সেভিয়ায় গরমের প্রকোপ
স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সেভিয়া এই গ্রীষ্মে যেন ইউরোপের এক বিশাল ভাটিখানা। তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পানির ফোয়ারা থেকেও গরম পানি বের হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ সতর্ক করেছেন, দেশ এখন ‘চরম ঝুঁকির’ মুখে। উত্তরে ও দক্ষিণে ভয়াবহ দাবানল হাজারো মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে এবং ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এক প্রাচীন রোমান খনির ক্ষতি করেছে।
৪৮ বছর বয়সী সেভিয়ার বাসিন্দা হাভিয়ের রেসিও রোদ থেকে বাঁচাতে মায়ের মাথার ওপর চেয়ার ধরে ছায়া দিচ্ছিলেন। শহরের নির্জন ও অনুজ্জ্বল এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, “আমাদের কিছু একটা করতে হবে।”
ঐতিহ্য থেকে শেখা
সেভিয়া ও স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গরমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর নানা উপায় গড়ে উঠেছে। দুপুরে ঘুমানো বা ‘সিয়েস্তা’ কোনো কাকতাল নয়, বরং গরম মোকাবিলার বাস্তব উপায়। বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত সেভিয়ার সরু রাস্তায় সাদা কাপড়ের আচ্ছাদন টাঙানো থাকে, যা ছায়া দেয়। শতবর্ষী বাড়িগুলোর মোটা দেয়াল ও অন্ধকার ঘর তাপ প্রতিরোধ করে।

বিজ্ঞানীরাও প্রাচীন মুসলিম শাসনামলের প্রযুক্তি থেকে সমাধান খুঁজছেন। যেমন—‘কানাত’ পদ্ধতি, যেখানে মাটির নিচ দিয়ে ঠান্ডা পানি প্রবাহিত হয়ে উপরের গরম বাতাসকে শীতল করে ঘরে নিয়ে আসে। সেভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মারিয়া দে লা পাজ মনতেরো গুতিয়েরেস এই প্রাচীন কৌশল ব্যবহার করে দেখিয়েছেন, বাইরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি থাকলেও ভেতরে তা ২৮ ডিগ্রিতে নামানো সম্ভব।
হাসপাতাল ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
সেভিয়ার হাসপাতালগুলোও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ঠান্ডা পানি পাইপের মাধ্যমে ঘুরে রোগী, অস্ত্রোপচারের কক্ষ, এমনকি হাসপাতালের লন্ড্রি ঠান্ডা রাখছে।
প্রতিরোধের দিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। নার্সরা বয়স্কদের ঘরে গিয়ে হিটস্ট্রোকের লক্ষণ চিনতে শেখাচ্ছেন। ৬৮ বছর বয়সী নার্স মারি কারমেন রদ্রিগেজ বলেন, “আমি ঠান্ডা পানিতে গোসল করি, পোশাক বদলাই আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। আচরণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
কার্লোস তৃতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, স্পেনে প্রতি বছর প্রায় ১,৩০০ মানুষ গরমে মারা যায়।
জরুরি সেবা ও শ্রম নীতি
অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা হিটস্ট্রোক রোগীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তাদের হাতে সর্বদা শরীর ঠান্ডা রাখার দ্রবণ থাকে।
সরকার গরমের সতর্কতার ভিত্তিতে বাইরে কাজ কমানো বা বন্ধ রাখার নিয়ম চালু করেছে। শ্রমমন্ত্রী ইয়োলান্ডা দিয়াস কাজের সময়সূচি ছোট করার নীতি সমর্থন করেছেন। ফলে কৃষকেরা ভোরেই মাঠে চলে আসেন, আর নির্মাণশ্রমিকদের জন্য ছাতা ও ছায়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।

গরমে ব্যবসা ও দৈনন্দিন জীবন
গরমের মধ্যেও কিছু মানুষ ইতিবাচক দিক দেখেন। কেউ বাড়তি অবসরে খুশি, আবার কেউ এয়ারকন্ডিশনার বিক্রি করে লাভবান। এক বিক্রেতা জানালেন, “আমরা দিনে ১০টা, মাসে প্রায় ২০০টি মেশিন বসাই।”
শিশুরা রাতজাগা হয়ে উঠেছে, খেলার মাঠ ভরে ওঠে মধ্যরাতে। ৯৩ বছরের গুইয়েরমিনা গালভেজ বললেন, “রাতে বাইরে আসা ছাড়া উপায় নেই।”
তবে পর্যটকরা দিনের সবচেয়ে গরম সময়েও বাইরে ঘোরেন, যা নিয়ে চিকিৎসা কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। এক অ্যাম্বুলেন্সকর্মী পর্যটকদের অসচেতনতা নিয়ে আফসোস করলেন, এসময়ই হিটস্ট্রোকের জন্য জরুরি কল আসে।
ব্যর্থ পরীক্ষা ও ভবিষ্যতের ভাবনা
সেভিয়ার ‘কানাত’ প্রকল্প এখনও পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। নতুন প্রযুক্তি দিয়ে বানানো শীতলীকরণ অবকাঠামো অযত্নে পড়ে আছে, ভরে গেছে আবর্জনায়। প্রকৌশলী ভেরোনিকা সানচেজ বলেন, “আমাদের আসলে কানাডার মতো ব্যবস্থা, অর্থাৎ আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল দরকার।”

রাতের শহর ও সংস্কৃতির অবসর
সূর্য ডোবার পর সেভিয়া যেন নতুন জীবন পায়। সন্ধ্যায় মানুষ ঘর থেকে বের হয়, ৯টার পর রেস্তোরাঁ, ১০টার পর বার ভরে ওঠে। সান্তিপন্সে এলাকার রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে স্থানীয়রা বসে স্প্যানিশ ডাব করা পুরনো সিনেমা দেখেন।
৫৯ বছর বয়সী মারিয়া হোসে আইনাত বললেন, “এখানে গরম সহ্য করা যায়।”
এই দীর্ঘ ও প্রাণঘাতী গ্রীষ্মের মধ্যেও স্পেনের মানুষ শিখিয়ে দিচ্ছেন—পরিবেশ বদলাতে না পারলেও, অভ্যাস ও জীবনযাত্রা বদলালে বাঁচার পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















