সারাক্ষণ রিপোর্ট
- প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি:
বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা রোগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ১,৩৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে, যার মধ্যে গড়ে ১৩ জন ওষুধ প্রতিরোধী। অন্যদিকে, প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন রোগীর মৃত্যু ঘটছে।
- চিকিৎসার গুরুত্ব:
রোগের দ্রুত শনাক্তকরণে ৯৫% ক্ষেত্রে সফল চিকিৎসা সম্ভব হওয়ায়, প্রতি বছর ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন
- রোগীর সংখ্যা ও শনাক্তকরণ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আনুমানিক ৩,৭৯,০০০ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। গত বছর জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ৩,০১,৫৬৪ রোগী শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে পুরুষ ৫৬% ও নারী ৪২%।
- মৃত্যুর হার:
দৈনিক গড়ে ৮২৬ রোগী শনাক্ত ও ১৯ জন মারা যাচ্ছে, যদিও অন্যান্য রিপোর্টে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি দেখানো হয়েছে। গ্লোবাল যক্ষ্মা প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৪২,০০০ জন মৃত্যুর মুখে যেতে হয়েছে।

যক্ষ্মার প্রাচীন ইতিহাস ও চিকিৎসা উন্নয়ন
- ইতিহাসের পাতায়:
যক্ষ্মা, যা আজ টিবি নামে পরিচিত, একটি প্রাচীন ও মারাত্মক রোগ। প্রাচীন মিসরের মমি ও গ্রিক যুগে একে ‘Phthisis’ ও ‘ক্ষয়রোগ’ বলা হতো।
- নামকরণ ও আবিষ্কার:
১৭শ শতাব্দীতে ফ্রান্সিসকাস সিলভিয়াস প্রথম টিউবারকেল ধারণার কথা উল্লেখ করেন, পরে ১৮৩৯ সালে জোহান শনলেইন রোগটির নাম দেন টিউবারকুলোসিস।
- ড. রবার্ট কচের অবদান:
১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ, ড. রবার্ট কচ জার্মানির বার্লিনে যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের ফলেই বিসিজি টিকা, টিউবারকুলিন টেস্ট, বিভিন্ন ওষুধ ও ‘ডটস পদ্ধতি’ (DOTS) উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। এদিন থেকেই ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করা হচ্ছে।
সংক্রমণ, লক্ষণ ও উপসর্গ
- সংক্রমণের উপায়:
যক্ষ্মা ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে যখন একজন আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলে, কাশি করে বা হাঁচি দেয়।
- ল্যাটেন্ট বনাম সক্রিয় যক্ষ্মা:
- ল্যাটেন্ট (নিষ্ক্রিয়) যক্ষ্মা:
সংক্রমিত থাকলেও কোন লক্ষণ না দেখায়; পরবর্তীতে সক্রিয় রূপে পরিণত হতে পারে।
- সক্রিয় যক্ষ্মা:
স্পষ্ট লক্ষণ যেমন –
- দীর্ঘস্থায়ী (৩ সপ্তাহ বা তার বেশি) কাশি
- বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট
- ক্ষুধামান্দ্য, ক্লান্তি ও ওজন হ্রাস
- রাতে অতিরিক্ত ঘাম ও জ্বর
- শ্লেষ্মা বা রক্তযুক্ত কাশি
এছাড়াও, রোগটি মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড ও কিডনিতে প্রভাব ফেলতে পারে।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পদ্ধতি
- মেডিকেল ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা:
রোগীর উপসর্গ ও শারীরিক লক্ষণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাথমিক মূল্যায়ন।
- টিউবারকুলিন স্কিন টেস্ট (TST):
হাতে PPD ইনজেকশন করে ৪৮-৭২ ঘণ্টায় প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
- রক্ত পরীক্ষা:
IGRA (ইন্টারফেরন-গামা রিলিজ অ্যাসেস) টেস্ট সংক্রমণ শনাক্ত করতে সহায়ক।
- ইমেজিং পরীক্ষা:
বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ফুসফুস বা অন্যান্য অঙ্গে সংক্রমণের লক্ষণ চিহ্নিত করা যায়।
- স্পুটাম টেস্ট:
শ্লেষ্মা সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা বা কালচার করা হয়।
- অতিরিক্ত পরীক্ষা:
প্রয়োজনে ব্রঙ্কোস্কোপি, বায়োপসি বা অন্যান্য ইমেজিং স্টাডি করা যেতে পারে।
ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও সচেতনতা
- ঝুঁকির কারণ:
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম (উদাহরণস্বরূপ, এইচআইভি/এইডস)
- জনাকীর্ণ পরিবেশে বাস বা কর্মরত হওয়া
- ধূমপান, ডায়াবেটিস ও মাদকসেবার অভ্যাস
- নিয়মিত বিদেশ সফর
- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
- মুখোশ ব্যবহার:
সক্রিয় রোগীর ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত মুখোশ পরা জরুরি।
- ভালো বায়ুচলাচল:
ঘরে বা বন্ধ জায়গায় জানালা বা ফ্যানের সাহায্যে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।
- মুখ ঢেকে রাখা:
কাশি, কথা বলা বা হাঁচির সময় টিস্যু ব্যবহার করে মুখ ঢেকে রাখা এবং পরে তা সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করা।
- নিজেকে আলাদা রাখা:
সক্রিয় রোগ নির্ণয়ের প্রথম কয়েক সপ্তাহে অন্যান্যদের থেকে দূরে থাকা।

- সরকারি উদ্যোগ ও চিকিৎসা সুবিধা:
- সরকার বিনামূল্যে যক্ষ্মা চিকিৎসা প্রদান করছে – উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা ও সামরিক হাসপাতালসহ নানা স্থানে।
- ব্র্যাকসহ বিভিন্ন সংস্থা বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করে।
- ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রামের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০% মৃত্যুহার ও ৮০% প্রাদুর্ভাব কমানোর লক্ষ্যে ব্যাপক উদ্যোগ চলছে।
উপসংহার
যক্ষ্মা (টিবি) একটি মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হলেও, দ্রুত শনাক্তকরণ, সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। যদিও বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সরকারি উদ্যোগের ফলে রোগের সংখ্যা কমে আসছে, তবুও ওষুধ প্রতিরোধী টিবি (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিস) একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, চিকিৎসা শুরু হলেও নির্ধারিত ওষুধের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা অত্যন্ত জরুরি।
সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের পরামর্শ মেনে চললে যক্ষ্মাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব – এবং এভাবেই আমরা একদিন যক্ষ্মামুক্ত দেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করতে পারব।
Leave a Reply