যুদ্ধবিরতির মুহূর্তে ঐতিহাসিক ডাক
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কিছুটা বিরতি এসেছে। এই সঙ্কটের আবহে প্যারিসে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের নির্বাসিত যুবরাজ রেজা পাহলভী ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে তাঁর পরিকল্পনা উত্থাপন করেছেন। এটিই ছিল তাঁর সবচেয়ে সরাসরি ও স্পষ্টতর রাজনৈতিক আহ্বান—শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পদত্যাগ এবং ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC)-এর বিলুপ্তির আহ্বান।
শাসকগোষ্ঠীকে সরাতে সরাসরি চ্যালেঞ্জ
পাহলভী তাঁর ভাষণে বলেন, “আলী খামেনির প্রতি আমার সরাসরি আহ্বান—পদত্যাগ করুন। তা হলে আপনি একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায্য বিচারের সুযোগ পাবেন, যা আপনি কোনো ইরানিকে দেননি।”
তিনি আরও বলেন, যারা “ইরানির রক্তে হাত রাঙিয়েছেন” তাদের বিচার হবে, তবে একই সঙ্গে যেসব সামরিক, পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা এখনো ইসলামি প্রজাতন্ত্র নয়, বরং ইরানি জাতির প্রতি দায়বদ্ধ, তাঁদের জন্য একটি ‘গণতান্ত্রিক ইরানে’ স্থান রাখা হবে—তবে শর্ত একটাই: এখনই জনতার পাশে দাঁড়াতে হবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য ‘চ্যানেল‘ খোলা
পাহলভী ঘোষণা দিয়েছেন, একটি সুরক্ষিত চ্যানেল খোলা হয়েছে যেখানে ইরানের সামরিক, নিরাপত্তা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবেন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁদের আহ্বান জানাচ্ছেন IRGC ত্যাগ করে নতুন আন্দোলনে যোগ দেওয়ার।
IRGC: ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ছায়া রাষ্ট্র
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর IRGC গঠিত হয় একটি আদর্শবাদী নিরাপত্তা বাহিনী হিসেবে, যার কাজ ছিল ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করা। আজ এটি হয়ে উঠেছে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো—একটি সমান্তরাল রাষ্ট্র। পারমাণবিক কর্মসূচি, সিরিয়া-ইয়েমেন-লেবাননের প্রক্সি যুদ্ধ, এমনকি তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত এর আওতায়।
এই বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের চোখে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং বহু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কেন্দ্রে।
ইসরায়েলি হামলায় IRGC-এর নেতৃত্ব বিপর্যস্ত
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় IRGC-এর প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি, উপ-কমান্ডার গোলাম আলী রাশিদ এবং কুদস ফোর্স প্রধান ইসমাইল কানি নিহত হয়েছেন। এই ক্ষতি IRGC-এর অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি এবং নেতৃত্ব সংকট সৃষ্টি করেছে।
জনগণ ও সেনাবাহিনীর মনোভাব পরিবর্তন?
মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে, ইরানের ভেতরে এখন IRGC-এর প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। এক ভেতরের প্রতিবাদকারী জানান, “আগে যারা নীরব ছিল, তারাও এখন সমালোচনায় মুখর। এই শাসনব্যবস্থার কোনো জনসমর্থন নেই।”
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন দমনযন্ত্রের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য ভেঙে পড়ে, তখনই স্বৈরাচারী শাসন ধসে পড়ে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবও সফল হয়েছিল শাহের সেনাবাহিনীর ভাঙনের ফলে। আর সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শাসন টিকে ছিল শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর অনুগত্যে।
এই প্রেক্ষাপটে পাহলভীর আহ্বান তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এও সত্য—IRGC ত্যাগ করা মানেই মৃত্যুদণ্ড, কারাবরণ কিংবা পরিবারের ওপর হামলার ঝুঁকি। বহু সেনা এই দমনমূলক ব্যবস্থার সুবিধাভোগীও।
রেজা পাহলভী: ‘প্রজন্মের পছন্দ’ না অভিজাত আশ্রয়?
পাহলভীর সমর্থকরা বলছেন, এই মুহূর্তে তিনি হচ্ছেন গণতন্ত্র ও আধুনিক ইরানের প্রতীক। বিশেষ করে যুব সমাজ, যারা যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ধর্মীয় নির্যাতনে বিরক্ত, তারা তাঁকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে দেখতে চায়।
তবে অপরদিকে, সমালোচকরা মনে করছেন, তাঁর আন্দোলন এখনও তীব্রভাবে প্রবাসনির্ভর ও বাস্তব ভিত্তির অভাব রয়েছে। এমনকি তাঁর আহ্বানে সেনাবাহিনীর ভিতর থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য সাড়া এখনও মেলেনি।
ইরানের ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে
৪৬ বছরের ইসলামি শাসনের বিকল্প হিসেবে রেজা পাহলভীর নেতৃত্বাধীন আন্দোলন এখনো একটি ভরকেন্দ্র পায়নি। কিন্তু ইসরায়েলের আক্রমণে IRGC-এর দুর্বলতা এবং জনগণের চাপ, সামরিক বিভক্তির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যদি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী সত্যিই খামেনির পাশে না থাকে, তবে শাসনব্যবস্থা এক আকস্মিক পতনের মুখে পড়তে পারে।
এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই: ইরানের ভেতরের মানুষ—বিশেষ করে সেনাবাহিনী—পাহলভীর ডাকে সাড়া দেবে কি?