ডকুমেন্টারির শুরু: হারিয়ে যাওয়া এক পৃথিবী
২০২১ সালের অক্টোবরে চলচ্চিত্র নির্মাতা জুলিয়া লকটেভ মস্কোতে পৌঁছান দুই তরুণ সাংবাদিক সোনিয়া গ্রয়সম্যান ও ওলগা চুরাকোভার জীবন নিয়ে একটি ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্যে। নিউইয়র্ক টাইমসের তাদের পডকাস্ট ‘হ্যালো, ইউ আর আ ফরেন এজেন্ট’-এর খবর পড়ে তিনি অনুপ্রাণিত হন। রাশিয়ার বিচার মন্ত্রণালয় তাদের ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। ফলে তাদের প্রতিটি ব্যক্তিগত খরচ সরকারের কাছে জানাতে হতো এবং ব্যক্তিগত ইনস্টাগ্রাম পোস্টেও ঘোষণা যুক্ত করতে হতো। এই তালিকাভুক্তি মূলত তাদের অপরাধ নয়, বরং সরকারের পছন্দমতো খবর পরিবেশন না করার শাস্তি।
স্বাধীন সাংবাদিকদের ওপর নতুন চাপ
লকটেভ সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্মগ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে উঠলেও মস্কোতে ফিরে এসে টিভি রেইনসহ কয়েকজন স্বাধীন সাংবাদিককে কাছ থেকে দেখতে পান। বেশিরভাগই তরুণী এবং তারা সরকারের কড়া নজরদারিতে কাজ করছিলেন। কিন্তু কারো কল্পনাতেও ছিল না যে মাত্র চার মাস পরই ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়ার স্বাধীন গণমাধ্যম কার্যত ধ্বংস হয়ে যাবে। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাংবাদিকদের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, ফলে বেশিরভাগই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
চলচ্চিত্রের প্রথম অংশ: মস্কোয় শেষ নিঃশ্বাস
“My Undesirable Friends” নামের ডকুমেন্টারির প্রথম পর্ব ‘লাস্ট এয়ার ইন মস্কো’ ২০২১ সালের ঘটনার ওপর নির্মিত। পুরো ছবিটি দুই পর্বে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ। দ্বিতীয় পর্বে নির্বাসিত সাংবাদিকদের গল্প তুলে ধরা হবে। ছবির শুরুতেই দর্শক জানেন পরিণতি কী হতে যাচ্ছে—স্বাধীন সাংবাদিকদের জায়গা নেই এই রাষ্ট্রে।
সাংবাদিকদের সংগ্রাম ও ব্যক্তিগত কাহিনি
চলচ্চিত্রে সাতজন সাংবাদিককে দেখা যায়—আন্যা, সোনিয়া, ওলগা, ক্সেনিয়া মিরোনোভা (যার সাংবাদিক বাগদত্তা হঠাৎ গ্রেপ্তার হয়ে এখনও নিখোঁজ), ইরিনা দোলিনিনা ও তার বন্ধু আলেসিয়া মারোখোভস্কায়া, এবং লেনা কস্তিউচেঙ্কো, যিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও ইউক্রেনে প্রবেশে সক্ষম হন।
তারা মনে করেন মেদভেদেভের প্রেসিডেন্ট থাকা সময়টা তুলনামূলক স্বাধীন ছিল। সোনিয়া পুরনো ম্যাগাজিন দেখিয়ে বলেন, তখন সমকামিতা, নাভালনি কিংবা স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আলোচিত হতো। আজ সেই স্বাধীনতার জায়গায় এসেছে ভয়।
যুদ্ধ, প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যার চাপ
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণ শুরু হলে সাংবাদিকরা দেখেন রাষ্ট্রীয় প্রচারণা সমাজকে বিভক্ত করছে। কেউ কেউ বুঝতে পারেন, বছরের পর বছর নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে জনগণ এক দানবকে লালন করেছে। টিভি রেইনে নানা প্রতিবাদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দমননীতি কিংবা সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার খবর প্রচার করতে গিয়ে তারা প্রতিদিন বিপদের মুখে পড়ছিলেন।

সরকার সাংবাদিকদের ভাষা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়—‘যুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তার পরিবর্তে ‘সামরিক বিশেষ অভিযান’ শব্দ বাধ্যতামূলক হয়। এর বাইরে গেলে সংবাদমাধ্যম বন্ধ বা সাংবাদিককে ‘চরমপন্থী’ ঘোষণা করা হতো।
শাসনের মূল কৌশল: গণমাধ্যমকে দমন
চলচ্চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায় একনায়কতান্ত্রিক শাসন কীভাবে প্রথমেই স্বাধীন গণমাধ্যমকে নিশানা করে। পুতিন, হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান কিংবা ফিলিপাইনের দুতের্তের মতো নেতাদের আচরণেও একই রকম প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সাংবাদিকতা যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়, তাহলে মানুষও আর সত্যকে বিশ্বাস করতে পারে না।
হান্না আরেন্টের ভাষায়, “যদি সবাই সর্বদা মিথ্যা বলে, তখন মানুষ মিথ্যা বিশ্বাস করে না, বরং আর কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করে না।” ডকুমেন্টারির শুরুতে যে ‘বিদেশি এজেন্ট’ তালিকা ছিল, শুধু এক বিরক্তি, তা দ্রুত রূপ নেয় প্রাণসংহারী হুমকিতে।
শেষ বার্তা
ডিনার টেবিলে এক সাংবাদিক বলেন, “আমরা বই পড়েছি। আমরা জানি এরপর কী আসছে।”
“My Undesirable Friends” কেবল একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে কীভাবে ধীরে ধীরে দমিয়ে দেওয়া হয়, তার প্রামাণ্য সাক্ষ্য। এটি একই সঙ্গে হৃদয়বিদারক, গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ের জন্য অপরিহার্য এক দলিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















