মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫১ অপরাহ্ন

সাউথ চায়না মর্ণিং পোস্ট এর প্রতিবেদন- মোদি-ইউনূস সাক্ষাৎ: সংকটাপন্ন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এক ‘শীতল মুহূর্ত’

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ৫.০৬ পিএম

বিমান মুখার্জ্জী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নেতৃত্বর্ধক মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ, উভয় দেশের মধ্যে সংকটাপন্ন সম্পর্ক মেরামতের দিকে একটি অনিশ্চিত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, বিশ্লেষকরা পূর্বেই জানিয়েছেন যে, দীর্ঘকালীন অবিশ্বাস ও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনো একটি গভীর প্রভাব রেখে যাচ্ছে।

থাইল্যান্ডে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় শুক্রবার অনুষ্ঠিত এই সাক্ষাৎ, গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের হঠাৎ পতনের পর থেকে – ছাত্রদের নেতৃত্বে চলা আন্দোলন এবং বর্ধিত অশান্তির প্রেক্ষিতে – ভারত এবং বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল প্রশাসনের মধ্যে প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ দুটির সম্পর্ক ধীরে ধীরে অবক্ষয় এর দিকে  যাচ্ছিল; কারণ দীর্ঘদিন ধরে নতুন দিল্লির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতেই আশ্রয় নিলেন, তখন একটি বিশ্বস্ত সহযোগী হারিয়ে যায়। এই হঠাৎ বিদায় ভারতের জন্য কূটনৈতিক নীতিতে পুনর্বিন্যাসের জরুরী প্রয়োজন সৃষ্টি করে, যেখানে নতুন শাসনব্যবস্থা অন্য শক্তির সাথে আরও স্বচ্ছ ও খোলামেলা সম্পর্ক গড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা দুইপাক্ষিক সাক্ষাৎকে “ খুবই গঠনমূলক এবং ফলপ্রসূ”  হিসেবে মূল্যায়ন করলেও দিল্লি জানিয়েছে যে উভয় নেতা মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সমস্ত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা “ গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে”  সমাধান করা হবে।

India’s Prime Minister Narendra Modi. Photo: Bloomberg

তবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পেছনে খবরদারী করা রিপোর্টগুলো অনুসারে, দুই নেতার মধ্যে কিছু তীক্ষ্ণ মতবিনিময় ঘটে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মতে, ইউনূস মোদিকে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে শেখ হাসিনাকে – যিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে আছেন – “উদ্দীপনামূলক মন্তব্য” করা থেকে বিরত থাকতে বলেন, আবার মোদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নেতাকে এমন বক্তব্য পরিহার করতে বলেছিলেন, যা “আবহাওয়াকে বিষময় করে তুলতে পারে”।

বিশ্লেষকরা বলেন, এই সাক্ষাৎকার দুপক্ষের জন্য বিরল মতবিনিময়ের সুযোগ হলেও এটি এক ধরনের কৌশলগত বিরতি মাত্র – গত কয়েক মাসের অশান্তি ও পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক সমীকরণের পরপর নিজেদের অবস্থান বিশ্লেষণের একটি মুহূর্ত। কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হর্ষ পান্ত বলেন, “ এটি খুব অস্থির গত কয়েক মাসের পরস্পরের মূল্যায়নের জন্য একটি বৈঠক ছিল। আমি বর্তমানে ব্যাপক মেলামেশার প্রত্যাশা দেখছি না, তবে আশা করা যায় বক্তব্যের তীব্রতা কমিয়ে এনে এমন এক সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা চলছে, যেখানে স্বাভাবিকতার কিছুটা ফিরে আসা সম্ভব হবে”

দিল্লি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ডেইলি অবজার্ভার সংবাদ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ইউনাস মোদিকে জানিয়েছিলেন, সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রতিবেদনগুলো “অপরিমেয়ভাবে বাড়িয়ে দেখানো” হয়েছে।ভারতের মুখ্য উদ্বেগের অন্যতম কারণ হিসেবে ইউনূসের বেইজিংয়ের সাথে ক্রমবর্ধমান যুক্তিকে তুলে ধরা যেতে পারে। গত মাসে চীন সফরের সময়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী নেতাকে ঘিরে রিপোর্ট অনুযায়ী,  ভারতবর্ষের অদূরবর্তী উত্তরের সীমান্তের নিকট উপকূলীয় অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগের আহ্বান জানান – একটি এলাকা যা দিল্লি কৌশলগত সংবেদনশীলতা হিসেবে গণ্য করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলে কোনও চীনা নেতৃত্বাধীন অবকাঠামো প্রকল্প ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মতে, উল্লিখিত উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি করা, কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করা নয়। ডেইলি স্টারের অনুসারে, ঢাকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইউনূসের মন্তব্যগুলো দীর্ঘদিন গুরুত্বহীন থাকা এলাকায উন্নয়নের দিক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য করা হয়েছে।

হর্ষ পান্ত উল্লেখ করেন, ছোট-ছোট দক্ষিণ এশীয় দেশ সাধারণত ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু দিল্লির ধারনামতে, বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন “সমস্ত ডিম চীনা ঝুড়িতে রাখার” চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশি অন্তর্বর্তী নেতার সাথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জানপিংয়ের বৈঠকে, মার্চ ২৮ তারিখে হওয়া সাক্ষাৎকারের ছবি প্রকাশিত হলেও, বাস্তবতা হলো দিল্লি বাংলাদেশের নতুন শাসনব্যবস্থার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক হৃদ্যতাপূর্ণ যোগাযোগের পর।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, যখন একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারত ব্যাপকভাবে সমর্থন প্রদান করেছিল। পূর্বে এটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৪৭ সালের বিভাজনের পূর্বে উপনিবেশকালীন ভারতের অংশ ছিল।

অবিশ্বাসের মেঘ থাকলেও, কিছু বিশ্লেষক মোদি–ইউনাস সাক্ষাৎকে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্থিতিশীল করার দিকে একটি গঠনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন, যা গত কয়েক মাস ধরে চলা কূটনৈতিক চাপ ও ভুল সিদ্ধান্তের পর প্রয়োজনীয় মনে হয়।

ভারতের ও.পি. জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলছেন, “ এই সাক্ষাৎ দু’প্রতিবেশীর জন্য এক ধরনের শীতল মুহূর্ত ছিল, যাদের সম্পর্ক গত কয়েক মাসে জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছে।“  তিনি আরও বলেন, ইউনূসের মন্তব্য – যে ভারতের অভ্যন্তরীণ উত্তরের ভূখণ্ডকে আঞ্চলিক সামুদ্রিক প্রবেশের প্রধান দ্বার হিসেবে বাংলাদেশের নির্ধারণ করে – দিল্লির চীনের ব্যাপারে নিরাপত্তা উদ্বেগকে ত্বরান্বিত করেছে।

তবে, দত্ত আরও যুক্তি দেন, শেখ হাসিনার প্রস্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় যোগাযোগের সীমিত হওয়াতেও ভারতের কিছু অসুবিধা ছিল, এবং পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও ঢাকার নতুন প্রশাসন নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আসন্ন “ ইসলামিক শাসনের”  প্রচার করেছিল।

দিল্লি এমনভাবে বাংলাদেশের দিকে দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল যেন নতুন শাসনব্যবস্থার অধীনে সম্পর্ক অবশ্যম্ভাবীভাবে অবনমিত হবে, যখন ঢাকার জন্য স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছিল। পূর্বের মত বিশ্বাস পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হবে, এ কথাটি দত্ত স্পষ্ট করলেন।

তিনি আরও বলেন, “ মোদি-ইউনূস সাক্ষাৎকে কেবল একটি শুভ ইচ্ছা হিসেবে দেখার প্রয়োজন, যা কিছুটা দ্বিপাক্ষিক স্পষ্ট আলাপচারিতার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক বহু-পাক্ষিক নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ভারত প্রধানত কাজ করছে”

বাংলাদেশে আগামী বছর গোড়ার দিকে কিংবা বছরের শেষের দিকে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। লন্ডনে বসবাসরত এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত লেখাপড়া করা প্রিয়জিত দেব সারকার বলছেন, মোদি-ইউনূস সাক্ষাৎ পরবর্তীতে “পারস্পরিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির এক মহাসড়ক” উদ্ভাবনে সহায়ক হতে পারে।

তিনি যোগ করেন, “ বাংলাদেশ ও ভারতের গভীর শেকড় ও সংযোগ রয়েছে, যা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। উভয় দেশেরই তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বাস্তববাদী হওয়া জরুরী”।

অতীতে, বাংলাদেশের থেকে ভারতের উত্তরের দিকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চালান থামানোর ঘটনা বাস্তবসম্মত নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ ছিল, তবে দেবসারকার ব্যাখ্যা করেন, দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ ধরনের সমস্যা সহজেই সমাধান করা যেতে পারে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024