বিয়ে মানে কি শুধু গুড়ের সন্দেশ আর মিষ্টি সেমাই?
সাথে আছে ডাউন পেমেন্ট, আর গাড়ি-বাড়ির ইএমআই
আজকের চীনা তরুণ দম্পতিরা বিয়ের সংজ্ঞা যেন একদমই পাল্টে ফেলেছেন—আছে ভালোবাসা, আছে হিসাব-নিকাশ, সেইসঙ্গে আছে একরাশ আত্মবিশ্বাস। জীবনসঙ্গী খোঁজার ব্যাপারে তারা বেশ উদার, তবে ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় বিয়ের ফর্দের সঙ্গে আজকাল তারা খুলে বসছেন অর্থনীতির খাতাও। বিয়েকে যেন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছেন আজকের আধুনিকমনা চীনা তরুণরা। যে সংজ্ঞার সারমর্মটা হলো—বিয়েতে অবিরত ভালোবাসা ফ্রি, বাকিটা কিস্তিতে বুঝে নাও!
লাভ, লোন আর লাভ-লেসন
২৪ বছরের লু ইংকুই নিজের তিন বছরের প্রেমিককে বিয়ে করেছেন বেশ ‘মর্ডান’ স্টাইলে। ছাংশা শহরে তারা একটা পুরনো ফ্ল্যাট কিনেছেন—লু’র নামে। ভাড়া ১,৪০০ ইউয়ান, আর মর্টগেজ ২,৪০০ ইউয়ান। আর হাজারখানেক ইউয়ান হলেই নিজেদের হবে চার দেয়াল। দুজনই একসময় চাকরি করতেন রিয়েল এস্টেটে। সে থেকেই দারুণ হিসাবি ভাবনা! পাত্রীর ভাষায়, ‘বিয়ে মানেই কিন্তু আবার ব্যবসায়িক হিসাব নয়।’
লু বললেন, ‘আমার আগে দেখার বিষয়টা ছিল লোকটা কেমন। মূলত বিয়েটা হয় মানুষের চরিত্রের সঙ্গে। আর আমার মনে হয় সে বিশ্বাস করার মতো।’
বিয়ের আগে চাকরি ছিল না লু’র। তবে আজীবন বেকার থাকবেন না এমন প্রতিশ্রুতি হবু স্বামীকে দিয়েছিলেন আগেই।
লু মজা করে বলেন, ‘বিয়ে করেছি বলে বাসাটা আমার নামে হয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। ভালোবাসা থাকলেও কেউ কাউকে সারাজীবন ফ্রি স্পনসর করবে, এমনটা আশা করবো কেন?’
১৩ বছরের লাভ ম্যারাথন
হুনানের লি ছেনসি আর তার বেইজিং-এর প্রেমিক অবশেষে ১৩ বছরের সম্পর্কের পর বিয়ে করেছেন। প্রেমিকের পরিবারের আপত্তি ছিল বেইজিংয়ের বাইরের কেউ কনে হতে পারবে না। তবে একগুঁয়ে ভালোবাসার কাছে হার মেনেছে সব বাধা। গাঁটছড়া বেঁধে এখন তারা নিজেদের জন্য একসঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টও কিনেছেন। তাদের চিন্তাটা ছিল ‘ভাড়ার বাসা মনমতো সাজানোর মানে হয় না। নিজের বাসায় প্রতিদিন নতুন কিছু কেনার অপেক্ষায় থাকাটাই আনন্দের।’
গেমার বর, চিন্তায় কনে
২৯ বছরের হ্য থিং বিয়ে করছেন এক লাইভস্ট্রিম গেমারকে। ছয় বছরের প্রেম, চার বছর আলোচনা—অবশেষে বিয়ে! তবে গেমার বরের স্থায়ী কোনো আয় না থাকা এবং তার মেয়ে ফ্যানদের নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন হ্য। একটা পর্যায়ে এও বুঝতে পারলেন, ছেলেটা তাকে পছন্দ করে। তার ভেতরটাও বদলেছে খানিকটা। হ্য’র ওপর আত্মবিশ্বাসও আছে ঢের, যে কারণে গেমের লাইভস্ট্রিমিং বাবদ আয় করা ২ লাখ ইউয়ানের পুরোটাই তুলে দেন হ্য থিংয়ের একাউন্টে।
মজা করে হ্য থিং বললেন, ‘একবার তো ধরা পড়েছে, ভবিষ্যতে যদি সে তার কোনো মেয়ে ফ্যানের সঙ্গে মেলামেশা করে, তো আমার হাতে যথেষ্ট টাকা থাকবে কিন্তু!’
প্রথাও টিকে আছে
চীনা বিয়ের প্রথাগত চিত্রটাও কিন্তু হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে কনেদেরকে অর্থ দেওয়ার একটা কঠিন রীতি এখনও টিকে আছে। দেনমোহর ঘরানার ওই অর্থটাকে চীনা ভাষায় বলে ছাইলি। সেইসঙ্গে কিছু তরুণ এখনও বিয়ের আগে মানসিকভাবেই তৈরি থাকেন ‘যুদ্ধের ময়দানে’ নামতে।
২৮ বছরের শি সু খাই নিজেকে এখন খাঁটি যোদ্ধা-প্রেমিকই ভাবেন। এক দশক প্রেমের পর করেছেন বিয়ে। অ্যাপার্টমেন্টের ডাউন পেমেন্ট থেকে শুরু করে গাড়িও কিনেছে। কনেকে দিয়েছেন ১ লাখ ইউয়ান। সংসারের খরচা শি করে যাচ্ছেন হাড়ভাঙা পরিশ্রম।
অন্যদিকে, শানসি প্রদেশের চাং শিয়াওয়েন বিয়ে করেছেন তার তরুণ প্রফেসর প্রেমিককে। চীনের অর্থনীতির মতো বিয়ের জন্য ছেলের আর্থিক স্থিতিশীলতার বিষয়টা ছিল অতি জরুরি! কিন্তু পোস্ট ডক্টরাল পড়াশোনার পরও চাকরি পাচ্ছিলেন না সেই ছেলে। তবে হাল ছাড়েননি চাং। ছেলের দুর্দিনে পাশে থেকেছেন। দিয়ে গেছেন মানসিক সমর্থন। পরে সুদিন ফিরতে দেরি হয়নি আর। আড়াই লাখ ইউয়ান ছাইলিতে হয়ে যায় চূড়ান্ত দেন-দরবার।
অর্থাৎ দ্রুত পাল্টে যাওয়া চীনে এখন বিয়ে শুধু ফুল, লাল কার্ড আর হাসিমুখো আত্মীয়স্বজনের গল্প নয়—এটা যেন প্রেম, পকেট আর পারিবারিক চাহিদার এক উচ্চমানের সমীকরণ!
শহরের ফ্ল্যাট থাকা না থাকা থেকে শুরু করে, আয়-রোজগারসহ যাবতীয় ‘বাস্তব’ প্রশ্নের উত্তর মিললেই বসছে প্রেমের সিলমোহর। কেউ আবার সরল ভালোবাসায় ভরসা করে, কেউ জীবনের ফাইন্যান্স প্ল্যান হাতে নিয়ে মিলাতে বসে বিয়ের বাজেট।
সিএমজি বাংলা
Leave a Reply