স্বদেশ রায়
পহেলা বৈশাখ একদা হালখাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এই হালখাতার স্মৃতি লিখতে গিয়ে প্রিয় লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে হালখাতার মিষ্টি খেয়ে ফেরার এক কাল বৈশাখির গোটা স্মৃতিটাই লিখেছেন।
আসলে এই এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাস জুড়ে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রার হেরফেরের ফলে বাংলাদেশে কাল বৈশাখি হয়। তাই কাল বৈশাখি আর বাংলাদেশের জীবন, বাঙালির জীবন কোনোমতেই আলাদা করা যায় না। বরং কখনও কখনও কাল বৈশাখি বাঙালির বীরত্বের ও আত্মজাগানিয়ার প্রতীকও হয়ে ওঠে। নজরুলের দরাজ গলায় যা শোনা যায়, ওরে ও কাল বৈশাখি, কাটাবি কাল বসে কি?
আসলে জীবনটা বড় অদ্ভুত। কখনও কখনও বসে বসে কাল কাটানোও যেমন সত্য, তেমনি জীবনে কাল বৈশাখি আসাও সত্য। আর মানুষের জীবনের সঙ্গে সেই রূপান্তরের প্রথম স্তর থেকে যেমন প্রকৃতি জড়িয়ে গেছে, তেমনি জড়িয়ে গেছে বিশ্বাস ও অলৌকিকতার ওপর আস্থা। মানুষ তার বোধ, জ্ঞান ও চর্চা দিয়ে জানে এর কোনো অর্থ নেই। তবুও সে ওই অলৌকিকতার থেকে বের হতে পারে না।
যেমন আমার জন্ম শনিবারে। জন্মের দিন সেদিনের যৌথ পরিবারের বাড়িতে ছিলো সংগীত ও নাট্যপালার আসর। মা সারাজীবন বিশ্বাস করে গেছেন, শনিবারে জন্ম, হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে আমার জীবন পার করতে হবে। আবার যেহেতু জন্মের সময় বাড়িতে সংগীত ও নাট্যপালার আসর ছিলো, তাই সংস্কৃতি জগতই আমার প্রাণের সম্পদ। মায়ের বিশ্বাস, কোনো ছেলে আছে পৃথিবীতে যাকে তুচ্ছ মনে করে! ঠিক হোক আর না হোক, সেটাই তো সে মাথায় তুলে রাখবে।
তেমনি কোনো নতুন বউ যদি ঝড় জল মাথায় নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে, তাহলে সকলে ধরে নেয়, ঝড়ের রাতে এসেছে সে—নিশ্চয়ই সে ঝড়ের সাথী। না হয় ঝড়কে করেছে সে নিজেই সাথী।
মানুষ আসলে স্বাভাবিকের বাইরে কোনো কিছু ঘটলেই মনে রাখে সেটা। তাকে নিয়ে তার থাকে নানান কৌতূহল। এই যে আমার মতো একজন অপগণ্ডের জন্ম—এ দিনটি মা এত বেশি মনে রেখেছিলেন, তার শেষ সন্তান হিসেবে নয়, আসলে ওই দিন মার লেবার প্রেসার ওঠার কথা ছিলো না। অথচ সংগীত ও নাটকের এক আনন্দময় দিনে হঠাৎ ডাক্তার বাড়িতে আরও ডাক্তারকে আসতে হলো।
কাল বৈশাখিকে শুধু মুস্তফা সিরাজ বা নজরুল নয়, অজস্র বড় মানুষেরা মনে রেখেছেন মনে হয় এ কারণে—সে আসে জানান না দিয়ে, হঠাৎ এক ভয়ংকর সুন্দর হিসেবে। অথচ তার আসার সকালেও কেউ জানতে পারে না, দুপুরেও কেউ জানতে পারে না সে আজ আসবে। বরং মানুষ অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
যেমন এই ঢাকার এক কাল বৈশাখির কথা আজ মনে আসছে। সেদিন সকাল থেকে বৈশাখ অনেক বেশি তপ্ত ছিলো। তখনও ঢাকায় জল কিনতে পাওয়া যেত না। অথচ সেদিনটাতে যেমন উত্তেজনা ছিলো, তেমনি কেন যেন মনমরাও ছিলাম। যেখানে যাব সেখানে যাবার আগে তাই রামপুরায় এক বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। তখনও তপ্ত দুপুর আসেনি। তারপরেও গরমে ঘামে ভিজে দরদর হয়ে গেছি। ভাগনিকে পানি দিতে বললেই সে বলল, মামা, মেরাদিয়ার ওই দিক থেকে বিল দিয়ে শুধু মানুষ আর মানুষ আসছে সকাল থেকে। তারা পানি খেতে চাওয়ায় বাসার সব পানি শেষ। তখন ঢাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আজকের মতো উন্নত ছিলো না। ভাগনি তাদের পাশের বাসা থেকে আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে।
সেদিনের সেই রাস্তা ভরা মানুষের মিছিলে যত মানুষকে দেখেছিলাম তারা সকলে তৃষার্ত ছিলো। অথচ রাস্তার পাশে কোনো জল ছিলো না। আসলে মনে হয় পৃথিবীতে এমন এমন সময় আসে যখন পান করার জন্যে জল কমে যায়, নিঃশ্বাস নেবার জন্যে নির্মল বাতাস কমে যায়। আর তখন উদভ্রান্তের মতো সকলে যে পথে চলছে, সে পথেই চলতে হয়।
সেই মানুষের মিছিল, সেই সেই তপ্ত-দুপুর সেদিন বিকেল হতেই শুধু শান্ত নয়, জলে ভরে গিয়েছিলো। সব মানুষের চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো তীব্র কাল বৈশাখির তাণ্ডবে। রাস্তায় রাস্তায় উপড়ে পড়েছিলো গাছ। তা কোনো সন্ত্রাসীরা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কাটেনি। কাল বৈশাখি তার দারুণ শক্ত হাতে টেনে টেনে উপড়ে ফেলেছিলো সেই গাছ। মানুষেরা ভিজেছিলো ঝড় আর জলে।
মানুষ তার বিবর্তনের শুরু থেকেই যুথবদ্ধ। তাই কখনও কখনও সে কোনো কিছুকে উপলক্ষ করে যদি যুথবদ্ধ হয়, তখন কাল বৈশাখি তার কাছে কী প্রতীক হয়—তা কখনো ভেবে দেখিনি। মায়ের সন্তান জন্মের দিন হলে তিনি হয়তো তার ঠিকুজি খুঁজতেন।
তবে তারপরেও মানুষ সেই সব দিন, সেই সব মানুষকে ভালোবাসে যারা ঝড়কে করে জীবনের সাথী। তাই তো হয়তো বাংলা ভাষায় বড় মিষ্টি শব্দ—ঝড়ের সাথী, ঝড়ের পাখি। আর সে ঝড় যদি কাল বৈশাখি হয় তাহলে তো তার সঙ্গে একটা বীরত্ব থাকে।
আসলে বাংলাদেশের এই আরেক চিন্তার বৈচিত্র্য। ঘূর্ণিঝড়গুলো কাল বৈশাখির চেয়ে অনেক শক্তিশালী থাকলেও, তাকে মানুষ চিহ্নিত করে মৃত্যুর কারণ হিসেবে—যদিও সে জানিয়ে আসে। আর কাল বৈশাখি না জানিয়েই আচমকা এসে তার দাপট দেখিয়ে চলে যায় বলেই কাল বৈশাখিকে বাঙালি তার জীবনে নিয়েছে বীরত্বের প্রতীক হিসেবে। আমার আগমন যদি কাল বৈশাখিতে হতো, মা হয়তো বলতেন, আমি বীর হবো। আমার ভেতর থাকতো নজরুলের সেই শক্তি—ওরে ও কাল বৈশাখি, কাটাবি কাল বসে কি?
আসলে কি কাল বৈশাখির সঙ্গে বীরের জীবনের কোনো সম্পর্ক আছে? ভাগ্যবাদের মানুষ মানতে পারে। তবে কোনো কোনো মানুষের জীবন যে কাল বৈশাখির মতোই হঠাৎ হঠাৎ ঝড়ের সঙ্গে আলবাট্রাসের মতো—তাও তো সত্য। আবার সব আলবাট্রাসের ডানা ঝড়ে ভাঙে না—এও তো সত্য। যেমন সত্য মুস্তফা সিরাজের মতো সকলেরই কোনো না কোনো একটা কাল বৈশাখির কথা মনে থাকে। সব কাল বৈশাখি মানুষের জীবনে দাগ কাটে না। আবার কোনো একটা কাল বৈশাখিটি তার জীবনের অনেক কিছুর মতোই একটা অংশ হয়ে যায়। অলৌকিকতায় অবিশ্বাসী হয়েও সে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে—ঝড়কে করেছো সাথী।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.