মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:১৬ অপরাহ্ন

‘বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস ” আজ

  • Update Time : শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ৭.৫০ পিএম

সারাক্ষণ রিপোর্ট

২১ মার্চ ‘বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস’। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, তাদের পরিবারবর্গ, সহকর্মী-বন্ধু, চিকিৎসক এবং সচেতন জনগণ এই দিনটিকে নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রতিবছর পালন করে থাকেন। ডাউন সিনড্রোম সমন্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক অধিকার আদায়ে, সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচীতে সাধারণ জনগণের ন্যায় ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সর্বোপরি ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ভালোবাসাময় একটি পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যেই দিবসটি ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হয়ে আসছে।

তবে অনেকে হয়তো ডাউন সিনড্রোম  বিষয়টি কি তা জানেনই না। এটি বিশেষ ধরনের জেনেটিক বা জিনগত অবস্থা। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের ক্রোমোজোমের গঠন সাধারণ মানুষের ক্রোমোজমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে।

ডাউন সিনড্রোম একটি শিশুর বংশানুগতিক সমস্যা। আর মানবদেহে প্রতিটি কোষে ক্রমোজমের সংখ্যা থাকে ৪৬টি। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেহকোষে ২১তম ক্রমোজমে একটি অতিরিক্ত ক্রমোজম থাকে, যাকে ‘ট্রাইসমি ২১’ বলা হয়। এই অতিরিক্ত ক্রমোজমটির কারণে বিশেষ কিছু শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি নিয়ে ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম হয়। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে জন ল্যাংডন ডাউন নামে এক ব্যক্তি এটি আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই এটি ডাউনস সিনড্রোম বা শুধু ডাউন সিনড্রোম বলে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্থান পায়।

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি ৮০০ শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে। পৃথিবীতে প্রায় ৭০ লাখ ডাউন সিনড্রোম লোক রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৫ জন ডাউন শিশু জন্ম নেয় এবং দেশে প্রতি বছর পাঁচ হাজার ডাউন শিশু জন্মায়। দেশে প্রায় দুই লাখ শিশু এ সমস্যায় ভুগছে।

> ডাউন সিনড্রোমের প্রকারভেদ-
ডাউন সিনড্রোম তিন প্রকার:

ট্রাইসোমি২১: সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, প্রায় ৯৫% ক্ষেত্রে, যেখানে শরীরের প্রতিটি কোষে ক্রোমোজোম ২১ এর তিনটি কপি থাকে।
ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিনড্রোম: এই অবস্থা প্রায় ৪% ক্ষেত্রে ঘটে। এই সিন্ড্রোমে, ক্রোমোজোম ২১-এর অংশ অন্য ক্রোমোজোমের সাথে সংযুক্ত (ট্রান্সলোকেটেড) হয়ে যায়।
মোজাইক ডাউন সিনড্রোম: প্রায় ১% ক্ষেত্রে পাওয়া যায়, যেখানে কিছু কোষে ক্রোমোজোম ২১ এর তিনটি কপি থাকে, অন্যদের সাধারণত দুটি কপি থাকে।

 > কারণঃ-
মানবদেহে ৪৬টি ক্রোমোজম থাকে, যার অর্ধেক মা এবং অর্ধেক বাবার থেকে আসে। মানুষের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুই ক্রোমোজমের ভেতরের ডিএন-এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। এই ডিএনএ বা ক্রোমোজমের অসামঞ্জস্যতা হলে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন জেনেটিক ত্র“টি দেখা দেয়। ২১ নম্বর ক্রোমোজমের জায়গায় একটি বাড়তি ক্রোমোজমের কারণে ডাউন সিনড্রোম হয়। একে ‘ট্রাইসোমি ২১’ বলে। ৯৫ শতাংশ ডাউন সিনড্রোমই এ কারণে হয়ে থাকে। এ অতিরিক্ত ক্রোমোজমের অসামঞ্জস্যতার কারণে ডাউন সিনড্রোম শিশুদের বিশেষ কিছু শারীরিক ও মানসিক ত্র“টি দেখা যায়।
> ঝুঁকিঃ-মায়ের বয়স ২০ বছরের কম বা ৩৫ বছর বেশি হলে এর ঝুঁকি বাড়বে। বয়স যত বেশি হবে শিশুর ডাউনস সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়বে। যেমন- ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। অন্যদিকে কোনো মায়ের আগে একটি ডাউন শিশু থাকলে পরবর্তীতে ডাউন শিশু হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বাবা-মা ত্র“টিযুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের সন্তানও ডাউন শিশু হতে পারে। যদি বাহক বাবা হন তবে সে ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে ৩ শতাংশ আর মা হলে তা বেড়ে হয়ে যায় ১২ শতাংশ।
> গর্ভাবস্থায় শনাক্তকরণঃ-
পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর জন্মের আগেই শিশুর ডাউন সিনড্রোম আছে কি না তা সন্দেহ করা যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে মায়ের পেটে ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভস্থ শিশু ডাউন শিশু হিসাবে জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্রনিওনিকভিলাস স্যামপ্লিং বা অ্যাুিওসেন্টেসিস করা প্রয়োজন হবে। তবে ক্রমোজম পরীক্ষাই এ রোগ নিশ্চিতকরণের একমাত্র উপায়।
> লক্ষণ ও জটিলতাঃ-
যেসব শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো হলো– শরীরের মাংসপেশি শক্তিশালী না হওয়া বা মাংসপেশিতে স্বাভাবিক শিশুদের মতো জোর না থাকা। একে মাংসপেশির শিথিলতা বলে এবং শিশু নরম তুলতুলে হয় যাকে ফ্লপি বেবি বলে।
– দুই চোখের বাইরের কোনা বাঁকাভাবে ওপরের দিকে উঠে থাকা
– তাদের হাতের তালু জুড়ে একটিমাত্র রেখা থাকতে পারে
– নাক চ্যাপ্টা
– কান ছোট ও নিচু
– জিব বের হয়ে থাকা
– জন্মের সময় শিশুর ওজন ও দৈর্ঘ্য, গড় ওজন ও দৈর্ঘ্যরে চেয়ে কম, উচ্চতা কম
ডাউন সিনড্রোম আক্রান্তদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও সক্ষমতায় এবং বিভিন্ন মাত্রার বুদ্ধিমত্তা ও অক্ষমতা থাকে। এ ছাড়া, ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত অনেক শিশুর বিভিন্ন শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে-
– জন্মগত হৃদরোগ
– অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা
– শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির বৈকল্য
– থাইরয়েডের ত্র“টিপূর্ণ ক্রিয়া
– অধিক সংক্রমণের আশঙ্কা
– ঘাড়ের হাড়ের সমস্যা
– রক্তের রোগ
কিছু শিশুর এর কোনোটিই হয় না, আবার কাউকে এর কয়েকটি ভোগ করতে হয়।
> শিশুর যত্নঃ-ডাউন সিনড্রোম শিশু জন্মালে পরিবারের জন্য ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যেমন কঠিন, তেমনি নেতিবাচক চিন্তা মাথায় আসাটাও অস্বাভাবিক নয়।
পরিবার, আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া এক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
যদিও ডাউন সিনড্রোম কোনো প্রতিকার নেই, এ ধরনের শিশুদের সহায়তার অনেক উপায় আছে যাতে করে তারা সুস্থ ও পরিপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে বেড়ে উঠে, স্বাবলম্বী হতে পারে।বিভিন্ন পরিচর্যার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সঠিক যত্ন, পুষ্টিকর খাবার, স্পিচ ও ল্যাংগুয়েজ থেরাপি এবং ফিজিক্যাল থেরাপি দিলে ডাউন সিনড্রোম শিশুরা অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতো পড়ালেখা করে স্বনির্ভর হতে পারে। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি শারীরিক সমস্যা থাকে বলে এদের নিয়মিত শিশু বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ দ্বারা পরীক্ষা করাতে হবে তাহলে সমস্যাগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করা যাবে।> মায়ের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম জানা যাবেঃ- যদি সে মনে করে তার ভ্রূণের ডাউন সিনড্রোম আছে, তাহলে তার রক্ত ক্রোমোসোমলি পরীক্ষা করাতে পারে। এই পরীক্ষাটি নির্ধারণ করে যে আপনার ডিএনএ জিনগত উপাদান বহন করে যা অতিরিক্ত ক্রোমোজোম ২১ উপাদানের সাথে মেলে।
সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করার সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হল একজন মহিলার বয়স। ২৫ বছর বয়সী একজন মহিলার ডাউন সিনড্রোমে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা ১.২০০ জনের মধ্যে ১ জনের আছে। ৩৫ বছর বয়সে, সুযোগ ৩৫০ তে ১ বেড়ে যায়।
যদি একজন বা উভয় পিতামাতার ডাউন সিনড্রোম থাকে তবে শিশুর এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
> মনে রাখুন
_ সময়মতো পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে হরমোন জনিত জটিলতা সহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
_ উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে এই শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে।
_ মা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ করা উচিত।

পরিশেষে, এ বিষয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা দরকার। যেহেতু মায়ের কম বা বেশি বয়সের সঙ্গে ডাউন শিশু হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে, তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধিক বয়সে, বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে মা হওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়। মায়ের আগের বাচ্চাটি যদি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত থাকে তবে পরে বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আর সবাই যদি সচেতনতা সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসে, তবেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি হবে এবং ডাউন শিশুদের প্রতি আমাদের মমতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তারা সমাজের বোঝা নয়। পর্যাপ্ত যত্ন এবং সহযোগিতাই পারে তাদের সমাজের সম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে।

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
কলাম লেখক ও হোমিওপ্যাথিক বিশেষজ্ঞ 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024