সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- দীর্ঘদিন ধরে জাপানের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বেতন বৃদ্ধির জন্য তেমন জোরালো দাবি জানায়নি
- মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপান ও চীনের বিরুদ্ধে মুদ্রার অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলেছেন
- জাপানও প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে, যা অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে
- জাপান সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিওজে) বিগত কয়েক দশকের সামান্য মুদ্রাস্ফীতি ও নিম্ন সুদের হার থেকে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে চায়। গত বছর, প্রায় ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো সুদের হার বাড়ানোর পর, বিওজে আবার কীভাবে আর্থিক নীতি কঠোর করবে, তা সবার নজর কেড়েছে। সম্প্রতি এ কাজকে ত্বরান্বিত করতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে—একদিকে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর উচ্চ বেতন দাবি, অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুদ্রানীতি নিয়ে কটাক্ষ।
শ্রমিক ইউনিয়নের নবজাগরণ
- ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা: গত তিন দশকে জাপানি শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সাধারণত বড় মাপের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সোচ্চার ছিল না। কর্মসংস্থান রক্ষার জন্য তারা বেশিরভাগ সময়ে কম বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিত।
- বর্তমান পরিস্থিতি: এবার, বার্ষিক মজুরি আলোচনায় বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫% বা তার বেশি, আর ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৬% বা তার বেশি বেতন বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে।
- অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য: রাকুটেন সিকিউরিটিজ ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিওজের সাবেক কর্মকর্তা নবুয়াসু আতাগো এটিকে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর হিসেবে দেখছেন।

ট্রাম্পের ভূমিকা
- ট্রাম্পের অভিযোগ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার জাপান ও চীনকে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করার অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তার ভাষায়, “বারবার মুদ্রার মান কমিয়ে গেলে অন্য পক্ষের প্রতি তা অন্যায়।”
- ইয়েনের দুর্বলতা: মার্কিন ডলারের তুলনায় ইয়েন দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল ছিল, যার পেছনে বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সুদের হারের বড় ব্যবধান।
- নীতির প্রভাব: অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের জাপান অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান এবং বিওজের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক মহাপরিচালক শিগেতো নাগাই মনে করেন, ট্রাম্পের এই সমালোচনা বিওজেকে স্বাভাবিকীকরণের (টাইটেনিং) পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করছে। আগে রাজনৈতিক চাপের কারণে অর্থনীতি ধীর হয়ে গেলে সুদের হার বাড়ানোর বিষয়টি আটকে যেত, কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের কথা মাথায় রেখে সেই চাপ কিছুটা কমে গেছে।
মুদ্রাস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধি
- মজুরি আলোচনার ফলাফল: ১০ মার্চ, জাপানের সবচেয়ে বড় শ্রমিক ইউনিয়ন কনফেডারেশন রেনগো জানায় যে, তারা এবারের বার্ষিক মজুরি আলোচনায় গড়ে ৫.৪৬% বৃদ্ধির প্রাথমিক ফলাফল পেয়েছে, যা গত বছরের ৫.১%-এর তুলনায় বেশি এবং ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ।
- ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি: নাগাই বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। জানুয়ারিতে সার্বিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ৪%-এ পৌঁছায়, যেখানে গত বছরের গড় মজুরি বৃদ্ধি ছিল ২.৮%। মজুরি বৃদ্ধির প্রবাহ আরও বাড়ার দরকার, অন্যথায় “বহুমুখী সাইকেল” (উচ্চ মজুরি ও উচ্চ ব্যয়ের চক্র) গড়ে উঠবে না।

স্থায়ী মূল্যস্ফীতি ও নীতির অভিমুখ
- বিওজের লক্ষ্যমাত্রা: বিওজে বলেছে, মুদ্রাস্ফীতি তাদের ২% লক্ষ্যের দিকে টেকসইভাবে এগোলে তারা আর্থিক সহজীকরণ কমাতে শুরু করবে।
- দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব: অনেকে মনে করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমে গেলে জাপানেও মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, জাপানের মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
- চালের দাম বৃদ্ধি: জানুয়ারিতে চালের দাম এক বছরে ৭০.৯% বেড়েছে, যা রেকর্ড মাত্রা। জনসংখ্যা হ্রাসমান একটি দেশে চালের দাম এতটা বাড়বে না বলে যারা ভেবেছিলেন, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। চালের দাম বাড়ার প্রভাব প্রক্রিয়াজাত খাবার ও রেস্তোরাঁ খরচেও পড়ছে।
রক্ষণশীলতা বনাম ব্যয়বৃদ্ধির চাপ
- সুদের হার বৃদ্ধির পূর্বাভাস: অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের নাগাই একসময় ভেবেছিলেন, বিওজে ২০২৬ সালের গ্রীষ্ম নাগাদ ১%-এ গিয়ে এই সুদের হার বৃদ্ধির চক্র শেষ করবে। তবে খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম ও মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত হার আরও ওপরে উঠতে পারে।
- সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ: রাকুটেন সিকিউরিটিজের আতাগো মনে করেন, বিওজে ১৬-১৭ জুনের দিকে ফের সুদের হার বাড়াতে পারে, কারণ আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকার মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে চাইবে।

প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রভাব
- মিত্রদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান: ট্রাম্প প্রশাসন তার মিত্র দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা খাতে আরও বেশি ব্যয় করার আহ্বান জানাচ্ছে। জার্মানি ইতিমধ্যেই সংবিধান সংশোধন করে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।
- জাপানের পরিকল্পনা: জাপান আগে থেকেই প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২%-এ নেওয়ার চিন্তা করছিল, তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৩% পর্যন্ত বাড়ানোর দাবিও এসেছে। বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয় মানে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারে।
সুদের হার সম্পর্কে বাজারের প্রত্যাশা
- বন্ডের ফলন: ১০ বছরের জাপানি সরকারি বন্ডের ফলন (ইয়িল্ড) ১.৫৭৫%-এ উঠেছে, যা প্রায় ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাজারে ধারণা রয়েছে যে, সুদের হার ১%-এরও বেশি হতে পারে।

- অর্থনীতিবিদদের জরিপ: নিক্কেই-সম্পর্কিত সংস্থা QUICK-এর করা এক জরিপে দেখা গেছে, ২৮ জন অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১০ জন মনে করেন সুদের হার ১%-এ গিয়ে শেষ হবে, ৬ জনের ধারণা এটি ১.৫% পর্যন্ত উঠতে পারে, আর ৪ জন ১.২৫%-এ গিয়ে স্থির হবে বলে মনে করছেন।
উপসংহার
জাপান দীর্ঘকালীন নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি থেকে মুক্তি পেতে বিওজের কঠোর আর্থিক নীতির দিকে এগোচ্ছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর উচ্চ বেতন দাবির নবজাগরণ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপ—এই দুই শক্তিই বিওজের টাইটেনিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম ও মজুরি দুটোই বেড়ে যাওয়ায় জাপানে মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তাই অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, বিওজে ভবিষ্যতে আরও একাধিকবার সুদের হার বাড়াতে পারে।
Leave a Reply