০৫:৩০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫
ছোট্ট জিফি বক্স, বড় থ্যাঙ্কসগিভিং টেবিল: সস্তা আরামের লুকানো গল্প অ্যামাজন রক্ষায় নতুন পথ দেখাচ্ছে ক্রাফট চকলেট প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৯) ব্ল্যাক ফ্রাইডে অফারে দারুণ ছাড় পেল DJI Osmo Pocket 3 ভ্লগিং ক্যামেরা নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ: উৎসবের ভোজ আর অলস জীবনে বাড়ছে ঝুঁকি বাইয়াদা দ্বীপ: জেদ্দা উপকূলের এক নির্মল প্রাকৃতিক স্বর্গ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস টেনে তাইওয়ান ইস্যুতে বেইজিংয়ের নতুন চাপ ক্রক্সের স্যান্ডেলে এবার এক্সবক্স ব্র্যান্ডিং, গেমারদের জন্য নতুন ‘ড্রপ’ আবুধাবিতে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইউক্রেন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ড্রিসকলের বৈঠক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৬৩)

আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি: দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বিপদ

হঠাৎ বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ

দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে আকস্মিক ও প্রবল বর্ষণ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় বন্যায় অন্তত ৩২১ জন নিহত হয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়ার বুনের জেলার একাধিক গ্রাম কাদা ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষ এখনও মাটির নিচে চাপা রয়েছেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চাশোটি শহরে আকস্মিক ভূমিধস ও পানির স্রোতে অন্তত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পাহাড়ি একটি গ্রামে এর আগেও একই ধরনের আকস্মিক বন্যায় অন্তত চার জন প্রাণ হারান।

ক্লাউডবার্স্ট কীভাবে ঘটে

ক্লাউডবার্স্ট হলো আকস্মিক ও অত্যন্ত স্থানীয় বৃষ্টিপাত—যেখানে এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হয়। পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষত বর্ষাকালে, আর্দ্র বাতাস পাহাড়ের ঢালে উঠে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে ঘন মেঘ তৈরি করে এবং হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ অঞ্চলের খাড়া ঢাল, দুর্বল ভূতাত্ত্বিক গঠন ও সংকীর্ণ উপত্যকাগুলো এসব প্রবাহকে ভয়াবহ বন্যায় রূপান্তরিত করে। পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সালারজাই অঞ্চলের মানুষরা জানান, প্রবল কাদা ও বিশাল পাথরের স্রোতে ভূমি কেঁপে উঠেছিল, যেন ভূমিকম্প হয়েছে।

পূর্বাভাসের চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট এত হঠাৎ ঘটে যে এগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অঞ্চলটি তথ্য-স্বল্প হওয়ায় পর্যবেক্ষণ আরও জটিল হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলটি এমনিতেই তথ্যের ঘাটতিপূর্ণ, ফলে ক্লাউডবার্স্ট বা হিমবাহের হঠাৎ গলে যাওয়া থেকে তৈরি বন্যা বিষয়ে সঠিকভাবে বোঝা ও পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ঝড়গুলো আকারে ছোট ও গতি বেশি হওয়ায় এগুলো নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, অঞ্চলের দারিদ্র্য, দুর্বল অবকাঠামো ও মৌলিক সুবিধার অভাবের কারণে সামান্য তথ্যও সময়মতো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। ইসলামাবাদভিত্তিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আলী তৌকীর শেখ বলেন, সবচেয়ে বড় ঘাটতি প্রযুক্তির নয়, যোগাযোগের ঘাটতি। দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থার অভাব এই সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে।

অবকাঠামো ও পরিবেশগত দুর্বলতা

দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে নির্বিচারে বননিধন, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন ও খনন প্রক্রিয়া বিপদকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন উজাড়ের কারণে পাহাড়ি ঢাল দুর্বল হয়ে পড়ছে, ফলে ভারী বর্ষণে ভূমিধস, কাদা-ধস ও বিশাল পাথরের প্রবাহ দেখা দিচ্ছে, সঙ্গে গাছপালা উপড়ে আসছে। এতে মানুষের বসতভিটা মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ নদী, খাল ও পানির ধারে বাস করে, ফলে সতর্ক হওয়ার সুযোগ না থাকায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ক্লাউডবার্স্টের প্রবণতা ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল আরও বেশি আর্দ্রতা শোষণ করে, যা পাহাড়ি ঢালে ঠেলে দেওয়ার সময় ভয়াবহ বৃষ্টিপাতে রূপ নেয়। সমুদ্র উষ্ণ হওয়ার ফলে মোনসুন বায়ুতে অতিরিক্ত আর্দ্রতা যোগ হয়। ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষাকে অস্বাভাবিক মাত্রায় আর্দ্র করেছে। ফলে পাহাড়ি ঢালে আর্দ্র বায়ু উঠলে হঠাৎ প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়। প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তি তাপমাত্রা বাতাসে প্রায় ৭% বেশি আর্দ্রতা ধারণ করতে পারে। তাই তীব্র তাপপ্রবাহ হলে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশে বর্ষণ আরও ভারী হবে বলে ধারণা করা যায়। পাশাপাশি হিমালয় ও কারাকোরাম অঞ্চলের হাজারো হিমবাহ দ্রুত গলছে এবং অস্থিতিশীল হ্রদ তৈরি করছে, যা বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

পাকিস্তান ও আঞ্চলিক সংকট

পাকিস্তান বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১% এরও কম উৎপাদন করে, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। ২০২২ সালে দেশটিতে ভয়াবহ বর্ষায় প্রায় ২,০০০ মানুষ মারা যায়, লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই প্রাণঘাতী বন্যা হচ্ছে। এ বছরও বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ প্রমাণ করেছে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা গভীর প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জুন-জুলাইয়ে পাকিস্তানে যে বৃষ্টিপাত হয়েছিল তা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় ভারী ছিল। পাকিস্তানে বর্ষার বৃষ্টি এখন সময়, স্থান ও মাত্রায় বদলে গেছে—গড় বৃষ্টিপাত কমলেও অতিবর্ষণের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কখনও একই মাসে খরা ও বন্যা দেখা দিচ্ছে, ফলে পানি সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, আর তার প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনে।

আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমাধান

হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ অঞ্চলজুড়ে আটটি দেশ রয়েছে। এক দেশে ঘটে যাওয়া জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একসঙ্গে কাজ করা এখন অপরিহার্য। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি, নির্মাণ ও খনন কাজ বন্ধ রাখা, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করা এবং শক্তিশালী পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার। তবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন এই সহযোগিতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও অবনতি হয়, যখন কাশ্মীর ইস্যুতে দ্বন্দ্ব বাড়ে এবং ভারত ইন্দাস নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্থগিত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন জলবায়ু হুমকির প্রেক্ষাপটে ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি।

টেকসই ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য স্থিতিশীলতা ও টিকে থাকার চাবিকাঠি হলো জলবায়ু অভিযোজন। এর মধ্যে আছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসতি এড়িয়ে চলা, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং শক্তিশালী প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা। বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত একে অপরের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতা দুর্বল হওয়ায় এই সুযোগগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।

জনপ্রিয় সংবাদ

ছোট্ট জিফি বক্স, বড় থ্যাঙ্কসগিভিং টেবিল: সস্তা আরামের লুকানো গল্প

আকাশভাঙ্গা বৃষ্টি: দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বিপদ

০২:৩৯:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

হঠাৎ বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ

দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে আকস্মিক ও প্রবল বর্ষণ ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় বন্যায় অন্তত ৩২১ জন নিহত হয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়ার বুনের জেলার একাধিক গ্রাম কাদা ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষ এখনও মাটির নিচে চাপা রয়েছেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চাশোটি শহরে আকস্মিক ভূমিধস ও পানির স্রোতে অন্তত ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের পাহাড়ি একটি গ্রামে এর আগেও একই ধরনের আকস্মিক বন্যায় অন্তত চার জন প্রাণ হারান।

ক্লাউডবার্স্ট কীভাবে ঘটে

ক্লাউডবার্স্ট হলো আকস্মিক ও অত্যন্ত স্থানীয় বৃষ্টিপাত—যেখানে এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টি হয়। পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষত বর্ষাকালে, আর্দ্র বাতাস পাহাড়ের ঢালে উঠে দ্রুত ঠান্ডা হয়ে ঘন মেঘ তৈরি করে এবং হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ অঞ্চলের খাড়া ঢাল, দুর্বল ভূতাত্ত্বিক গঠন ও সংকীর্ণ উপত্যকাগুলো এসব প্রবাহকে ভয়াবহ বন্যায় রূপান্তরিত করে। পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সালারজাই অঞ্চলের মানুষরা জানান, প্রবল কাদা ও বিশাল পাথরের স্রোতে ভূমি কেঁপে উঠেছিল, যেন ভূমিকম্প হয়েছে।

পূর্বাভাসের চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট এত হঠাৎ ঘটে যে এগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অঞ্চলটি তথ্য-স্বল্প হওয়ায় পর্যবেক্ষণ আরও জটিল হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চলটি এমনিতেই তথ্যের ঘাটতিপূর্ণ, ফলে ক্লাউডবার্স্ট বা হিমবাহের হঠাৎ গলে যাওয়া থেকে তৈরি বন্যা বিষয়ে সঠিকভাবে বোঝা ও পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ঝড়গুলো আকারে ছোট ও গতি বেশি হওয়ায় এগুলো নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, অঞ্চলের দারিদ্র্য, দুর্বল অবকাঠামো ও মৌলিক সুবিধার অভাবের কারণে সামান্য তথ্যও সময়মতো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। ইসলামাবাদভিত্তিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আলী তৌকীর শেখ বলেন, সবচেয়ে বড় ঘাটতি প্রযুক্তির নয়, যোগাযোগের ঘাটতি। দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থার অভাব এই সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে।

অবকাঠামো ও পরিবেশগত দুর্বলতা

দক্ষিণ এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে নির্বিচারে বননিধন, পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন ও খনন প্রক্রিয়া বিপদকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন উজাড়ের কারণে পাহাড়ি ঢাল দুর্বল হয়ে পড়ছে, ফলে ভারী বর্ষণে ভূমিধস, কাদা-ধস ও বিশাল পাথরের প্রবাহ দেখা দিচ্ছে, সঙ্গে গাছপালা উপড়ে আসছে। এতে মানুষের বসতভিটা মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ নদী, খাল ও পানির ধারে বাস করে, ফলে সতর্ক হওয়ার সুযোগ না থাকায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ক্লাউডবার্স্টের প্রবণতা ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডল আরও বেশি আর্দ্রতা শোষণ করে, যা পাহাড়ি ঢালে ঠেলে দেওয়ার সময় ভয়াবহ বৃষ্টিপাতে রূপ নেয়। সমুদ্র উষ্ণ হওয়ার ফলে মোনসুন বায়ুতে অতিরিক্ত আর্দ্রতা যোগ হয়। ভারত মহাসাগর ও আরব সাগর দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষাকে অস্বাভাবিক মাত্রায় আর্দ্র করেছে। ফলে পাহাড়ি ঢালে আর্দ্র বায়ু উঠলে হঠাৎ প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়। প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তি তাপমাত্রা বাতাসে প্রায় ৭% বেশি আর্দ্রতা ধারণ করতে পারে। তাই তীব্র তাপপ্রবাহ হলে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশে বর্ষণ আরও ভারী হবে বলে ধারণা করা যায়। পাশাপাশি হিমালয় ও কারাকোরাম অঞ্চলের হাজারো হিমবাহ দ্রুত গলছে এবং অস্থিতিশীল হ্রদ তৈরি করছে, যা বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

পাকিস্তান ও আঞ্চলিক সংকট

পাকিস্তান বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ১% এরও কম উৎপাদন করে, তবুও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। ২০২২ সালে দেশটিতে ভয়াবহ বর্ষায় প্রায় ২,০০০ মানুষ মারা যায়, লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই প্রাণঘাতী বন্যা হচ্ছে। এ বছরও বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ প্রমাণ করেছে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা গভীর প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জুন-জুলাইয়ে পাকিস্তানে যে বৃষ্টিপাত হয়েছিল তা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় ভারী ছিল। পাকিস্তানে বর্ষার বৃষ্টি এখন সময়, স্থান ও মাত্রায় বদলে গেছে—গড় বৃষ্টিপাত কমলেও অতিবর্ষণের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কখনও একই মাসে খরা ও বন্যা দেখা দিচ্ছে, ফলে পানি সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, আর তার প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনে।

আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সমাধান

হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ অঞ্চলজুড়ে আটটি দেশ রয়েছে। এক দেশে ঘটে যাওয়া জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রভাব অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর একসঙ্গে কাজ করা এখন অপরিহার্য। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসতি, নির্মাণ ও খনন কাজ বন্ধ রাখা, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করা এবং শক্তিশালী পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার। তবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন এই সহযোগিতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও অবনতি হয়, যখন কাশ্মীর ইস্যুতে দ্বন্দ্ব বাড়ে এবং ভারত ইন্দাস নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্থগিত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন জলবায়ু হুমকির প্রেক্ষাপটে ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি।

টেকসই ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের জন্য স্থিতিশীলতা ও টিকে থাকার চাবিকাঠি হলো জলবায়ু অভিযোজন। এর মধ্যে আছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসতি এড়িয়ে চলা, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং শক্তিশালী প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা। বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর উচিত একে অপরের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতা দুর্বল হওয়ায় এই সুযোগগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়।