০১:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
পাকিস্তানে সীমাহীন শ্রমিক শোষণ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাসাদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক: ক্লিওপেট্রা ও সিজারের কথোপকথন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪৯) বাংলাদেশে ইভ টিজিং- নারী মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সংকট এপি’র প্রতিবেদন: হাসিনা-বিরোধী বিদ্রোহের পরিণতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ মধুমতী নদী: দক্ষিনের যোগাযোগ পথ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল ধ্বংস করা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর চিরসবুজ নায়িকা মৌসুমী: রূপালী পর্দার এক যুগের প্রতীক কাপ্তাই লেকের মাছের বৈচিত্র্য ও মাছ ধরার রীতি – পার্বত্য চট্টগ্রামের জলে জীবনের গল্প বাংলাদেশ–চায়না আপন মিডিয়া ক্লাব ও ডিআরইউ মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর

মিয়ানমারের বিরল খনিজ : এবং ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি

এক নতুন ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা

বিশ্ব এখন প্রবেশ করছে এক জটিল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার যুগে, যেখানে কেবল অস্ত্র নয়, খনিজও হয়ে উঠেছে যুদ্ধের কৌশলগত হাতিয়ার। যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠান্ডা যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ে “রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস” বা বিরল খনিজ একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিচ্ছে। ইলেকট্রিক গাড়ি, হাই-টেক চিপস, ক্ষেপণাস্ত্র ও সবুজ প্রযুক্তি—সব কিছুর জন্য এই খনিজ অপরিহার্য। এর প্রক্রিয়াজাতকরণ চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, কাঁচামালের আরেক উৎস এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ মিয়ানমার।

খনিজের জন্য সংঘাত: শান বনাম কাচিন

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে বিগত এক দশক ধরে চলে আসা সংঘাত, বিশেষ করে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (KIA)-র সঙ্গে জান্তা সরকারের বিরোধ, চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল শান রাজ্যের দিকে। এখানে ইউডব্লিউএসএ (United Wa State Army) নামের শক্তিশালী এক চীন-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী কার্যত একটি স্বশাসিত অঞ্চল পরিচালনা করে।

চীন-মিয়ানমার: এক দ্বৈত সম্পর্ক

চীন বহুদিন ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এক অনানুষ্ঠানিক রক্ষাকবচ। নিরাপত্তা পরিষদের অবরোধ নাকচ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও সামরিক চুক্তি পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে চীনের সমর্থন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে পরোক্ষ সহযোগিতা করেছে। এর পাশাপাশি চীন তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছে স্থানীয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে, যাদের দিয়ে তারা খনিজ আহরণ ও পরিবহন অব্যাহত রেখেছে।

নতুন খনিগুলোর বাস্তবতা

স্যাটেলাইট চিত্র ও মিয়ানমারভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শান রাজ্যের মংহসাত ও মংইউন এলাকার পার্বত্য ঢালে নতুন রেয়ার আর্থ খনি গড়ে উঠছে।

  • প্রায় ১০০ জন শ্রমিক নিয়মিতভাবে খনন ও রাসায়নিক লিচিং কার্যক্রমে নিয়োজিত।
  • এই খনিগুলোতে চীনা ভাষায় সাইনবোর্ড, লোগো এবং ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
  • United Wa State Army এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও চলাচলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।

আইনি ফাঁক ও ব্যয় হ্রাস

লন্ডনভিত্তিক বেঞ্চমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক নেহা মুখার্জির মতে, মিয়ানমারের শিথিল পরিবেশ আইন ও দুর্বল পর্যবেক্ষণ কাঠামোর কারণে চীনা কোম্পানিগুলো এখানে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় সাত গুণ কম খরচে ভারী রেয়ার আর্থ অক্সাইড উৎপাদন করতে পারছে। পরিবেশগত মূল্য প্রদান ছাড়াই তারা বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবহার করছে, যা মাটির গুণমান, জলাধার ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে।

বাজারদর ও জোগান সংকট

বিশ্ববাজারে রেয়ার আর্থের দাম বেড়েই চলেছে।

  • ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে টার্বিয়াম অক্সাইডের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি।
  • ডিসপ্রোসিয়ামের মতো অপরিহার্য উপাদানের দামও অস্থির হয়ে উঠেছে।
  • চীনের রপ্তানি-নিয়ন্ত্রণ কঠোর হওয়ায় ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর এবং ইভি শিল্পে জোগানসংকট তৈরি হয়েছে।

একটি রাজনৈতিক ও পরিবেশগত সংকট

চীনের এই খনিজ নীতি কেবল অর্থনৈতিক কৌশল নয়, এটি তার ভূরাজনৈতিক বলয়ের অংশ। এশিয়ায় চীনের বলয় সম্প্রসারণের একটি নীরব উপায় এই খনিজ দখলনীতি। তবে এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের গভীর উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।

  • শানে খননকাজে কোনো পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়াই রাসায়নিক লিচিং চালানো হচ্ছে।
  • স্থানীয় আদিবাসীদের ভূমি ও পানির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
  • কোনও আন্তর্জাতিক নজরদারি না থাকায়, এই পুরো খনিজ শৃঙ্খল কার্যত এক ‘গ্রে জোনে’ পরিচালিত হচ্ছে।

ক্রিটিক্যাল মিনারেল নাকি নতুন উপনিবেশ?

বিশ্ব এখন সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের পথে। এ জন্য প্রয়োজন লিথিয়াম, কোবাল্ট, রেয়ার আর্থ—যাদের উপর নির্ভর করছে বৈশ্বিক জ্বালানি ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই খনিজ আহরণ যদি হয় মিলিশিয়া ও অনিয়ন্ত্রিত শাসনের আশ্রয়ে, তাহলে পরিবেশ ও রাষ্ট্র কতটা বিপন্ন হবে—এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক নজরদারি ও ন্যায্যতা-নির্ভর সরবরাহ চেইন ছাড়া এই খনিজ ভবিষ্যৎ এক নতুন ধরণের “উপনিবেশ” তৈরি করতে পারে—যেখানে উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি পাবে আর দরিদ্র অঞ্চলগুলি দূষণ ও শোষণের শিকার হবে।

মিয়ানমারের রেয়ার আর্থ খনিজ এখন কেবল একটি শিল্পপণ্য নয়—এটি ভূরাজনীতি, মানবাধিকার এবং পরিবেশ নীতির জটিল এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। চীন এই ভূ-অর্থনৈতিক খেলার চালক হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা—সবুজ প্রযুক্তির দিকে এগোতে গিয়ে যেন আমরা আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞের রাস্তায় না হাঁটি।

পাকিস্তানে সীমাহীন শ্রমিক শোষণ

মিয়ানমারের বিরল খনিজ : এবং ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি

০৯:০০:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

এক নতুন ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতা

বিশ্ব এখন প্রবেশ করছে এক জটিল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার যুগে, যেখানে কেবল অস্ত্র নয়, খনিজও হয়ে উঠেছে যুদ্ধের কৌশলগত হাতিয়ার। যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠান্ডা যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ে “রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস” বা বিরল খনিজ একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিচ্ছে। ইলেকট্রিক গাড়ি, হাই-টেক চিপস, ক্ষেপণাস্ত্র ও সবুজ প্রযুক্তি—সব কিছুর জন্য এই খনিজ অপরিহার্য। এর প্রক্রিয়াজাতকরণ চীনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, কাঁচামালের আরেক উৎস এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ মিয়ানমার।

খনিজের জন্য সংঘাত: শান বনাম কাচিন

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যে বিগত এক দশক ধরে চলে আসা সংঘাত, বিশেষ করে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (KIA)-র সঙ্গে জান্তা সরকারের বিরোধ, চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল শান রাজ্যের দিকে। এখানে ইউডব্লিউএসএ (United Wa State Army) নামের শক্তিশালী এক চীন-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠী কার্যত একটি স্বশাসিত অঞ্চল পরিচালনা করে।

চীন-মিয়ানমার: এক দ্বৈত সম্পর্ক

চীন বহুদিন ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এক অনানুষ্ঠানিক রক্ষাকবচ। নিরাপত্তা পরিষদের অবরোধ নাকচ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও সামরিক চুক্তি পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে চীনের সমর্থন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে পরোক্ষ সহযোগিতা করেছে। এর পাশাপাশি চীন তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছে স্থানীয় মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে, যাদের দিয়ে তারা খনিজ আহরণ ও পরিবহন অব্যাহত রেখেছে।

নতুন খনিগুলোর বাস্তবতা

স্যাটেলাইট চিত্র ও মিয়ানমারভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শান রাজ্যের মংহসাত ও মংইউন এলাকার পার্বত্য ঢালে নতুন রেয়ার আর্থ খনি গড়ে উঠছে।

  • প্রায় ১০০ জন শ্রমিক নিয়মিতভাবে খনন ও রাসায়নিক লিচিং কার্যক্রমে নিয়োজিত।
  • এই খনিগুলোতে চীনা ভাষায় সাইনবোর্ড, লোগো এবং ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
  • United Wa State Army এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও চলাচলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।

আইনি ফাঁক ও ব্যয় হ্রাস

লন্ডনভিত্তিক বেঞ্চমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষক নেহা মুখার্জির মতে, মিয়ানমারের শিথিল পরিবেশ আইন ও দুর্বল পর্যবেক্ষণ কাঠামোর কারণে চীনা কোম্পানিগুলো এখানে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় সাত গুণ কম খরচে ভারী রেয়ার আর্থ অক্সাইড উৎপাদন করতে পারছে। পরিবেশগত মূল্য প্রদান ছাড়াই তারা বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবহার করছে, যা মাটির গুণমান, জলাধার ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে।

বাজারদর ও জোগান সংকট

বিশ্ববাজারে রেয়ার আর্থের দাম বেড়েই চলেছে।

  • ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে টার্বিয়াম অক্সাইডের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি।
  • ডিসপ্রোসিয়ামের মতো অপরিহার্য উপাদানের দামও অস্থির হয়ে উঠেছে।
  • চীনের রপ্তানি-নিয়ন্ত্রণ কঠোর হওয়ায় ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর এবং ইভি শিল্পে জোগানসংকট তৈরি হয়েছে।

একটি রাজনৈতিক ও পরিবেশগত সংকট

চীনের এই খনিজ নীতি কেবল অর্থনৈতিক কৌশল নয়, এটি তার ভূরাজনৈতিক বলয়ের অংশ। এশিয়ায় চীনের বলয় সম্প্রসারণের একটি নীরব উপায় এই খনিজ দখলনীতি। তবে এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের গভীর উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে।

  • শানে খননকাজে কোনো পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়াই রাসায়নিক লিচিং চালানো হচ্ছে।
  • স্থানীয় আদিবাসীদের ভূমি ও পানির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
  • কোনও আন্তর্জাতিক নজরদারি না থাকায়, এই পুরো খনিজ শৃঙ্খল কার্যত এক ‘গ্রে জোনে’ পরিচালিত হচ্ছে।

ক্রিটিক্যাল মিনারেল নাকি নতুন উপনিবেশ?

বিশ্ব এখন সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরের পথে। এ জন্য প্রয়োজন লিথিয়াম, কোবাল্ট, রেয়ার আর্থ—যাদের উপর নির্ভর করছে বৈশ্বিক জ্বালানি ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই খনিজ আহরণ যদি হয় মিলিশিয়া ও অনিয়ন্ত্রিত শাসনের আশ্রয়ে, তাহলে পরিবেশ ও রাষ্ট্র কতটা বিপন্ন হবে—এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক নজরদারি ও ন্যায্যতা-নির্ভর সরবরাহ চেইন ছাড়া এই খনিজ ভবিষ্যৎ এক নতুন ধরণের “উপনিবেশ” তৈরি করতে পারে—যেখানে উন্নত বিশ্ব প্রযুক্তি পাবে আর দরিদ্র অঞ্চলগুলি দূষণ ও শোষণের শিকার হবে।

মিয়ানমারের রেয়ার আর্থ খনিজ এখন কেবল একটি শিল্পপণ্য নয়—এটি ভূরাজনীতি, মানবাধিকার এবং পরিবেশ নীতির জটিল এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। চীন এই ভূ-অর্থনৈতিক খেলার চালক হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা—সবুজ প্রযুক্তির দিকে এগোতে গিয়ে যেন আমরা আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞের রাস্তায় না হাঁটি।