১১:০১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫

গুলশান হলি আর্টিজান হামলা: আইএস জঙ্গিদের পরিচয়, ও পারিবারিক পটভূমি

ভয়াবহ সেই রাত ও হামলার দায় স্বীকার

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে অতর্কিত হামলা চালায় পাঁচ সশস্ত্র যুবক। রাত প্রায় পৌনে ৯টার দিকে তাঁরা বেকারিতে ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। টানা ১২ ঘণ্টার ভয়াবহ অচলাবস্থা শেষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে পাঁচ হামলাকারী নিহত হয়। একই ঘটনায় ২০ জন বিদেশি নাগরিক, ৩ জন বাংলাদেশি ও ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) পরে অনলাইনে দায় স্বীকার করে।

আইএস তাদের প্রচারমাধ্যমে হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে এবং এটিকে ‘বেঙ্গল প্রভিন্স’-এর পরিকল্পিত অভিযান হিসেবে তুলে ধরে। এই হামলা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে।

হামলাকারীদের পরিচয় ও প্রোফাইল

গুলশান হামলার মূল পরিকল্পক ছিলেন তামিম আহমেদ চৌধুরী—কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। আইএস-এ তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘আবু দুজানা আল-বাঙালি’‌। ১৯৮৬ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া তামিম কানাডার নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বড় হন এবং অনলাইন জিহাদি প্রচারণায় প্রভাবিত হন। দেশে ফিরে তিনি আইএস-এর স্থানীয় শাখা গঠন ও হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ২০১৬ সালের আগস্টে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের অভিযানে তিনি নিহত হন।

অন্যদিকে হামলায় অংশ নেওয়া বাকি যুবকদের পরিচয়ও ছিল সমাজের অনেকের কাছে বিস্ময়কর। তাঁরা সবাই উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান।

 

  • রোহান ইমতিয়াজ – ঢাকার একটি অভিজাত ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের সাবেক ছাত্র; তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা।
  • খায়রুল ইসলাম পায়েল – রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
  • বাকি দু-তিন জন রাজধানীর নামকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অনেকেরই বিদেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল।

হামলাকারীদের সবার বয়স ছিল ২০-২৫ বছরের মধ্যে।

পরিবার ও সামাজিক পটভূমি

হলি আর্টিজান হামলার আলোচিত দিক ছিল হামলাকারীদের সামাজিক অবস্থান। কেউই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নন; অধিকাংশই আর্থিকভাবে সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারে বড় হয়েছেন।

পরিবারগুলো এ ঘটনার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। রোহানের কাকা গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না রোহান এমন কাজ করতে পারে।’ আরেক হামলাকারীর বাবা জানান, ‘ছেলেটা কয়েক মাস আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়; কোনো যোগাযোগ নেই, আমরা কেবল খুঁজেছি।’ ঘটনাটি সমাজে বড় এক প্রশ্ন তোলে—কীভাবে শিক্ষিত, বিত্তবান পরিবার থেকেও তরুণেরা ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে?

অনলাইন প্রোপাগান্ডা ও দলে ভিড়ে যাওয়া

তদন্তে দেখা গেছে, হামলাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে উগ্রবাদী প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া, এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপ ও বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে তাঁরা আইএস-এর নিয়মিত প্রচারণা সামগ্রী পেতেন। অনলাইনে গোপন চ্যাটগ্রুপে দেশি-বিদেশি নিয়োগকারীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, ‘হিজরত’ ও ‘শহীদ’ হওয়ার মতাদর্শ তুলে ধরে উদ্বুদ্ধ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ

হামলার পরপরই বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান জোরদার করে; আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ টাস্কফোর্স দেশের বিভিন্ন স্থানে আইএস সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা তালাবন্দি করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় জোরদার করে।

হলি আর্টিজান বেকারি হামলা দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হিসেবে স্মরণীয়। উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণদের এভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া সমাজকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে—বাস্তব জীবনের হতাশা, পরিচয়ের সংকট ও অনলাইন উগ্রবাদী প্রচারণা মিলে কীভাবে তরুণদের বিপথে ঠেলে দেয়। তাই শুধু নিরাপত্তা-বাহিনীর অভিযানই নয়, পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে সমন্বিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

 

গুলশান হলি আর্টিজান হামলা: আইএস জঙ্গিদের পরিচয়, ও পারিবারিক পটভূমি

০৬:৪৪:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫

ভয়াবহ সেই রাত ও হামলার দায় স্বীকার

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে অতর্কিত হামলা চালায় পাঁচ সশস্ত্র যুবক। রাত প্রায় পৌনে ৯টার দিকে তাঁরা বেকারিতে ঢুকে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। টানা ১২ ঘণ্টার ভয়াবহ অচলাবস্থা শেষে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে পাঁচ হামলাকারী নিহত হয়। একই ঘটনায় ২০ জন বিদেশি নাগরিক, ৩ জন বাংলাদেশি ও ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) পরে অনলাইনে দায় স্বীকার করে।

আইএস তাদের প্রচারমাধ্যমে হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে এবং এটিকে ‘বেঙ্গল প্রভিন্স’-এর পরিকল্পিত অভিযান হিসেবে তুলে ধরে। এই হামলা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে।

হামলাকারীদের পরিচয় ও প্রোফাইল

গুলশান হামলার মূল পরিকল্পক ছিলেন তামিম আহমেদ চৌধুরী—কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। আইএস-এ তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘আবু দুজানা আল-বাঙালি’‌। ১৯৮৬ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া তামিম কানাডার নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানে বড় হন এবং অনলাইন জিহাদি প্রচারণায় প্রভাবিত হন। দেশে ফিরে তিনি আইএস-এর স্থানীয় শাখা গঠন ও হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। ২০১৬ সালের আগস্টে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের অভিযানে তিনি নিহত হন।

অন্যদিকে হামলায় অংশ নেওয়া বাকি যুবকদের পরিচয়ও ছিল সমাজের অনেকের কাছে বিস্ময়কর। তাঁরা সবাই উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান।

 

  • রোহান ইমতিয়াজ – ঢাকার একটি অভিজাত ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের সাবেক ছাত্র; তাঁর বাবা আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা।
  • খায়রুল ইসলাম পায়েল – রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
  • বাকি দু-তিন জন রাজধানীর নামকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অনেকেরই বিদেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল।

হামলাকারীদের সবার বয়স ছিল ২০-২৫ বছরের মধ্যে।

পরিবার ও সামাজিক পটভূমি

হলি আর্টিজান হামলার আলোচিত দিক ছিল হামলাকারীদের সামাজিক অবস্থান। কেউই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নন; অধিকাংশই আর্থিকভাবে সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারে বড় হয়েছেন।

পরিবারগুলো এ ঘটনার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। রোহানের কাকা গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না রোহান এমন কাজ করতে পারে।’ আরেক হামলাকারীর বাবা জানান, ‘ছেলেটা কয়েক মাস আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়; কোনো যোগাযোগ নেই, আমরা কেবল খুঁজেছি।’ ঘটনাটি সমাজে বড় এক প্রশ্ন তোলে—কীভাবে শিক্ষিত, বিত্তবান পরিবার থেকেও তরুণেরা ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে?

অনলাইন প্রোপাগান্ডা ও দলে ভিড়ে যাওয়া

তদন্তে দেখা গেছে, হামলাকারীরা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে উগ্রবাদী প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া, এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপ ও বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে তাঁরা আইএস-এর নিয়মিত প্রচারণা সামগ্রী পেতেন। অনলাইনে গোপন চ্যাটগ্রুপে দেশি-বিদেশি নিয়োগকারীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, ‘হিজরত’ ও ‘শহীদ’ হওয়ার মতাদর্শ তুলে ধরে উদ্বুদ্ধ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ

হামলার পরপরই বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান জোরদার করে; আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ টাস্কফোর্স দেশের বিভিন্ন স্থানে আইএস সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা তালাবন্দি করে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ নানা দেশ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় জোরদার করে।

হলি আর্টিজান বেকারি হামলা দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ জঙ্গি হামলা হিসেবে স্মরণীয়। উচ্চশিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণদের এভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া সমাজকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে—বাস্তব জীবনের হতাশা, পরিচয়ের সংকট ও অনলাইন উগ্রবাদী প্রচারণা মিলে কীভাবে তরুণদের বিপথে ঠেলে দেয়। তাই শুধু নিরাপত্তা-বাহিনীর অভিযানই নয়, পরিবার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে সমন্বিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।