সারাক্ষণ রিপোর্ট
টোকিওতে কৃষকদের নজিরবিহীন প্রতিবাদ
জাপানের কেন্দ্রীয় টোকিওর বিলাসবহুল এলাকায় সাম্প্রতিক কৃষক বিক্ষোভে ব্যতিক্রমী দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বহু কৃষক ট্রাক্টর নিয়ে শহরের রাস্তায় নেমে আসেন। তারা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বলেন, “চাষিরাই জাতির সম্পদ” এবং “চাল ছাড়া জীবন নেই”। এই আন্দোলনের আয়োজক কৃষক কান্নো ইয়োশিহিদে জানান, কৃষি থেকে আয় কমে যাওয়া এবং কৃষকদের বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকেই পেশাটি ছেড়ে যাচ্ছেন। তিনি এই বিক্ষোভকে ‘রেইওয়া যুগের কৃষক বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করেন এবং বলেন, “এই প্রথম এত বড় পরিসরে আমরা রাস্তায় নামলাম।”
চালের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি
গত বছর চালের ঘাটতির কারণে অনেক দোকানের তাক ছিল ফাঁকা। যদিও এখন চাল পাওয়া যাচ্ছে, দাম আকাশছোঁয়া। মার্চ মাসে টোকিওতে চালের দাম আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার জরুরি মজুদের ২ লাখ ১০ হাজার টন চাল বাজারে ছেড়েছে।
রাজনৈতিক চাপ ও গ্রামীণ অসন্তোষ
জাপানে বিরোধী দল দুর্বল হলেও ভোক্তা ও গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে বেড়ে চলা ক্ষোভ আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে। এই সংকট জাপানের খাদ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করেছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে এটি কতটা অরক্ষিত, তা স্পষ্ট হয়েছে।
সংকটের পেছনে মূল কারণ
২০২৩ সালের গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপদাহ চালের ফলনে ব্যাপক ক্ষতি করে। কারণ চাল বছরে একবার চাষ হয় এবং একবারেই মজুদ ও বিতরণ হয়, তাই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। এদিকে যুদ্ধের কারণে আমদানি খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল তুলনামূলক সস্তা হয়ে ওঠে। রেস্তোরাঁগুলো চাল মজুদ করে, পর্যটক ফেরায় চাহিদা বাড়ে এবং একটি সম্ভাব্য বড় ভূমিকম্পের সতর্কতায় অনেকে আগেভাগে চাল কিনে রাখে।
টোকিওর চাল ব্যবসায়ী আকিজাওয়া মারিয়ে বলেন, “সংকট নিয়ে সংবাদ দেখে মানুষ আতঙ্কে চাল কিনে রেখেছে।”
দীর্ঘদিনের নীতির ফলাফল
জাপান ১৯৭০-এর দশকে চাল উৎপাদন সীমিত করতে ‘গেনতান সেসাকু’ নামের একটি নীতি চালু করেছিল। তখন চালের চাহিদা কমছিল, তাই অতিরিক্ত উৎপাদন রোধে কৃষকদের কম চাষের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হতো। যদিও ২০১৮ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল হয়, তবুও বিভিন্ন ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের চাল থেকে অন্য ফসলের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
এশিয়ান গ্রোথ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হোন্মা মাসায়োশি বলেন, এই ব্যবস্থায় সামান্য অস্বাভাবিকতাই বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
নিরাপত্তা ও নীতিতে পরিবর্তনের দাবি
১৯৯৩ সালের আগের চাল সংকট বাজার উন্মুক্তকরণ ও জরুরি মজুদ গঠনের পথ দেখায়। বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতার হার (২০২৩ সালে মাত্র ৩৮ শতাংশ) বাড়ানো নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে চাল রপ্তানি সাতগুণ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
তবে কৃষকরা প্রশ্ন করছেন, “চাষ করবে কে?” ২০২৪ সালে রেকর্ড সংখ্যক কৃষক দেউলিয়া বা কাজ বন্ধ করেছেন। এর ৬০ শতাংশের বেশি বয়স সত্তরের ওপরে।
সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিতে মতভেদ
প্রশাসন বড় আকারে চাষাবাদে গুরুত্ব দিলেও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজুকি নোবুহিরো বলেন, জাপানের পাহাড়ি ও খণ্ডিত জমির কারণে বড় চাষাবাদ বাস্তবায়ন কঠিন। তিনি ছোট কৃষকদের সুরক্ষার আহ্বান জানান, কারণ অনেকেই আগেই নির্ধারিত দামে চাল বিক্রি করে দিয়েছেন এবং বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি থেকে লাভ পাননি।
উত্তর জাপানের চালচাষি তেনমিও নোবুহিরো বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে কৃষি খাত থেকে মানুষ আরও সরে যাবে। আর শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই মূল্য দিতে হবে।”
Leave a Reply