রাখাইনে ক্ষুধার তীব্র সংকট
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে যুদ্ধ, অবরোধ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে যাওয়ায় মানুষ খাদ্যের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। অনেক গ্রামবাসী বাঁশের অঙ্কুর সংগ্রহ করে খাওয়ার চেষ্টা করছে। মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করেছেন, এই পরিস্থিতি ক্ষুধা ও অপুষ্টির মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।
৬০ বছর বয়সী ফল বিক্রেতা কিয়াও উইন শেইন রাখাইনের ম্রাউক-উ শহরে বলেন, “প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্য নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।” মূল্যবৃদ্ধি ও আয়ের পতনে তার ব্যবসা প্রায় ধ্বংসের পথে, যা আরও অনেককেই বনে-জঙ্গলে খাবারের খোঁজে ঠেলে দিচ্ছে।
যুদ্ধ ও অবরোধে বিপর্যস্ত রাখাইন
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে রাখাইন প্রদেশ মারাত্মক ভোগান্তির শিকার। সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের পর এক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই করছে। এই সংঘাতের ফলে প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের জন্য খাদ্য ও পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো রাখাইনকে সহায়তা করে আসছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (আমেরিকা প্রথম) নীতির কারণে বিশ্বজুড়ে সাহায্য কমে গেছে। এতে অনেক সংস্থা কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সতর্কতা
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), যা ২০২৪ সালে প্রায় অর্ধেক অনুদান যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেয়েছিল, জানিয়েছে রাখাইনের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৫৭ শতাংশ পরিবার এখন মৌলিক খাদ্যের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। গত বছরের ডিসেম্বরেও এই হার ছিল ৩৩ শতাংশ।
ডব্লিউএফপি সতর্ক করেছে, সংঘাত, অবরোধ এবং তহবিল সংকটের কারণে ক্ষুধা ও অপুষ্টি নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ম্রাউক-উ এলাকায় অবস্থা আরও ভয়াবহ।
গ্রামীণ জীবনের অবনতি
স্থানীয়রা জানিয়েছে, সার সংকটের কারণে ফসল উৎপাদন কমেছে। ফলে শাকসবজি ও ফলমূলের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। ম্রাউক-উর আরেক বাসিন্দা হ্লা পাও টুন বলেন, “পণ্য বাজারে আছে, কিন্তু মানুষের কাছে কেনার মতো টাকা নেই। বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু ক্রেতা কম। আমরা প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে আছি।”

পন্নাগিউন গ্রামে পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানকার এক দোকানদার বলেন, “আমাদের গ্রামে মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে। বেশিরভাগই বাঁশের অঙ্কুর খেয়ে বাঁচছে, কিন্তু এটা পুষ্টিকর নয়। গত এক বছরে মাত্র দুই বার সাহায্য এসেছে।”
টাকার সংকট ও অর্থনীতির ভাঙন
অবরোধ এতটাই কার্যকর যে পুরনো নোটগুলো রাজ্য থেকে বেরিয়ে নতুন নোটে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে না। ফলে ছেঁড়া ও জীর্ণ নোটেই লেনদেন করতে হচ্ছে। এতে বাজারের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও রোহিঙ্গা সংকট
রাখাইন প্রদেশ বহুদিন ধরেই সংঘাতের কেন্দ্র। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে অনেক দেশ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমানে ১০ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ মাসে আরও দেড় লক্ষ রোহিঙ্গা নতুন করে পালিয়ে এসেছে। পাশাপাশি, রাখাইনের ভেতরে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ এখনো বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















