ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ জনের মধ্যে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে ওই বাসের এক নারী যাত্রীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার কথা হয়েছে।
ডাকাতির ঘটনার সপ্তাহখানেক পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে একটি ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হয়, যেখানে বাসটির যাত্রী পরিচয় দেওয়া একজন নারীকে বলতে শোনা যায় যে, তার সঙ্গে শ্লীলতাহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ভিডিও পাঠানোর পাশাপাশি ওই নারী যাত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ঠিকানা প্রদান করে বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে “অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার জন্য বিশেষ অনুরোধ” জানানো হয়।
এরপর ওই নারীর বক্তব্য তুলে ধরে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ‘ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি’ বলে খবর প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
ওই দিন কী ঘটেছিল–– জানতে চাইলে বাসটির ওই নারী যাত্রী বলেন, ঢাকা থেকে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে তারা ছয় জন বাসে ওঠেন। বাসে ওঠার পর তিনি তার ভাইয়ের পাশে বসেছিলেন।
তার বর্ণনায়, “সেদিন ডাকাতি হয়েছিল, ছিনতাই হয়েছিল। আমাদের জিনিসপত্র যা ছিল সকলেরই সব কিছু নিয়ে নেয় ডাকাতরা। অনেককে মারধর করে।”
ডাকাতরা ৯ জন ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাসের সব সিটে যাত্রী ছিল। ডাকাতদের কয়েকজনও যাত্রী সেজে বসেছিল আগে থেকেই। নারী যাত্রীর সংখ্যা ছিল ছয়-সাত জনের মতো।
তিনি বলেন, যখন ওরা (ডাকাতরা) জিনিসপত্র নেয় তখন গায়ে হাত দেয় মেয়েদের। তবে যৌন হয়রানি করেনি বলে তিনি দাবি করেন।
গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।বাসটি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতদের দখলে ছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, বাসটির অন্য একাধিক যাত্রী।
ঘটনার দুই দিন পর দুই জন যাত্রী বিবিসি বাংলাকে অভিযোগ করেন, বাসটিতে অন্তত একজনকে ধর্ষণ করা হয়েছে সেই রাতে।
তবে সেই প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছিল, বাসের কেউ ধর্ষণের অভিযোগ করেনি।
ঘটনার তিন দিন পর ২১শে ফেব্রুয়ারি মির্জাপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। বাসের যাত্রী ওমর আলী বাদী হয়ে আট থেকে নয়জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের মধ্যে তিনজন অভিযোগের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে সেই বাস ডাকাতির অভিযোগ উঠেছে
ঘটনার ১০ দিনের মাথায় বাসটির ওই নারী যাত্রীর সঙ্গে বিবিসি বাংলার কথা হয়। তিনি বলেন, ওই বাসের যাত্রীদের মধ্যে একজন মহিলা মিডিয়ায় ধর্ষণের কথা বলেছে।
তিনি আরও বলেন, “ওই মহিলাটা মিডিয়ায় বলছিল। সে ছয় সিট সামনে ছিল আমাদের। তাহলে মহিলাটা কেমন করে দেখলো? বলুক তো ওই মহিলাটা।”
“ডাকাতরা সব যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। চাকু ও পিস্তল ধরে। হাতেও মারে। অনেকের শরীরে হাত দিয়ে চেক করে টাকা বা সোনা লুকানো আছে কিনা।”
ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর বাসের অন্য নারী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কথা তো বলতেই দেয়নি ওরা (ডাকাতরা)। যতক্ষণ ওরা ছিল আমাদের কথা বলতে দেয়নি, মাথা তুলতে দেয়নি।”
ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পরে “কার কথা কে শোনে! সকলের তো টেনশন একটা। আতঙ্কে ছিলাম আমরা সকলে।”
তবে নারীদের যৌন হয়রানির “কোনো কথাই শুনতে পাইনি” বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাসের অন্য নারী যাত্রীদের সঙ্গে তার কথা হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন।
ওই নারীর দাবি, বাসে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। নারীদের শ্লীলতাহানীর যে অভিযোগ উঠেছে সেরকম কিছুও ঘটেনি।
বরং ধর্ষণের প্রসঙ্গ ওঠায় সমাজের অনেকেই তাকে ধর্ষণের শিকার নারী মনে করে অসম্মানের চোখে দেখছে বলে তিনি মনে করছেন।
তিনি বলেন, সে কারণেই তিনি এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
রাজশাহীগামী সেই বাস
পুলিশের সঙ্গে আলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, “যেটা সত্য সেটাই জানাইসি। ছিনতাই হইসে এটাই বলসি। মোবাইল নিসে, কী কী হারাইসে সেটাই বলসি।”
ওই নারী জানান, ডাকাতরা তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ২৫ হাজার টাকা, চার ভরির মতো রুপা নিয়ে গেছে। এক যাত্রীর বুকে ডাকাতরা ছুরি মেরেছিল বলেও তিনি জানান।
নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন বলেও জানান ওই নারী।
তিনি উল্লেখ করেন, মামলা হওয়ার পর টাঙ্গাইল থেকে পুলিশ বাসায় এসে কথা বলে গেছে। তদের কাউকেই তিনি ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির কথা বলেননি।
নাটোরের বড়াইগ্রাম থানা
পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত অনুমানিক একটা ৪৫ মিনিট থেকে রাত প্রায় চারটা পর্যন্ত ঢাকা- টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে একটি ডাকাতি সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানায় একটি ডাকাতিসহ শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করা হয়।
এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এছাড়া এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে মির্জাপুর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. আতিকুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে টাঙ্গাইলের পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।
এছাড়াও নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলামকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে জেলা পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়।
যৌন হয়রানির প্রতীকী ছবি
ঘটনার দুই দিন পর বাসটির যাত্রী সোহাগ হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ডাকাতি যখন চলছিল, তখন তারা কথা বলতে পারছিলেন না, মাথা উঁচু করতে পারছিলেন না, চোখ খুলতে পারছিলেন না। শুধুই বাসের দুই নারী যাত্রীর চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনছিলেন।
তিনি বলছিলেন, বাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন দুইজন নারী।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply