মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:২৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

“বোকা” দিলীপ দাস ও জ্যোতি বসুর একটি বাক্য

  • Update Time : রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ৮.০০ এএম

 স্বদেশ রায়

সাভারের হিন্দু স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলীপ দাসকে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই নিউজ আপলোড হবার ১৫ মিনিটের মধ্যে মন্তব্য করেছেন, আরেকজন হিন্দু ভদ্রলোক, তিনি লিখেছেন, “ দিলীপ দাস বোকা, তা না হলে একজন হিন্দু হয়ে কেন এ দেশে স্বর্ণ ব্যবসা করতে যায়”।

এই একই সপ্তাহে বরগুনার মন্টু দাসের লাশ বাড়ির পেছনের ঝোঁপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মন্টু দাসের অপরাধ তিনি তার সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া কন্যা ধর্ষিতা হবার পরে বিচার চেয়েছিলেন আদালতে।

মন্টু দাসের এই মৃত্যুর পরে দেশের প্রথম শ্রেণীর অধিকাংশ মিডিয়া আউটলেটগুলো কোন নিউজ ছাপেনি। এমনকি মন্টু দাসের এই মৃত্যুর খবরও এসেছে খুব কম মিডিয়া আউটলেটে। দেশে যখন ধর্ষন বিরোধী আন্দোলন চলছে, সে সময়ে মন্টু দাসের কন্যার কথা কেউ রাজপথে উল্লেখ করছে না। এমনকি ধর্ষনের বিচার চেয়ে এভাবে নির্মম হত্যার শিকার হবার পরেও মন্টু দাসের মৃত্যু নিয়ে কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতা কোন বিবৃতি দেননি।

বাংলাদেশের এবার হিন্দু নির্যাতন নিয়ে বাস্তবে কোন মিডিয়া আউটলেট বা কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা খুব কোন শক্ত অবস্থান নিতে পারছেন না। কেন এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হিন্দুদের ওপর এ নির্যাতনের পরে- তা সত্যিই অনেক বড় প্রশ্নের জম্ম দিচ্ছে।

বাংলাদেশে এর আগে অনেক রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দুরা সে সব পট পরিবর্তনে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা এর আগে কখনও এদেশে ঘটেনি।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট-এ বাংলাদেশে সব থেকে বড় রাজনৈতকি পট- পরিবর্তন হয়। কিন্তু সে পরিবর্তনে হিন্দুরা এভাবে নিরপত্তাহীনতায় পড়েনি। খোন্দাকার মোস্তাক ও পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহন করলেও হিন্দুদের ওপর কোনরূপ নির্যাতন হয়নি। খোন্দকার মোস্তাক ও জিয়াউর রহমানের আমল মিলে বাংলাদেশের সংবিধানে অনেক পরিবর্তন হয়। তার ফলে সাংবিধানিকভাবে হিন্দুদের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে দেশের কোথাও কোন হিন্দু বাড়িতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়নি। কয়েকটি প্রফেশনে ও প্রশাসনরে কিছু প্রমোশনে একটা অলিখিত বাধা লক্ষ্য করা যেতো। কিন্তু তা সাধারণ হিন্দু সমাজের ওপর কোন প্রভাব ফেলেনি। তাছাড়া প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক দলে অনেক হিন্দুদের নেবার চেষ্টা করতেন। এমনকি ছাত্র সংগঠনেও।

এরপরে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে ওই প্রশাসনে প্রমোশনের বিষয়টি কেটে যায়। বরং একসঙ্গে অনেক প্রমোশন হবার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের ভেতর একটা আস্থা আসে। তিনি তাঁর আমলের শেষের দিকে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংখ্যাগুরুর ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেন। অষ্টম সংশোধনীতে বিচার বিভাগের ডিসেন্ট্রালাইজেশানের বিষয়টিও ছিলো। ওই সময়ে দেশের প্রতিথযশা আইনজীবিগণ এই অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই মামলা নিয়ে বিচার বিভাগকে মোটেই প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। বিচারকাজ স্বাধীনভাবে চলেছিলো। এবং সম্মানিত আপীলকারীগন সমগ্র অষ্টম সংশোধনী সংবিধানের মূল চরিত্রের সঙ্গে সাংর্ঘষিক বলে তাদের আর্গুমেন্টে তুলে ধরেছিলেন। বিচারকগনও যে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন তাও শতভাগ বলা যাবে না। তবে সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অষ্টম সংশোধনীর রাষ্ট্রধর্ম অংশটুকু বাতিল না করে বিষয়টি “সেনসেটিভ” বলে বহাল রাখেন। আর সেই থেকে বিচার বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের অংশ হয়ে  যায়। পরবর্তীতে আর কোন সরকার  এ বিষয়ে হাত দেয়নি।  এরশাদ আমলের একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢাকায় কয়েকটি হিন্দু এলাকায় হামলা হয়। ঘটনার পর পরই এরশাদ সরকার সারা ঢাকায় কারফিউ দেয়। এবং এ ঘটনা নিয়ে দেশীয় পত্র পত্রিকায় সবিস্তারে রিপোর্ট হয়। একের পর এক বিদেশী সংবাদমাধ্যম থেকে সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। তারা স্বাধীনভাবে নিউজ করেন। আমি নিজে সে সময়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সঙ্গে কাজ করেছি। খুব ঘনিষ্টভাবে কাজ করেছি বিবিসি’র সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় আতাউস সামাদ এর সঙ্গে। সবাই স্বাধীনভাবে ঘটনার বিস্তারিত লিখেছে বা প্রচার করেছে। সরকারের তরফ থেকে কোন বাধা দেয়া হয়নি। এবং সে সময়ে সব রাজনৈতকি দল এবং বুদ্ধিজীবিগন শান্তি মিছিল বের করে ঢাকায়। উল্লেখ্য, সে সময়ে বাংলাদেশে অত্যন্ত বড় মাপের নিরপেক্ষ ও সম্মানীয় বুদ্ধিজীবি শ্রেণী ছিলেন। তাদের অবস্থান রাজনৈতিক দল ও সরকারের উর্ধে থাকতো এ সব বিষয়ে সব সময়ই।

এরপরে বাংলাদেশ হিন্দুদের ওপর সব থেকে বড় আকারের অত্যাচার, হত্যা ও ধর্ষন শুরু হয় ২০০১ সালে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষের দিকে। ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট জয়লাভ করার পর পরই দেশের কয়েকটি স্থানে এর বেশ বিস্তার ঘটে। কিন্তু সে সময়ে পরিবেশটি এমন শ্বাসরুদ্ধকর ছিলো না। টেলিভিশন ও পত্র পত্রিকা এ নিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট করতে থাকে। বুদ্ধিজীবিরাও রাস্তায় নেমে আসেন। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় যান। বুদ্ধিজীবিদের কয়েকজনকে প্রথমে গ্রেফতার করলেও দ্রুত জামিন দিয়ে বিএনপি ওই দমনের অবস্থান থেকে সরে আসে। তাছাড়া একটি মাস পিপলের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে বা নির্বাচনে বিজয়ী হলে যে সুবিধাটা পাওয়া যায় সেটাও দ্রুত পাওয়া যেতে থাকে। যেমন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করছি, পাবনা ও বরিশালসহ কয়েক জায়গায় আমার পরিচিত ও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কয়েকটি বাড়ি আক্রান্ত হলে- দ্রুত ওই সময়ে বিএনপির মহাসচিব মান্নান ভূইয়া সহ বিএনপির অনান্য বড় নেতা শামসুল ইসলাম, এল, কে সিদ্দিকী, মোহাম্মদ শাহজাহান সহ বেশ কয়েকজনকে ফোনে যোগাযোগ করি। তারা বিষয়গুলোর তাত্‌ক্ষনিক সমাধান করেন। পরবর্তীতে দেখা গেছে অনেক ভিক্টিম এসে প্রকাশ্যে প্রেস কনফারেন্স করেছে- কিন্তু সরকার তাতে বাধা দেয়নি।

এরপরে গত পনের বছরের আওয়ামীলীগ আমলে যশোর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, ও কুমিল্লাতে দরিদ্র হিন্দু পাড়ায় ও পূঁজামন্ডপে হামলা হয়। তা নিয়েও দেশ বিদেশের মিডিয়া যেমন রিপোর্ট করার সুযোগ পায় তেমনি দেশের ভেতর হিন্দু সংগঠনগুলো ও অনান্য রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করে। অবশ্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সমাজে একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগের সেই সম্মানীয় বুদ্ধিজীবি শ্রেণী ক্রমেই হ্রাস পেয়েছে। অধিকাংশ মারা গেছেন। নতুনভাবে ওই শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। যে কারণে সামাজিক শক্তির প্রতিবাদটি ওইভাবে হয়নি।

বাংলাদেশের এই হিন্দু নির্যাতনের ওপর সব সময়ই দেশের পত্র পত্রিকা ও টেলিভিশনের মধ্যে সব থেকে ভালো ও সততার সঙ্গে নিউজ করে দেশের প্রধান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার আর তার পরে থাকে দৈনিক প্রথম আলো। ২০০১-এ ডেইলী স্টারের ভূমিকা ছিলো স্মরণীয়। পত্রিকাটি শুধু একের পর এক ঘটনা নিয়ে নিউজ করেনি। হিন্দুদের সেবারের দুর্গা পূঁজা নিয়ে তারা “Broken Godess” শিরোনামে কভার স্টোরি করে একটি ম্যাগাজিন বের করে।

এবার আগষ্ট মাসে হিন্দুদের ওপর প্রায় আড়াই হাজার আক্রমনের ঘটনার অনেকটা বিরবণ সহ একটি নিউজ শুধুমাত্র বাংলা দৈনিক “প্রথম আলো”  প্রকাশ করে- তাও ভেতরের পাতায়। যতদূর জেনেছি, সম্পাদকের ইচ্ছে ছিলো নিউজটি প্রথম পাতায় প্রকাশ করার- কিন্তু তিনি পারেননি। পারেননি সংবাদটি সম্পূর্ণ ছাপতে। তাকে অনেক বেশি কাটছাট করতে হয়েছে। অন্যদিকে ডেইলি স্টার এবার কেন অনেকটা নীরব তা সত্যই বিষ্ময়কর। সম্পাদক মাহফুজ আনাম অনেক ভালো মানুষ। তাই তাকে প্রশ্ন করে কখনও বিব্রত করেনি যে কেন তিনি নীরব এই ঘটনায়।

সার্বিক সমাজের এই নীরবতার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সমাজও নীরব হয়ে গেছে। হিন্দু সমাজের তরুণ অংশ মাথা উঁচু করে, নির্যাতনশূন্য তাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে বাস করার জন্যে রাস্তায় নেমেছিলো। সরকার তাদের নেতা চিম্ময় প্রভূকে দেশদ্রোহী হিসেবে গ্রেফতার করে কারাপ্রকোষ্টে রেখে দিয়েছে। তাঁর জামিনের জন্যে কোন আইনজীবিও দাঁড়াতে পারছে না।

যার ফলে হিন্দুদের পক্ষে আর কোন ভয়েজ নেই। দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অধিকাংশ দরিদ্র হিন্দুরা এখন কীভাবে জীবন যাপন করছে তা শুধু হিন্দুরাই জানছে। অন্য কারো জানার উপায় নেই। কারণ, এখন নির্যাতন চলে এসেছে নীরবে। এবং এদেশে কখনও যা ঘটেনি এবার তাই ঘটেছে।  সরকারি চাকুরিতে বেছে বেছে হিন্দুদের বাদ দেয়া হয়েছে। এই সিগন্যাল শুধু হিন্দুদের জন্য নয়, সকলের জন্যেই। তাই প্রতিদিনই এখন নীরবে হিন্দুরা নির্যাতন এবং অসাহয়ত্ব’র মধ্যে পড়ছে।

সরকার প্রথম দিকে হিন্দুদের ওপর ওই আগষ্ট মাসের হামলাগুলোকে অস্বীকার করেছিলো। পরে বারো’শ মতো ঘটনার কথা সরকারের একজন মূখপত্র স্বীকার করলেও তিনি বলেছেন, এর মাত্র কয়েকটি ঘটনা ছাড়া বাদ বাকী হামলা রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যে হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর হামলা হয়েছে এবং যারা এখন নীরব চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে-মিন্টু দাসের কন্যার মতো ধর্ষনের শিকারসহ- নানা ঘটনার শিকার হচ্ছে; প্রান হারাচ্ছে দিলীপ দাস, মন্টু দাস সহ অনেকে- এগুলো কীভাবে রাজনৈতিক ঘটনা হয়- তার সত্যই কোন ব্যখা নেই। তবে সরকার বলছে- এটাই শেষ কথা। আর সরকার যখন এ অবস্থানে চলে যায় তখনই সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী হয়, তা এ উপমহাদেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিক জ্যোতি বসু নব্বই এর দশকে স্পষ্ট বলে গেছেন। তাকে বিদেশী সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার রাজ্যে অনেক সংখ্যালঘু, তারপরেও অন্য অনেক রাজ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন হলেও আপনার রাজ্যে হয় না কেন?  মিতভাষী জ্যোতিবসু একটি মাত্র বাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন, “ সরকার চায় না তাই হয় না”। জ্যোতি বসুর এই বাক্যটি এখন যতই কানে বাজে- ততই আঁতকে উঠি।

অথচ এই দুই কোটি হিন্দু এ দেশেরই নাগরিক। আবার তার অধিকাংশই দরিদ্র। কোন অজানা ভবিষ্যত যে এদের জন্যে অপেক্ষা করছে তা বলার সক্ষমতা এখন বাংলাদেশে কারো নেই। কারণ,  এখন মুখ আর মুখোশগুলোর ভেতর পার্থক্য করা সত্যই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024