মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:২৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

নেপাল এভারেস্ট পর্যটনে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ

  • Update Time : বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫, ৫.৩৫ এএম

সারাক্ষণ রিপোর্ট

সারাংশ

  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বরফধস ও আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে
  • ২০১৯ সালে সরকার রেকর্ডসংখ্যক ৬৪৪টি এভারেস্ট-আরোহণের অনুমতি দেয়। এতে চূড়ার কাছে বড় ধরনের ভিড় তৈরি হয়
  • ৮,০০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতায় ওঠার সময় প্রতি দুইজন পর্বতারোহীর জন্য একজন গাইড বাধ্যতামূলক
  • নতুন নিয়মে গাইডদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৫০ নেপালি রুপি থেকে বেড়ে ১,২০০ রুপিতে উন্নীত হবে

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে এভারেস্ট এলাকায় পর্যটন বরাবরই অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পর্বতারোহীদের ভিড়, পরিবেশগত ঝুঁকি এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নেপাল সরকার নতুন ও আরও কঠোর নিয়মকানুন প্রণয়ন করতে শুরু করেছে।

পেম্বা শেরপার অভিজ্ঞতা

২০১৮ সালে পেম্বা শেরপা ইউরোপের দুই পর্বতারোহীকে এভারেস্টের চূড়ায় সহায়তা করতে গিয়ে ‘দ্য ব্যালকনি’ (৮,৪৩০ মিটার) পর্যন্ত উঠেছিলেন। কিন্তু নতুন জুতোর অস্বস্তি ও তীব্র ব্যথার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আর সামনে এগোননি। যদিও এর আগে এক দশকের মধ্যে তিনি আটবার এভারেস্ট জয় করেছেন।

  • বর্তমানে পেম্বা শেরপা সুইডেনে ট্রেকিং ও কায়াকিং ট্যুর পরিচালনা করেন।
  • তাঁর মতে, বিশাল উচ্চতা ও আবহাওয়ার অস্থিরতার কারণে এভারেস্টে ঝুঁকি অনেক বেশি।

এভারেস্টের বাড়তি ঝুঁকি

নেপালে এভারেস্ট ‘সগরমাথা’ নামেও পরিচিত। গত কয়েক বছরে এখানে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

  • ২০১৯ সালে সরকার রেকর্ডসংখ্যক ৬৪৪টি এভারেস্ট-আরোহণের অনুমতি দেয়। এতে চূড়ার কাছে বড় ধরনের ভিড় তৈরি হয়।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বরফধস ও আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভারেস্টের জনপ্রিয়তা বাড়লেও অনভিজ্ঞ কিন্তু আর্থিকভাবে সক্ষম অনেকে এতে ঝুঁকে পড়ছেন। ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার বাড়ছে।

শুধু ২০২৩ সালের আরোহন মৌসুমেই এভারেস্টে ১৮ জন মারা গেছেন— যা এক বর্ষপঞ্জি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে বেশিরভাগ বিদেশি হলেও শেরপা ও অন্যান্য নেপালি গাইডরা উচ্চঝুঁকিতে থাকেন।

নতুন বিধিনিষেধ ও সম্ভাব্য প্রভাব

নেপালের সুপ্রিম কোর্ট ২০২৪ সালের এপ্রিলে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, এভারেস্ট-আরোহণ ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আরও কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে ২০২৫ সালের প্রধান আরোহণ মৌসুম শেষ হওয়ার পর (সেপ্টেম্বরের দিকে) কিছু নতুন নিয়ম কার্যকর হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  1. ,০০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতায় ওঠার সময় প্রতি দুইজন পর্বতারোহীর জন্য একজন গাইড বাধ্যতামূলক।
  2. পরিবারের সদস্যদের বেস ক্যাম্পে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।
  3. মৌসুমভেদে আলাদা পারমিট ফি নির্ধারণ করা হবে।

অতিরিক্ত পারমিট ফি ও মৌসুমভেদে মূল্য

নেপালের অর্থনীতিতে পর্যটন বিশাল অবদান রাখে, যেখানে এভারেস্ট-পর্যটন অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ২০২৩ সালে নেপালে আসা ১.০১ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটকের মধ্যে ১,৫৪,২৬২ জন পাহাড়ি ট্রেকিং ও পর্বতারোহণে এসেছিলেন, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এভারেস্ট অঞ্চলে যান।

  • নতুন নিয়মে এপ্রিল-মে (প্রধান আরোহণ মৌসুম) এভারেস্টের পারমিট ফি ১১,০০০ ডলার থেকে বেড়ে ১৫,০০০ ডলারে দাঁড়াবে।
  • সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে এর খরচ হবে ৭,৫০০ ডলার।
  • জুন-আগস্ট ও ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারিতে পারমিট ফি হবে ৩,৭৫০ ডলার।

সরকার আশা করছে, এর মাধ্যমে বছরের অন্যান্য সময়েও এভারেস্টে আরোহণের চাপ ছড়িয়ে পড়বে। তবে অনেকে আবহাওয়ার কারণে অফ-সিজনে উঠতে অনাগ্রহী হতে পারেন, আবার কিছু অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ভিড় এড়াতে এই সময়কে বেছে নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বেস ক্যাম্পের ভোগবিলাস ও নিয়ন্ত্রণ

২০১৫ সালের পর থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আরামদায়ক সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে— বড় বড় কোম্পানি কফি মেশিন থেকে টেবিল গেম পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে।

  • নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বেস ক্যাম্পে পরিবারের সদস্যদের আনতে চাইলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হবে।
  • ২০১৯ সালে চীনও একই ধরনের নিয়ম প্রয়োগ করেছিল।

গাইড ও সমর্থনকর্মীদের নিরাপত্তা

নতুন নিয়মে গাইডদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩৫০ নেপালি রুপি থেকে বেড়ে ১,২০০ রুপিতে উন্নীত হবে। এ ছাড়া জীবনবিমার সর্বোচ্চ সীমা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ লাখ নেপালি রুপি। যদিও অনেকে মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি ও কাজের ঝুঁকির তুলনায় এটিও যথেষ্ট নয়।

সরকারি নিয়ম বাস্তবায়নের ফাঁক-ফোকর

নেপাল সরকার অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, পর্বতারোহণ পর্যবেক্ষণের জন্য ‘লিয়াজোঁ অফিসার’ নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক কর্মকর্তা শহরেই থেকে যান এবং বেস ক্যাম্পে উপস্থিত হন না।

  • দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তা ও নিয়ম তদারকিতে মূল ভূমিকা পালনে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিরাই অগ্রগামী।
  • সরকার নতুন নিয়ম দিলেও কার্যকর তদারকির ঘাটতির কারণে বাস্তবে সেগুলো ঠিকমতো প্রয়োগ হয় না বলেই দাবি সংশ্লিষ্টদের।

চীনের কঠোর নিয়ম ও তুলনা

এভারেস্টের উত্তর পার্শ্ব (তিব্বত) চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেখানে:

  • ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স সীমা,
  • আগের ৭,০০০ মিটার উচ্চতায় আরোহণের অভিজ্ঞতা থাকা,
  • ৭,০০০ মিটারের ওপরে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা,
    এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়।

এ ছাড়া প্রতিটি দলের কাছ থেকে ১,৫০০ ডলার ফি নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়।

  • নেপালে ২০১৪ সাল থেকে প্রবাসী পর্বতারোহীদের কাছ থেকে ৪,০০০ ডলার জামানত রাখা হয় যাতে তারা অন্তত ৮ কেজি বর্জ্য ফিরিয়ে আনেন।
  • অনেকেই এই জামানতের অর্থ ফেরত না নিয়ে বর্জ্য ফেলে চলে যান।
  • নতুন নিয়মে সব ধরনের বর্জ্য (ব্যক্তিগত বর্জ্যও) ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যদিও এটি বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এভারেস্টে নেপালের ভূমিকা অব্যাহত

নতুন নিয়মে খরচ ও আনুষ্ঠানিকতা কিছুটা বেড়ে গেলেও, এভারেস্টের দক্ষিণ দিক (নেপাল) এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট।

  • চীনের কড়া নিয়ম ও তিব্বতে বিদেশিদের গতিবিধিতে সীমাবদ্ধতার কারণে সে পথে তুলনামূলক কম পর্বতারোহী যান।
  • ২০২৪ সালে ৮৬১ জনের এভারেস্টে ওঠার অনুমোদনের মধ্যে মাত্র ৭৪ জন চীনের দিক দিয়ে উঠেছিলেন।
  • নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নিমা নুরু শেরপার মতে, উভয় দিকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন বলে একপক্ষে আরোপিত নিয়ম অন্যপক্ষে তেমন প্রভাব ফেলে না।

উপসংহার

নেপাল সরকার এভারেস্টকে নিরাপদ ও টেকসই রাখতে নতুন নিয়ম, বাড়তি পারমিট ফি এবং কঠোর নজরদারির উদ্যোগ নিয়েছে। এ পরিবর্তনগুলো কার্যকর হবে কি না, তা দেখতে সময় লাগবে। তবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতকে রক্ষা ও সুরক্ষিত রাখতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন ক্ষেত্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024