মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫০ অপরাহ্ন

পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ভোটার নিয়ে বিতর্ক কেন?

  • Update Time : সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ৩.২৪ পিএম
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার নিয়ে যত বিতর্ক।

গৌতম হোড়,দিল্লি

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে রাজ্যে ভুয়া ভোটার নিয়ে বিতর্ক চরমে। চলছে অভিযোগের বন্যা।

পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনেই ভুয়া ভোট ও ভোটার নিয়ে অভিযোগ ওঠে।  তবে সেই অভিযোগ ওঠে মূলত রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের আমলে বিরোধীরা বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে এই অভঊিযোগ তুলে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

কিন্তু এবার ভুয়া ভোটার নিয়ে বিতর্কটা শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। তারপর রাজ্যের প্রধান দলগুলি এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে অভিযোগ করেন, ভোটার পরিচয়পত্র বা এপিক কার্ডে একই নম্বরে একাধিক ভোটারের নাম আছে। তারা কেউ পশ্চিমবঙ্গের তো কেউ হরিয়ানায়, কেউ বা উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। তারপর তিনি তথ্য দিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অন্য রাজ্য থেকে প্রচুর ভোটদাতার নাম তুলে দেয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় একই নম্বরে একাধিক ভোট রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এই কাজটা করাচ্ছে বিজেপি।

নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য

ভারতের নির্বাচন কমিশন স্বীকার করে নিয়েছে, একই এপিক নম্বরে একাধিক ভোটদাতার নাম রয়েছে। কমিশনের দাবি, এ অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এর ফলে ভুয়া ভোটারদের ভোট দেয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে এমন নয়। এপিক নম্বর এক হলেও তারা ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দা অথবা ভিন্ন বিধানসভা ও লোকসভা এলাকার বাসিন্দা। ফলে এপিক নম্বর এক হলেও হরিয়ানার ভোটদাতা পশ্চিমবঙ্গে এসে ভোট দিতে পারবেন না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, একই নম্বরে দুইটি আধার কার্ড হয় না, প্যান কার্ড হয় না, অন্য কোনো কার্ড হয় না, তাহলে ভোটার পরিচয়পত্রের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কার্ড কেন হবে? বিরোধী রাজনৈতিক দলের এই প্রশ্নের মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। একটি নম্বরে যাতে একটি পরিচয়পত্র থাকে তা নিশ্চিত করবে।

কমিশনে বিজেপি, তৃণমূল

দিন দুয়েক আগে তৃণমূলের ১০ সাংসদের প্রতিনিধিদল দিল্লির নির্বাচন সদনে গিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে। তারা অভিযোগ জানাবার কিছুক্ষণ আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বে বিজেপি-র প্রতিনিধিদল গিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে।

পরে সুকান্ত মজুমদার অভিযোগ করেন, ১৩ লক্ষ তিন হাজার ৬৫ জনের নাম এরকম আছে পশ্চিমবঙ্গে, যাদের নাম ভোটার তালিকায় দুই বা তার বেশি জায়গায় আছে। এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার অনুগত অফিসারদের দিয়ে করিয়েছেন। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিককে দিয়ে এবং বিডিও, এসডিও-দের দিয়ে তিনি এটা করিয়েছেন।

মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ”গত কয়েক বছর ধরে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হঠাৎ করে ভোটদাতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমরা এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি।”

সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ”এপিক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে বিতর্ক তুলেছেন, সেই বিষয়েও তথ্য আমরা কমিশনকে দিয়েছি।  ৩২৩টা এপিক নম্বর পাওয়া গেছে যা পশ্চিমবঙ্গেও আছে, বাইরের রাজ্যেও আছে।  পশ্চিমবঙ্গে সাত হাজার ২৩৫ জন আছেন, যাদের এপিক নম্বর এক, কিন্তু তারা আলাদা ব্যক্তি।”

সুকান্তর দাবি, ”ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজটা করেন রাজ্য সরকারের কর্মীরা। তাই তারা এই দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।”

কল্যাণ বলেছেন, ”নির্বাচন কমিশন হলো বিজেপিরই আরেকটা ঘর।”

কংগ্রেস ও বামেদের বক্তব্য

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা এবং লোকসভায় কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর দাবি, ”নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিবিচ্যূতি নিয়ে কংগ্রেস অনেকদিন ধরেই সোচ্চার। গত লোকসভা ভোটের আগে থেকে আমরা বারবার করে নির্বাচন কমিশনকে এসব বলেছি। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র নির্বাচনের পর

কংগ্রেস দলীয় স্তরে ভোটার তালিকা থেকে শুরু করে ভোটসংক্রান্ত যাবতীয় কারচুপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটা কমিটি করেছে। কংগ্রেস চায়, নির্বাচন কমিশনের রাজনীতিকরণ যেন না করা হয়। আগে নির্বাচন কমিশনার কে হবেন, তা ঠিক করার কমিটিতে প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তার প্রতিবাদ করেছেন রাহুল গান্ধী।”

অধীর চৌধুরী বলেছেন, ”আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ভোটদাতারা ভোট দেয়। মৃত ভোটদাতার ভোট পড়ে যায়। বুথের প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসাররা সরকারি দলের মানুষ। তারা রাজ্য সরকারকে সহায়তা করে। ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোট পড়ে যায়। জাল ভোটার তৈরি করে তৃণমূল নিজের কাছে রাখে। প্রায় ৩৪ থেকে ৪০ লাখ ভুয়া ভোটার আছে বলে আমার হিসাব।”

সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ীর দাবি, ”তৃণমূল ও বিজেপি মিলে ভুতুড়ে ভোটার তৈরি করছে ভোটে জেতার জন্য।  এই রাজ্যের প্রশাসনকে ব্যবহার করে মমতা কত যে ভুতুড়ে ভোটারের নাম ঢুকিয়েছেন তার ঠিক নেই। আর দেশজুড়ে ভোটার তালিকা নিয়ে স্বচ্ছ্বতা আনার বিষয়টি বিজেপি খারিজ করেছে।”

বাংলাদেশি ভোটারদের নাম

ভুতুড়ে ভোটার নিয়ে হইচই হওয়ার পর বেশ কিছু জায়গা থেকে বাংলাদেশি ভোটদাতার নাম সামনে আসছে।

এবিপি আনন্দের রিপোর্ট বলছে, পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় ভোটার তালিকায় ৫৬ বছরের বিচরন গাইনের নাম আছে। বিচরনের ছেলে সুমন গাইন জানিয়েছেন, তার বাবা বাংলাদেশে থাকেন। সেখানকার ভোটার। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশে। এখানে নাম কী করে উঠলো তা তিনি জানেন না।

ভবতোষ বৈরাগীর ছেলে অপু বৈরাগীর নাম ভোটার তালিকায় আছে। ভবতোষ জানিয়েছেন, অপু তার ছেলে নয়। অপু অনেকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে এসেছিল।

ভৃগুরাম দাসের স্ত্রী জানিয়েছেন, তার স্বামী বাংলাদেশে থাকেন। তার ভোটার কার্ড বাংলাদেশে। প্রথমে যখন এসেছিলেন, তখন এখানকার ভোটার তালিকায় নাম উঠেছিল।

এরকম আরো কিছু নাম ভোটার তালিকায় আছে বলে রিপোর্ট জানাচ্ছে।

ভুতুড়ে ভোট থাকা নিয়ে মতৈক্য

পশ্চিমবঙ্গে একটা বিষয়ে সব দল একমত, তা হলো, ভোটার তালিকায় ভুতুড়ে ভোটার আছে। বিজেপি বলছে ১৩ লাখ, কংগ্রেস বলছে ৪০ লাখ, এমনকী তৃণমূল এবং সিপিএমও বলছে ভুয়া ভোটার আছে।  প্রশ্ন হলো, ভুয়া ভোটারে কার সুবিধা?

প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ”এমনিতে ভোটার তালিকায় প্রচুর ভুলভাল থাকে। কারো বাবার নাম ভুল, কারো স্বামীর নাম ভুল, চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা ভোটার তালিকায় নাম তোলে, তারা ভুলভাল করে। কিন্তু এখানে অভিযোগটা ভুয়া ভোটার নিয়ে। বাম আমলে দেখা যেত, সিপিএমের কাছে সব খবর থাকত। কারা ভোটের দিনে নেই, কারা মারা গেছেন, কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম আছে, সে সব ভোট পড়ে যেত। এখন সিপিএমের সেই কর্মীদের অনেকেই তৃণমূলে চলে গেছে। অতটা সংগঠিত না হলেও তৃণমূলও একই কাজ করে।”

প্রতিবারই ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। অনেক ভোটদাতা অভিযোগ করেন, তাদের ভোট পড়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিরোধীরা এজেন্ট দিতে পারেন না। ফলে প্রতিবারই ভুয়া ভোটের অভিযোগ প্রবলভাবে সামনে আসে।

এবার বছরখানেক আগে থেকে তা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে, যা অন্যবার হয় না। আর এই প্রথমবার তৃণমূল এতটা সক্রিয় হয়ে ভুয়া ভোটার নিয়ে অভিযোগ করছে। প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ”সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের উপর একটা চাপ তৈরি করতে চাইছে তৃণমূল।”

ডিডাব্লিউ ডটকম

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024