশ থেকে দূষণ ঢাকায় প্রবেশ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, কারণ সূক্ষ্ম কণাগুলি বায়ুতে দীর্ঘস্থায়ী থাকে এবং দূরত্ব অতিক্রম করে।
পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে অবহেলা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
ঢাকার দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে পুরোনো যানবাহন চিহ্নিত। সিএনজি চালিত যন্ত্রপাতি, পুরোনো ব্যক্তিগত গাড়ি ও ভারী যানবাহন থেকে নির্গত কালো ও বাদামী কার্বন বায়ুর মান আরও খারাপ করে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য যানবাহন নির্গমনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পুরোনো যানবাহন প্রতিস্থাপন ও পরিষ্কার জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আছে।
সমাধানের উপায় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
ডঃ সালাম বলেন, “বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের নিজস্ব নীতিমালা উন্নত করে দূষণ কমাতে হবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে তাদের নির্গমন নিয়ন্ত্রণে আনার আহ্বান জানাতে হবে।” পরিবেশ আইন প্রয়োগ, নগর পরিকল্পনার উন্নয়ন ও শিল্প কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
অঞ্চলীয় সহযোগিতা খুবই জরুরি। পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও চীনকে একত্রে নিয়ে “কাঠমান্ডু রোডম্যাপ” কার্যকর করা উচিত, যাতে দূষণ কমানো যায়। অধ্যাপক আইনুন নিশাতও পরামর্শ দেন, “বিভিন্ন দেশের মধ্যে ডেটা শেয়ারিং ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।”
ঢাকার দূষণের মূল কারণ ও প্রভাব
ঢাকার মারাত্মক দূষণের পেছনে যানবাহনের নির্গমন, শিল্প দূষণ ও নির্মাণ ধুলা প্রধান। জ্বালানি দহন অদক্ষ যন্ত্রপাতি থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়, যা নতুন যানবাহনের তুলনায় অনেক বেশি দূষণ সৃষ্টি করে। ভারী ও ওভারলোডেড ট্রাকগুলো নির্মাণ প্রকল্পের ধুলো বাড়িয়ে দেয়, আর গাজীপুরের ইটের চুল্লি থেকেও দূষণের মাত্রা বাড়ে।
স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ম্যাসাচুসেটস ভিত্তিক হেলথ এফেক্টস ইনস্টিটিউট অনুযায়ী, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রাক-মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। স্বল্প সময়ের জন্য দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে হাঁপানি, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হতে পারে, আর দীর্ঘমেয়াদে ক্রনিক শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ইউনিসেফের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরে ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু প্রতিদিন অস্বাস্থ্যকর বাতাস শ্বাস নিচ্ছে, যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ডঃ সালাম আরও জানান, “প্রতি বছর ১৫০,০০০ থেকে ২০০,০০০ মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে, এবং এর আর্থিক ক্ষতি দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫%—প্রায় ১.৬ ট্রিলিয়ন টাকা।” তিনি সতর্ক করেন, “যদি আমরা এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তবে দূষণ সারা প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে।”
উপসংহার
ঢাকার বায়ু দূষণ একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যা, যার মূল কারণগুলো হচ্ছে যানবাহন নির্গমন, শিল্প দূষণ এবং নির্মাণ ধুলা। সরকারের উদাসীনতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাবে এই সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কার্যকর নীতিমালা, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই দূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব।
Leave a Reply