সারাক্ষণ রিপোর্ট
হাইকোর্টের আদেশ
৩০ এপ্রিল ২০২৫-এ বিচারপতি মো. আতওয়ার রহমান ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রাষ্ট্রদ্রোহ ও জাতীয় পতাকা অবমাননার মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন-সংক্রান্ত রুলকে ‘অ্যাবসোলুট’ ঘোষণা করে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন।
মামলার সূত্রপাত: পতাকা বিতর্ক
২৫ অক্টোবর ২০২৪-এর চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে দাসের নেতৃত্বে হওয়া এক সমাবেশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকার ওপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলনের অভিযোগ ওঠে। ঘটনা প্রকাশ্যে এলে ৩১ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় স্থানীয় বিএনপি নেতা ফিরোজ খান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরবর্তীতে বিএনপি তাদের ওই নেতাকে এ ধরনের মামলা করার দায়ে বহিস্কার করে।
গ্রেপ্তার, সংঘর্ষ ও প্রাণহানি
২৬ নভেম্বর ২০২৪-এ ঢাকার শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দাসকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হলে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ বেধে যায়। কনস্টেবল, দাঙ্গা পুলিশ ও টিয়ার গ্যাসের মাঝে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত এবং অন্তত ৩৭ জন আহত হন; পরদিন আইনজীবীরা আদালত বর্জনের ডাক দেন। এবং সেখানে চিম্ময় দাস এর পক্ষে কোন আইনজীবিকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে সিনিয়র আইনজীবি রবীন ঘোষ পুলিশ প্রহরায় একবার জামিনের আবেদনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনিও নানা চাপের মুখে আদালত এ যাওয়া থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
জামিন আবেদনগুলোর ইতিহাস
- ২ জানুয়ারি ২০২৫: চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত জামিন নামঞ্জুর করে।
•৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: হাইকোর্ট জামিন-সংক্রান্ত রুল জারি করে রাষ্ট্রকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন।
• ২৩ এপ্রিল ২০২৫: রুল শুনানির তারিখ ঠিক হয় ৩০ এপ্রিল। শেষমেশ হাইকোর্টের আজকের আদেশে জামিন পেলেন দাস।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস—কে এই নেতা?
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট
সাতকানিয়া-জন্ম নেওয়া দাস ২০১৬-২০২২ সালে ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন; ২০২৪-এর জুলাইয়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষায় গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’-এর মুখপাত্র হিসেবে তিনি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক গঠনের দাবি তোলেন এবং শত শত অনুসারী নিয়ে চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করেন।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন
দাসের গ্রেপ্তারের পর ২৭ নভেম্বর ২০২৪-এ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানায়। ঢাকা ওই বিবৃতিকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য’ আখ্যা দিয়ে দুর্ভাগ্যজনক বলে প্রতিক্রিয়া জানায়।
আইনি দৃষ্টিতে বর্তমান অবস্থান
দাসের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২৪-ক (রাষ্ট্রদ্রোহ) ধারা ও জাতীয় পতাকা বিধি-লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। জামিন পেলেও মামলার তদন্ত অব্যাহত থাকবে; অভিযোগপত্র গঠন হলে তাঁকে নিয়মিত বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। আইনজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রদ্রোহ ধারার শাস্তি তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে, ফলে দাসের আইনি লড়াই এখনো দীর্ঘ।
পরবর্তী পদক্ষেপ
- মামলার তদন্তে পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে;আসামিপক্ষ বলছে, ভিডিও-ফুটেজে দাস পতাকা উত্তোলনে সরাসরি জড়িত নন।
• হাইকোর্টের আদেশ আজই আদেশের কপি জেলখানায় পৌঁছালে দাস মুক্তি পাবেন।
• সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো ১ মে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ‘ধন্যবাদ সভা’ ও পূজা আয়োজন করছে, যেখানে দাস ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিতে পারেন।
দীর্ঘ ছ’মাসের আইনি টানাপোড়েনের পর জামিন পেলেও, দাস ও তাঁর সংগঠনের সামনে ষড়যন্ত্রমুক্ত তদন্ত, রাজনৈতিক সমীকরণ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার চ্যালেঞ্জ এখনো বহাল থাকল।