সারাক্ষণ রিপোর্ট
উৎপাদন বনাম ভোক্তা উদ্দীপনা
গত কয়েক বছরে দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা চীনা সরকারকে অনুরোধ করেছেন গৃহস্থালীর ব্যয় বাড়াতে, যাতে ধীরগতির অর্থনীতিকে আরো জোর দিয়ে এগিয়ে নিতে পারে। তবে শি জিনপিং নেতৃত্বাধীন প্রশাসন আদতে উৎপাদনমুখী নীতিতে বিশ্বাসী, ফলে ভোক্তা-উদ্দীপনার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এর ফল প্রতিদিনই স্পষ্ট হচ্ছে—বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে ভোগের চাহিদা ক্রমেই নিচে নামছে।
উৎপাদন-ভোগের ব্যবধানের বৃদ্ধি
চীন এখন উপকরণ বানাচ্ছে, কিন্তু তা বিক্রি করছে কমই। ভোক্তা আস্থা কমেছে—বাজারে বড় ধরনের লোকসান হওয়ার পরে মানুষ সঞ্চয়ের দিকে সরে যাচ্ছে। একই সময়ে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে কর্পোরেট মুনাফাও সংকুচিত, ফলে বড় কোম্পানিগুলো বিদেশি বাজারে দৃষ্টি দেয়া ছাড়া পথ পাচ্ছে না।
বাণিজ্য যুদ্ধ ও শুল্ক চাপ
গত বছর চীনের ট্রেড সারপ্লাস প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা আমেরিকার ক্ষোভ উসকে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যা কোনো দেশের জন্য এতটা কড়া কখনোই হয়নি।
দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাবের ঝুঁকি
“যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র করছে। রপ্তানি বদল, অন্য দেশে ডাম্পিং বা মুদ্রাস্ফীতি—দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাব চীনের জন্য বড় ঝুঁকি,” সতর্ক করেন নীলকণ্ঠ মিশ্র, ইনডিয়ার অ্যাক্সিস ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ। মুদ্রাস্ফীতি চাপ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস, দীর্ঘমেয়াদি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস থাকা সত্ত্বেও দুর্বল বহিরাগত ব্যালেন্স শিট—এসব একসঙ্গে চীনের সমাধি খোঁড়ার পথ তৈরি করছে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও চীনের প্রতিক্রিয়া
চীনা কর্মকর্তারা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক চাপে অবশেষে তারা ভোগ-উদ্দীপনা বাড়ানো এবং সামাজিক নিরাপত্তা জাল শক্তিশালী করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। “টারিফের জবাবে ভোক্তা-চাহিদা বাড়াতে হলে উৎপাদন-কেন্দ্রিক নীতি পরিত্যাগ করাও সহজ হবে,” বলেন এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে নতুন আশার সুর
বেইজিংয়ে মার্চের শেষে অনুষ্ঠিত চিনা ডেভেলপমেন্ট ফোরামে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন—ট্রাম্পের নীতি চীনের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনবে ভোক্তা-কেন্দ্রিক পরিকল্পনার দিকে।
ঘরোয়া চাহিদা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
বিদেশি বাজারে রপ্তানি বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে, কারণ তৃতীয় দেশগুলো আমেরিকার শুল্ক থেকে সরে আসছে। “শিথিল বৈশ্বিক চাহিদা চীনের রপ্তানি সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত করবে,” সতর্ক করেন জেপি মরগানের চীনা প্রধান অর্থনীতিবিদ হাইবিন ঝু। ট্রান্সশিপমেন্ট বা বিদেশি বিনিয়োগ দিয়েও চীন শুল্ক ফাঁকি দিতে পারবে না, অন্যরা নিজস্ব শিল্প রক্ষায় সুরক্ষা শুল্ক বাড়াতে পারে।
নীতিগত প্রতিবন্ধকতা
ভোক্তা-উদ্দীপনা বাড়ানো চীনের জন্য সহজ নয়।“তাদের কাছে দ্রুত আয় বৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকর উপায় সরকারি বিনিয়োগ,” বলেন ঝু। যদিও সেটি ভোগের বাইরেও গণ্য, পরিকল্পিত সরকারি প্রকল্পগুলোতে ফিরে গেলে স্থায়ী সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ মিস হবে।
স্থিতিশীলতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
বিশ্ব চীনের স্থিতিশীলতাকে বেশ প্রশংসা করেছে—যেখানে উন্নত মানের চিপ তৈরি হয়, এআই উদ্ভাবন হয়, ও জনসংখ্যা ঝুঁকি সামলাতে রোবটিক্স ও প্রযুক্তি সমাধান চলে। ৩.২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ও শক্তিশালী মুদ্রানিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চীনের বড় হাতিয়ার।
যুক্তরাষ্ট্রের মন্দা ও গবেষণা সংকোচ
অন্যদিকে, জেপি মরগানের নিউইয়র্ক বিভাগ এখন ইউনাইটেড স্টেটসে মন্দার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশের শুরু নিয়ে আলোচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের শুল্ক-নীতি এবং বাইডেনের সাবসিডি মিলিয়ে উদ্ভাবনী গতিকে ধাক্কা দেবে। NIH, NSF ও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা বাজেট কাটা হচ্ছে, কঠোর ইমিগ্রেশন নীতি মেধা স্রোত ঘিরে রাখছে।
ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট
চীনের দৃষ্টিতে এখন যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো ‘সোনার সড়ক’ নয়—বরং এক বিকাশমান সাংস্কৃতিক পরিবর্তন চলছে। তাই আগামী মাসগুলোতে শেষ হাসি হাসতে পারে চীন, এমনটাই মত বেশিরভাগের।