০৩:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও লাভে এগিয়ে টয়োটা, ট্রাম্পের শুল্কের মাঝেও বিক্রিতে রেকর্ড মার্থা ওয়াশিংটন থেকে মেলানিয়া ট্রাম্প: যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডিদের পোশাকে ইতিহাস, রাজনীতি ও শক্তির প্রতিচ্ছবি চট্টগ্রামে বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে গুলির ঘটনায় কী জানা যাচ্ছে; দলগুলো কেন ক্যাডার রাখে? ট্রাম্প যখন যুদ্ধ শেষের দম্ভ দেখাচ্ছেন, চীন তখন নীরবে শান্তির পথে কাজ করছে অটিজম চিকিৎসার অপ্রতিষ্ঠিত পথে প্রতিটি পরিবার সাত দশক পর ব্রিটিশ মিউজিক্যালে নতুন জীবন পেল প্রিয় ভালুক সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখা উচিৎ, পারিবারিক সীমারেখা রক্ষা করে উৎসব উদযাপনের জ্ঞান শৈশবের গভীর ক্ষত থেকে লেখা এক রন্ধনশিল্পীর আত্মস্বীকারোক্তি মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-৩৬৪) ক্ষমতার নৃত্য: ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস বলরুম প্রকল্পে দানের আড়ালে ব্যবসায়িক স্বার্থের খেলা

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৬)

জাতি বিবরণ

বঙ্গদে

রাজসাহী জেলা প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির বাস। হিন্দু জাতিকে নিম্নের আট শ্রেণিতে বিভাগ করা যাইতে পারে:

১) ব্রাহ্মণ।

৫) কায়স্থ।

৬) নবশাক বা জল-আচরণীয় হিন্দু।

২) ক্ষত্রিয়।

৩) বৈশ্য।

৭) জল-আচরণীয় হিন্দু অথচ নবশাক নহে।

৪) বৈদ্য।

৮) জল-অনাচরণীয় হিন্দু।

পুরাকালে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণ ব্যতীত পঞ্চম বর্ণ ছিল না। প্রথম তিন বর্ণের মাতৃগর্ভে প্রবেশ হেতু এক জন্ম এবং সংস্কার হইয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন বলিয়া আর এক জন্ম হয়। এই হেতু ঐ প্রথম ত্রৈবর্ণ দ্বিজ বলিয়া পরিচিত। শূদ্রের কেবল মাতৃগর্ভে প্রবেশকে এক জন্ম বলিয়া “একজ” নামে খ্যাত। শূদ্রেরা যজ্ঞোপবীত ধারণ করে না। এই চারি জাতি ব্যতীত বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাক প্রভৃতি যে জাতিগুলি দেখা যায়, ইহারা শূদ্রজাতির অন্তর্ভূত কি প্রথম তিন বর্ণের অন্তর্গত ইহা তর্ক বিতর্কের কথা। যদি বৈদ্য ও কায়স্থ শূদ্রজাতির মধ্যে পরিগণিত না হয়, তবে তাহারা কি প্রথম তিন বর্ণের কোন একটি বর্ণ হইতে উৎপন্ন? তবে কি তাহারা বর্ণসঙ্কর? এ প্রশ্নগুলির ঠিক মীমাংসা করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। অতি প্রাচীনকালে আর্যজাতিদের মধ্যে প্রথমে জাতিভেদ ছিল না বলিয়া সাধারণের প্রতীতি হয়। প্রথমে সকল জাতির মধ্যে পরস্পর আহার, বিহার, উপবেশন প্রচলিত ছিল। সমাজের কাজকর্ম সুবিধামত চালাইবার জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি শ্রেণিতে আর্যজাতি বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মণেরা বেদজ্ঞ হইয়া জ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষার ভার গ্রহণ করিলেন। এইরূপে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ এবং পরে পরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতির সৃষ্টি হইয়া জাতিভেদ হইল। জাতিভেদ হওয়ার পরেও উচ্চ জাতিয়েরা নীচ জাতির কন্যার পানিগ্রহণ করিতে পারিতেন। ইহাও নিয়ম ছিল যে নীচ জাতিয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি বুদ্ধিমান হইলে তাহাকে সংস্কার করিয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করান হইত এবং ঋষিরা তাহাকে বেদ অধ্যয়ন করাইয়া ব্রাহ্মণ করিতেন। ইহাতে এই বলা যাইতে পারে যে, শূদ্র যদিও ব্রাহ্মণের ন্যায় জ্ঞানী ও ধার্মিক হইত, তবে সে শূদ্রও ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মানিত হইত। “যাহারা বেদহীন ও আচার ভ্রষ্ট হইয়া সমস্ত কার্যের অনুষ্ঠান ও সকল দ্রব্য ভক্ষণ করে তাহারাই শূদ্র বলিয়া পরিগণিত হয়।” এই মহাভারতীয় বাক্যের উপর নির্ভর করিলে, ইহা বলা যাইতে পারে যে পুরাকালে আর্যসন্তান বেদহীন আচার ভ্রষ্ট হইলেই শূদ্র এবং সদগুণানুসারে ও ব্যবসানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলিয়া পরিগণিত হইত। অধুনা আর্যজাতি পূর্বের ন্যায় বেদজ্ঞ না হওয়ায় এবং কালক্রমে জাতিভেদ দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্বের ন্যায় জ্ঞান চর্চা বিহীনে, সকল জাতিরই হীন অবস্থা এবং জাতিভেদেরও বেশি বাড়াবাড়ি হইয়াছে। অতএব নানা জাতির ও

বর্ণের সৃষ্টি এবং নানা পরিবর্তন জন্য কোন বিষয়ে ঠিক মীমাংসায় উপনীত হওয়া কঠিন। এই রাজসাহী জেলায় ১৫০০ বা ১৬০০ ব্রাহ্মণের বাস। সাধারণত রাজসাহীর ব্রাহ্মণদিগকে পাঁচশ্রেণিতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা- (ক) বারেন্দ্র, (খ) রাঢ়ী, (গ)বৈদিক, (ঘ) বর্ণ, (ঙ) কনৌজ। রাজা আদিশূরের পুত্রেষ্টি, যাগ সম্পন্ন জন্য কান্যকুব্জ হইতে দক্ষ, ভট্টনারায়ণ, শ্রীহর্ষ, বেদগর্ভ ও ছান্দড় নামে সাগ্নিক, বেদজ্ঞ ও সংক্রিয়াশালী পঞ্চ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসিয়া রাজপ্রদত্ত পঞ্চগ্রামে বাস করেন। ইহাদের বংশধরেরা কতকগুলি রাঢ়দেশে, ও কতকগুলি বরেন্দ্রভূমে বাস করেন। যাহারা বরেন্দ্রভূমে বাস করিতে লাগিলেন, তাহারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ হইলেন।

(ক) বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-এই শ্রেণি ব্রাহ্মণ প্রায়ই ধনী। জেলার বড় বড় রাজা জমিদার প্রভৃতি এই শ্রেণির ব্রাহ্মণ। তাহিরপুর, পুঁঠিয়া, নাটোর, বলিহার, চৌগ্রাম, লালোর, কাসিমপুর, পানশীপাড়া, জোয়াড়ী, দারীকুশী, আটগ্রাম, ইসলামগাতি, খাজুরা প্রভৃতি স্থানের রাজা ও জমিদারেরা এই শ্রেণির ব্রাহ্মণ। বর্তমান আয়তন অপেক্ষা পূর্বে এই জেলার আয়তন পাঁচগুণ বেশি ছিল। এইরূপ বৃহৎ জেলা ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাহিরপুর, পুঠিয়া, নাটোর প্রভৃতি রাজার হস্তে ছিল। মহারাণী শরৎসুন্দরীর জীবনচরিতে শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র লাহিড়ি মহাশয় লিখিয়াছেন যে-“রাজসাহী জেলার বর্তমান আয়তন সঙ্কীর্ণ হইলেও অনেক স্থানে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের পূর্ব পুরুষদিগের বসতি-চিহ্ন, অদ্যাপি লুপ্ত হয় নাই। কুলজ্ঞ গ্রন্থে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের যে সকল সমাজের উল্লেখ আছে তাহার অধিকাংশ বর্তমান রাজসাহী জেলার সীমা মধ্যে দেখা যায়। তবে দীর্ঘকালে নামের অপভ্রংশ মাত্র হইয়াছে; যথা-মধ্যগ্রাম (মাঝগ্রাম), গুড় নদী (গুড়নই), গুণিগাছা, ভাদুড়ি (ভাতুড়িয়া), মধুগ্রাম (মৌগ্রাম), বালষষ্টিক (বালশাটিয়া), মঠগ্রাম (মঠগাঁ), গঙ্গাগ্রাম (গাঙ্গইল), বিশাখা (বিশা), রাণীহারি (রায়না), কুড়মুড়ি (কুড়মইল বলিহার), শীতলী (শীতলাই), তালড়ি (তানোর), দেবলী (দেউলা), নিদ্রালী (নিন্দাইল), কালিগ্রাম (কালিগ্রা), খর্জুরী (খাজুরিয়া), পঞ্চবটি (পাঁচবাড়িয়া), চম্পটি (চামটা), বোড়গ্রাম (বড়াইগাঁ), করঞ্জ (করঞ্জা), বোথড়ি (বোথড়) ইত্যাদি নাম ও সমাজের চিহ্ন দেখা যায়।” সুষেণাদির পুত্রগণ বরেন্দ্রভূমিতে একশত গ্রাম (গাঁই) প্রাপ্ত হইয়া বাস করেন। ইহারাই বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মহ্মণ বলিয়া পরিচিত। এই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ প্রধানত তিন শাখায় বিভক্ত, যথা-(১) কুলীন, (২) সিদ্ধ শ্রোত্রিয়, (৩) কষ্ট শ্রোয়িত্র। কোন্ শাখায় কত গাঁই তাহার তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল:-

(১) সুষেণাদি পঞ্চ ব্রাহ্মণ-নায়ারণ ভট্ট, সুষেণ, পরাশর, ধরাধর ও গৌতম।


কুলীন ব্রাহ্মণ-এই বারেন্দ্র শ্রেণি কুলীন ব্রাহ্মণের ৮ গাঁই, যথা-মৈত্র, ভীম, রুদ্র ও সাধু

(বাগচি), সংযামিনী (সান্যাল), লাহিড়ি, ভাদুড়ি ভাদড়া’। কুলশাস্ত্র বিশারদ উদয়নাচার্য ভাদুড়ি বারেন্দ্র শ্রেণি কুলীন ব্রাহ্মণগণের দোষ গুণ বিচার করিয়া তাহাদিগকে আট পটিতে বিভক্ত করেন, যথা- (১) নিরাবিল, (২) ভুষণা, (৩) রোহিলা, (৪) ভবানীপুর, (৫) বেণী, (৬) আলেখানি, (৭) কুতুবখানি, (৮) জোনালী। এইরূপ কৌলীন্য প্রথা বল্লালসেনের সময় হইতে প্রচলিত। কিন্তু বল্লালসেনের অধিকারের পূর্বে, ঠিক এই প্রকার না হউক, কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। মনুর কন্যা দেবহুতি। এই দেবহূতির সহিত কর্দম মুনির বিবাহ হইয়া নয়টি কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। এই নয় কন্যার বিবাহ নয় ব্রহ্মহ্মর্ষির সহিত হওয়ার সময় কৌলীন্য প্রথা প্রথমে প্রচলিত হয়। ব্যালসেন নবগুণ বিশিষ্ট ব্রাহ্মণকে কুলীন করেন এবং অবশিষ্ট ব্রাহ্মণকে গুণানুসারে সিদ্ধ শ্রোত্রিয় ও কষ্ট শ্রোত্রিয় করেন। বর্তমান প্রথানুসারে ব্রাহ্মণগণের সেই গুণ না থাকিলেও কুলীন ৩. শ্রোত্রিয় বলিয়া কথিত হন। এইরূপ বংশগত কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে এবং বল্লালসেনেরও এইরূপ উদ্দেশ্য ছিল না। কৌলীন্য প্রথায় যেমন দোষ আছে, তেমন গুণও আছে। সমাজ বন্ধনীর শিথিলতাতেই দোষের ভাগ বৃদ্ধি হইয়াছে। এই বল্লালসেন প্রচলিত কৌলীন্য প্রথানুসারে খাজুরা, চৌগ্রাম বর্তমান তাহিরপুর (বংশ), পাটুল, বলিহার প্রভৃতি স্থানের কুলীন ব্রাহ্মণ নিরাবিন পটিভুক্ত এবং ইহারাই সমাজে শ্রেষ্ঠ।

সিদ্ধ শ্রোত্রিয়-সিদ্ধ শ্রোত্রিয়ের ৮ গাঁই যথা-করঞ্জ, নন্দনাবাসী, ভট্টশালী, লাজুলি, চম্পটি, ঝম্পটি, (ঝামাল), কামদেব (কামদেবতা), আদিত্য। যাহারা কন্যা গ্রহণে ও কন্যা সম্প্রদানে বিশেষ সাবধান ছিলেন, তাহারাই উৎকৃষ্ট শ্রোত্রিয় হইলেন। চম্পটি, নন্দনাবাসী প্রভৃতি গাঁই অতি প্রসিদ্ধ। শাণ্ডিল্য গোত্রীয় নন্দনাবাসী (গাঁই) গ্রামের মৌনভট্ট বংশে প্রসিদ্ধ “মুক্তাবলী” প্রণেতা কুল্লুকভট্ট এবং তাহিরপুর রাজবংশের আদিপুরুষ কংসনারায়ণ জন্মগ্রহণ

করেন।

কষ্ট শ্রোত্রিয়-যাহারা কন্যা গ্রহণে ও সম্প্রদানে নিতান্ত অসাবধান, তাহারাই কষ্ট শ্রোত্রিয় হইতেন। এই কষ্ট শ্রোত্রিয়ের ৮৪ গাঁই। ইহাদের মধ্যে ৮ ঘর প্রসিদ্ধ। যথা:-শীহরি, রাইগাঁই, কুড়িমুড়িয়া, গোস্বা, খর্জুরী, বিশি, উচ্চরিক ও জামরিক। স্বর্ণদেব শীহরি গ্রাম প্রাপ্ত হইয়া কষ্ট শ্রোত্রিয় আখ্যা প্রাপ্ত হন। রাইগাঁই রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও দেখা যায়।

বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোন্ গোত্রে কত গাঁই, তাহার তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল :


ইহাদের মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় সুষেণের বংশোদ্ভব মৈত্রেয় ও ক্রতু, শাণ্ডিল্য গোত্রীয় নারায়ণ ভট্টের বংশোদ্ভব সাধু, রুদ্র, লোকনাথ ও বাৎস্য গোত্রীয় ধরাধরের বংশোদ্ভব বলিয়া প্রসিদ্ধ হয়। লক্ষ্মীধর, জয়মণি মিশ্র, বল্লালের নিকট কৌলীন্যমর্যাদা প্রাপ্ত হন। অবশিষ্ট সমুদয় শ্রোত্রিয়

শ্রোত্রিয় অতি প্রসিদ্ধ। রাজসাহীতে নাটোর (রাজবংশ), পানশীপাড়া, ইসলামগাঁতি, আটগ্রাম প্রভৃতি স্থানের

কোন ব্যক্তির সহিত কোন একটি কন্যার সম্বন্ধ নির্ণয় (করণ) হইবার পর, দৈবাৎ যদি বিবাহের পূর্বেই বরের মৃত্যু হয়, তবে ঐ অবিবাহিতা কন্যাকে অন্যপূর্বা কহে। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে এই অন্যপূর্বা বিবাহ প্রচলিত আছে বটে; কিন্তু যে ব্রাহ্মণ এই কন্যাকে বিবাহ করে, সে সমাজে অতি ঘৃণিত হইয়া থাকে এবং উৎকৃষ্ট কূলে আদান প্রদান করিতে পারে না। এই দোষ নিবারণ জন্য এক্ষণে বিবাহের অব্যবহিত পূর্বে করণ হয়।

কাপ (কাচ) রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে ক্লাপ নাই। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে কাপের সৃষ্টি হয়। সাধারণ কথায় কূলভ্রষ্ট ব্যক্তিকে কাপ বলা যায়। শান্তিপুর নিবাসী নৃসিংহ লাঙুলি সিদ্ধ শ্রোত্রিয় ছিলেন না। তাহার কন্যাকে কুলীন শ্রেষ্ঠ মধু মৈত্রেয় বিবাহ করিলে, মধুর পূর্ব পত্নীর গর্ভজাত সন্তানগণ, পিতা নীচ বংশের কন্যা গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করিল এবং বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতে লাগিল। ধেই বাগচি মৈত্রেয়ের ভগিনীপতি। বেঁই বাগচি, তাহার পত্নীর অনুরোধে, মধু মৈত্রের বাটিতে তাহার পিতার একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ উপলক্ষে আসিয়া দেখিলেন, মধুর পুত্রগণ চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতেছেন। ধেই বাগচির নানা উপদেশে পুত্রগণ পিতার সহিত একত্রিত হইল না। তৎপর ধেই বাগচি মধুর পুত্রগণকে বলিলেন, তোরা বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া এ একটি “কাচ” করিয়াছিস্। এই “কাচ” শব্দ হইতে “কাপ” হইল। মধু মৈত্রের প্রথম বনিতার তিন পুত্র রক্ষতাই, নন্দাই, গদাই এই তিন সহোদর কুলভ্রষ্ট কাপ হইলেন। তাহারা বারি-বিন্দু প্রক্ষেপ দ্বারা অন্যেকেও কাপ করিয়া লইতে লাগিল। মধু মৈত্রেয়ও সমাজে পতিত অবস্থায় আছেন। কিন্তু রাজা কংসনারায়ণ মধু মৈত্রকে কন্যা দান করিয়া, তাহার সমাজের মর্যাদা রক্ষা করিলেন, রাজা কংসনারায়ণ শ্রোত্রিয় হইলেন, কিন্তু নৃসিংহ লাড়ুলির ও রাজা কংসনারায়ণের দৌহিত্রগণ কুলীন পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিলেন। এই সময় হইতে কুশবারি সংযুক্ত না হইলে, কেবল শয়নে, ভোজনে, স্পর্শে, বারি-বিন্দু প্রক্ষেপে কুলীনের কুলপাত হইবে না বলিয়া স্থির হইল। কাপের সহিত শ্রোত্রিয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধ হইল, কাপ স্বধর্মে পুষ্ট রহিলেন। এ বিষয় তাহিরপুর ও নাটোর রাজবংশের ইতিহাসে বিস্তারিতরূপে বিবৃত হইবে।

কাপগণের অনেক শাখা। প্রধানত তিন শাখা প্রসিদ্ধ যথা- (১) বারবকাবাদ, (২) সুলতান প্রতাপ, (৩) গঙ্গাতীর। প্রথম দুই শাখা-রাজসাহী প্রদেশের (রাজসাহী ও পাবনা জেলার) অন্তর্গত এবং তৃতীয় শাখা মুরশিদাবাদের অধীন।

(১) হরিপুর, লালুর (লালোর), কাসিমপুর, হাঁসপুর প্রভৃতি স্থানগুলি বারবকাবাদ সমাজের অধীন।

(২) বাক্, কাবারি, কোলা, নয়াবাড়ি, ক্ষেতুপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি সুলতান প্রতাপ সমাজের অধীন।

(৩) খাগড়া, ব্যাসপুর, আচার্যপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি গঙ্গাতীর সমাজের অধীন।

রাজসাহী প্রদেশের কাপ মধ্যে হরিপুর, লালুর, কাসিমপুরের চৌধুরীরা, হাঁসপুরের ভট্টাচার্যেরা, ক্ষেতুপাড়ার রায়েরা এবং কাসিমপুরের লাহিড়িবংশীয়েরা বিশেষ প্রসিদ্ধ। কাপ ক্রমাগত কুলীনে কন্যাদান করিতে পারিলেই কাপের মর্যাদা বৃদ্ধি হইল।

বারেন্দ্র কুলীন ব্রাহ্মণ কুলভ্রষ্ট হইলে কাপ হন এবং কুলীন বলিয়া আর গৌরব রাখিতে না পারিলেও কুলকার্যদ্বারা সর্বদা তাজা থাকেন; কিন্তু রাঢ়ী কুলীন ব্রাহ্মণ কুল ভঙ্গ করিলে, তিন পুরুষ পর্যন্ত কিয়ৎ পরিমাণে কুলীনের মর্যাদা রক্ষা করিয়াও কুলকার্য দ্বারা আর তাজা থাকিতে পারে না


জনপ্রিয় সংবাদ

বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও লাভে এগিয়ে টয়োটা, ট্রাম্পের শুল্কের মাঝেও বিক্রিতে রেকর্ড

রাজসাহীর ইতিহাস (পর্ব -৬)

০৪:৩৮:৪৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

জাতি বিবরণ

বঙ্গদে

রাজসাহী জেলা প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির বাস। হিন্দু জাতিকে নিম্নের আট শ্রেণিতে বিভাগ করা যাইতে পারে:

১) ব্রাহ্মণ।

৫) কায়স্থ।

৬) নবশাক বা জল-আচরণীয় হিন্দু।

২) ক্ষত্রিয়।

৩) বৈশ্য।

৭) জল-আচরণীয় হিন্দু অথচ নবশাক নহে।

৪) বৈদ্য।

৮) জল-অনাচরণীয় হিন্দু।

পুরাকালে ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণ ব্যতীত পঞ্চম বর্ণ ছিল না। প্রথম তিন বর্ণের মাতৃগর্ভে প্রবেশ হেতু এক জন্ম এবং সংস্কার হইয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন বলিয়া আর এক জন্ম হয়। এই হেতু ঐ প্রথম ত্রৈবর্ণ দ্বিজ বলিয়া পরিচিত। শূদ্রের কেবল মাতৃগর্ভে প্রবেশকে এক জন্ম বলিয়া “একজ” নামে খ্যাত। শূদ্রেরা যজ্ঞোপবীত ধারণ করে না। এই চারি জাতি ব্যতীত বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাক প্রভৃতি যে জাতিগুলি দেখা যায়, ইহারা শূদ্রজাতির অন্তর্ভূত কি প্রথম তিন বর্ণের অন্তর্গত ইহা তর্ক বিতর্কের কথা। যদি বৈদ্য ও কায়স্থ শূদ্রজাতির মধ্যে পরিগণিত না হয়, তবে তাহারা কি প্রথম তিন বর্ণের কোন একটি বর্ণ হইতে উৎপন্ন? তবে কি তাহারা বর্ণসঙ্কর? এ প্রশ্নগুলির ঠিক মীমাংসা করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। অতি প্রাচীনকালে আর্যজাতিদের মধ্যে প্রথমে জাতিভেদ ছিল না বলিয়া সাধারণের প্রতীতি হয়। প্রথমে সকল জাতির মধ্যে পরস্পর আহার, বিহার, উপবেশন প্রচলিত ছিল। সমাজের কাজকর্ম সুবিধামত চালাইবার জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি শ্রেণিতে আর্যজাতি বিভক্ত হয়। ব্রাহ্মণেরা বেদজ্ঞ হইয়া জ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষার ভার গ্রহণ করিলেন। এইরূপে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ এবং পরে পরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র জাতির সৃষ্টি হইয়া জাতিভেদ হইল। জাতিভেদ হওয়ার পরেও উচ্চ জাতিয়েরা নীচ জাতির কন্যার পানিগ্রহণ করিতে পারিতেন। ইহাও নিয়ম ছিল যে নীচ জাতিয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি বুদ্ধিমান হইলে তাহাকে সংস্কার করিয়া যজ্ঞোপবীত ধারণ করান হইত এবং ঋষিরা তাহাকে বেদ অধ্যয়ন করাইয়া ব্রাহ্মণ করিতেন। ইহাতে এই বলা যাইতে পারে যে, শূদ্র যদিও ব্রাহ্মণের ন্যায় জ্ঞানী ও ধার্মিক হইত, তবে সে শূদ্রও ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মানিত হইত। “যাহারা বেদহীন ও আচার ভ্রষ্ট হইয়া সমস্ত কার্যের অনুষ্ঠান ও সকল দ্রব্য ভক্ষণ করে তাহারাই শূদ্র বলিয়া পরিগণিত হয়।” এই মহাভারতীয় বাক্যের উপর নির্ভর করিলে, ইহা বলা যাইতে পারে যে পুরাকালে আর্যসন্তান বেদহীন আচার ভ্রষ্ট হইলেই শূদ্র এবং সদগুণানুসারে ও ব্যবসানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বলিয়া পরিগণিত হইত। অধুনা আর্যজাতি পূর্বের ন্যায় বেদজ্ঞ না হওয়ায় এবং কালক্রমে জাতিভেদ দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্বের ন্যায় জ্ঞান চর্চা বিহীনে, সকল জাতিরই হীন অবস্থা এবং জাতিভেদেরও বেশি বাড়াবাড়ি হইয়াছে। অতএব নানা জাতির ও

বর্ণের সৃষ্টি এবং নানা পরিবর্তন জন্য কোন বিষয়ে ঠিক মীমাংসায় উপনীত হওয়া কঠিন। এই রাজসাহী জেলায় ১৫০০ বা ১৬০০ ব্রাহ্মণের বাস। সাধারণত রাজসাহীর ব্রাহ্মণদিগকে পাঁচশ্রেণিতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। যথা- (ক) বারেন্দ্র, (খ) রাঢ়ী, (গ)বৈদিক, (ঘ) বর্ণ, (ঙ) কনৌজ। রাজা আদিশূরের পুত্রেষ্টি, যাগ সম্পন্ন জন্য কান্যকুব্জ হইতে দক্ষ, ভট্টনারায়ণ, শ্রীহর্ষ, বেদগর্ভ ও ছান্দড় নামে সাগ্নিক, বেদজ্ঞ ও সংক্রিয়াশালী পঞ্চ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আসিয়া রাজপ্রদত্ত পঞ্চগ্রামে বাস করেন। ইহাদের বংশধরেরা কতকগুলি রাঢ়দেশে, ও কতকগুলি বরেন্দ্রভূমে বাস করেন। যাহারা বরেন্দ্রভূমে বাস করিতে লাগিলেন, তাহারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ হইলেন।

(ক) বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-এই শ্রেণি ব্রাহ্মণ প্রায়ই ধনী। জেলার বড় বড় রাজা জমিদার প্রভৃতি এই শ্রেণির ব্রাহ্মণ। তাহিরপুর, পুঁঠিয়া, নাটোর, বলিহার, চৌগ্রাম, লালোর, কাসিমপুর, পানশীপাড়া, জোয়াড়ী, দারীকুশী, আটগ্রাম, ইসলামগাতি, খাজুরা প্রভৃতি স্থানের রাজা ও জমিদারেরা এই শ্রেণির ব্রাহ্মণ। বর্তমান আয়তন অপেক্ষা পূর্বে এই জেলার আয়তন পাঁচগুণ বেশি ছিল। এইরূপ বৃহৎ জেলা ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাহিরপুর, পুঠিয়া, নাটোর প্রভৃতি রাজার হস্তে ছিল। মহারাণী শরৎসুন্দরীর জীবনচরিতে শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র লাহিড়ি মহাশয় লিখিয়াছেন যে-“রাজসাহী জেলার বর্তমান আয়তন সঙ্কীর্ণ হইলেও অনেক স্থানে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের পূর্ব পুরুষদিগের বসতি-চিহ্ন, অদ্যাপি লুপ্ত হয় নাই। কুলজ্ঞ গ্রন্থে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের যে সকল সমাজের উল্লেখ আছে তাহার অধিকাংশ বর্তমান রাজসাহী জেলার সীমা মধ্যে দেখা যায়। তবে দীর্ঘকালে নামের অপভ্রংশ মাত্র হইয়াছে; যথা-মধ্যগ্রাম (মাঝগ্রাম), গুড় নদী (গুড়নই), গুণিগাছা, ভাদুড়ি (ভাতুড়িয়া), মধুগ্রাম (মৌগ্রাম), বালষষ্টিক (বালশাটিয়া), মঠগ্রাম (মঠগাঁ), গঙ্গাগ্রাম (গাঙ্গইল), বিশাখা (বিশা), রাণীহারি (রায়না), কুড়মুড়ি (কুড়মইল বলিহার), শীতলী (শীতলাই), তালড়ি (তানোর), দেবলী (দেউলা), নিদ্রালী (নিন্দাইল), কালিগ্রাম (কালিগ্রা), খর্জুরী (খাজুরিয়া), পঞ্চবটি (পাঁচবাড়িয়া), চম্পটি (চামটা), বোড়গ্রাম (বড়াইগাঁ), করঞ্জ (করঞ্জা), বোথড়ি (বোথড়) ইত্যাদি নাম ও সমাজের চিহ্ন দেখা যায়।” সুষেণাদির পুত্রগণ বরেন্দ্রভূমিতে একশত গ্রাম (গাঁই) প্রাপ্ত হইয়া বাস করেন। ইহারাই বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মহ্মণ বলিয়া পরিচিত। এই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ প্রধানত তিন শাখায় বিভক্ত, যথা-(১) কুলীন, (২) সিদ্ধ শ্রোত্রিয়, (৩) কষ্ট শ্রোয়িত্র। কোন্ শাখায় কত গাঁই তাহার তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল:-

(১) সুষেণাদি পঞ্চ ব্রাহ্মণ-নায়ারণ ভট্ট, সুষেণ, পরাশর, ধরাধর ও গৌতম।


কুলীন ব্রাহ্মণ-এই বারেন্দ্র শ্রেণি কুলীন ব্রাহ্মণের ৮ গাঁই, যথা-মৈত্র, ভীম, রুদ্র ও সাধু

(বাগচি), সংযামিনী (সান্যাল), লাহিড়ি, ভাদুড়ি ভাদড়া’। কুলশাস্ত্র বিশারদ উদয়নাচার্য ভাদুড়ি বারেন্দ্র শ্রেণি কুলীন ব্রাহ্মণগণের দোষ গুণ বিচার করিয়া তাহাদিগকে আট পটিতে বিভক্ত করেন, যথা- (১) নিরাবিল, (২) ভুষণা, (৩) রোহিলা, (৪) ভবানীপুর, (৫) বেণী, (৬) আলেখানি, (৭) কুতুবখানি, (৮) জোনালী। এইরূপ কৌলীন্য প্রথা বল্লালসেনের সময় হইতে প্রচলিত। কিন্তু বল্লালসেনের অধিকারের পূর্বে, ঠিক এই প্রকার না হউক, কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। মনুর কন্যা দেবহুতি। এই দেবহূতির সহিত কর্দম মুনির বিবাহ হইয়া নয়টি কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। এই নয় কন্যার বিবাহ নয় ব্রহ্মহ্মর্ষির সহিত হওয়ার সময় কৌলীন্য প্রথা প্রথমে প্রচলিত হয়। ব্যালসেন নবগুণ বিশিষ্ট ব্রাহ্মণকে কুলীন করেন এবং অবশিষ্ট ব্রাহ্মণকে গুণানুসারে সিদ্ধ শ্রোত্রিয় ও কষ্ট শ্রোত্রিয় করেন। বর্তমান প্রথানুসারে ব্রাহ্মণগণের সেই গুণ না থাকিলেও কুলীন ৩. শ্রোত্রিয় বলিয়া কথিত হন। এইরূপ বংশগত কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে এবং বল্লালসেনেরও এইরূপ উদ্দেশ্য ছিল না। কৌলীন্য প্রথায় যেমন দোষ আছে, তেমন গুণও আছে। সমাজ বন্ধনীর শিথিলতাতেই দোষের ভাগ বৃদ্ধি হইয়াছে। এই বল্লালসেন প্রচলিত কৌলীন্য প্রথানুসারে খাজুরা, চৌগ্রাম বর্তমান তাহিরপুর (বংশ), পাটুল, বলিহার প্রভৃতি স্থানের কুলীন ব্রাহ্মণ নিরাবিন পটিভুক্ত এবং ইহারাই সমাজে শ্রেষ্ঠ।

সিদ্ধ শ্রোত্রিয়-সিদ্ধ শ্রোত্রিয়ের ৮ গাঁই যথা-করঞ্জ, নন্দনাবাসী, ভট্টশালী, লাজুলি, চম্পটি, ঝম্পটি, (ঝামাল), কামদেব (কামদেবতা), আদিত্য। যাহারা কন্যা গ্রহণে ও কন্যা সম্প্রদানে বিশেষ সাবধান ছিলেন, তাহারাই উৎকৃষ্ট শ্রোত্রিয় হইলেন। চম্পটি, নন্দনাবাসী প্রভৃতি গাঁই অতি প্রসিদ্ধ। শাণ্ডিল্য গোত্রীয় নন্দনাবাসী (গাঁই) গ্রামের মৌনভট্ট বংশে প্রসিদ্ধ “মুক্তাবলী” প্রণেতা কুল্লুকভট্ট এবং তাহিরপুর রাজবংশের আদিপুরুষ কংসনারায়ণ জন্মগ্রহণ

করেন।

কষ্ট শ্রোত্রিয়-যাহারা কন্যা গ্রহণে ও সম্প্রদানে নিতান্ত অসাবধান, তাহারাই কষ্ট শ্রোত্রিয় হইতেন। এই কষ্ট শ্রোত্রিয়ের ৮৪ গাঁই। ইহাদের মধ্যে ৮ ঘর প্রসিদ্ধ। যথা:-শীহরি, রাইগাঁই, কুড়িমুড়িয়া, গোস্বা, খর্জুরী, বিশি, উচ্চরিক ও জামরিক। স্বর্ণদেব শীহরি গ্রাম প্রাপ্ত হইয়া কষ্ট শ্রোত্রিয় আখ্যা প্রাপ্ত হন। রাইগাঁই রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও দেখা যায়।

বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণের মধ্যে কোন্ গোত্রে কত গাঁই, তাহার তালিকা নিম্নে দেওয়া গেল :


ইহাদের মধ্যে কাশ্যপ গোত্রীয় সুষেণের বংশোদ্ভব মৈত্রেয় ও ক্রতু, শাণ্ডিল্য গোত্রীয় নারায়ণ ভট্টের বংশোদ্ভব সাধু, রুদ্র, লোকনাথ ও বাৎস্য গোত্রীয় ধরাধরের বংশোদ্ভব বলিয়া প্রসিদ্ধ হয়। লক্ষ্মীধর, জয়মণি মিশ্র, বল্লালের নিকট কৌলীন্যমর্যাদা প্রাপ্ত হন। অবশিষ্ট সমুদয় শ্রোত্রিয়

শ্রোত্রিয় অতি প্রসিদ্ধ। রাজসাহীতে নাটোর (রাজবংশ), পানশীপাড়া, ইসলামগাঁতি, আটগ্রাম প্রভৃতি স্থানের

কোন ব্যক্তির সহিত কোন একটি কন্যার সম্বন্ধ নির্ণয় (করণ) হইবার পর, দৈবাৎ যদি বিবাহের পূর্বেই বরের মৃত্যু হয়, তবে ঐ অবিবাহিতা কন্যাকে অন্যপূর্বা কহে। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে এই অন্যপূর্বা বিবাহ প্রচলিত আছে বটে; কিন্তু যে ব্রাহ্মণ এই কন্যাকে বিবাহ করে, সে সমাজে অতি ঘৃণিত হইয়া থাকে এবং উৎকৃষ্ট কূলে আদান প্রদান করিতে পারে না। এই দোষ নিবারণ জন্য এক্ষণে বিবাহের অব্যবহিত পূর্বে করণ হয়।

কাপ (কাচ) রাঢ়ী শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে ক্লাপ নাই। বারেন্দ্র শ্রেণি ব্রাহ্মণগণ মধ্যে কাপের সৃষ্টি হয়। সাধারণ কথায় কূলভ্রষ্ট ব্যক্তিকে কাপ বলা যায়। শান্তিপুর নিবাসী নৃসিংহ লাঙুলি সিদ্ধ শ্রোত্রিয় ছিলেন না। তাহার কন্যাকে কুলীন শ্রেষ্ঠ মধু মৈত্রেয় বিবাহ করিলে, মধুর পূর্ব পত্নীর গর্ভজাত সন্তানগণ, পিতা নীচ বংশের কন্যা গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া তাহাকে পরিত্যাগ করিল এবং বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতে লাগিল। ধেই বাগচি মৈত্রেয়ের ভগিনীপতি। বেঁই বাগচি, তাহার পত্নীর অনুরোধে, মধু মৈত্রের বাটিতে তাহার পিতার একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ উপলক্ষে আসিয়া দেখিলেন, মধুর পুত্রগণ চণ্ডীমণ্ডপের মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া পৃথক বাস করিতেছেন। ধেই বাগচির নানা উপদেশে পুত্রগণ পিতার সহিত একত্রিত হইল না। তৎপর ধেই বাগচি মধুর পুত্রগণকে বলিলেন, তোরা বাটির মধ্যস্থলে বেড়া দিয়া এ একটি “কাচ” করিয়াছিস্। এই “কাচ” শব্দ হইতে “কাপ” হইল। মধু মৈত্রের প্রথম বনিতার তিন পুত্র রক্ষতাই, নন্দাই, গদাই এই তিন সহোদর কুলভ্রষ্ট কাপ হইলেন। তাহারা বারি-বিন্দু প্রক্ষেপ দ্বারা অন্যেকেও কাপ করিয়া লইতে লাগিল। মধু মৈত্রেয়ও সমাজে পতিত অবস্থায় আছেন। কিন্তু রাজা কংসনারায়ণ মধু মৈত্রকে কন্যা দান করিয়া, তাহার সমাজের মর্যাদা রক্ষা করিলেন, রাজা কংসনারায়ণ শ্রোত্রিয় হইলেন, কিন্তু নৃসিংহ লাড়ুলির ও রাজা কংসনারায়ণের দৌহিত্রগণ কুলীন পদে প্রতিষ্ঠিত থাকিলেন। এই সময় হইতে কুশবারি সংযুক্ত না হইলে, কেবল শয়নে, ভোজনে, স্পর্শে, বারি-বিন্দু প্রক্ষেপে কুলীনের কুলপাত হইবে না বলিয়া স্থির হইল। কাপের সহিত শ্রোত্রিয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধ হইল, কাপ স্বধর্মে পুষ্ট রহিলেন। এ বিষয় তাহিরপুর ও নাটোর রাজবংশের ইতিহাসে বিস্তারিতরূপে বিবৃত হইবে।

কাপগণের অনেক শাখা। প্রধানত তিন শাখা প্রসিদ্ধ যথা- (১) বারবকাবাদ, (২) সুলতান প্রতাপ, (৩) গঙ্গাতীর। প্রথম দুই শাখা-রাজসাহী প্রদেশের (রাজসাহী ও পাবনা জেলার) অন্তর্গত এবং তৃতীয় শাখা মুরশিদাবাদের অধীন।

(১) হরিপুর, লালুর (লালোর), কাসিমপুর, হাঁসপুর প্রভৃতি স্থানগুলি বারবকাবাদ সমাজের অধীন।

(২) বাক্, কাবারি, কোলা, নয়াবাড়ি, ক্ষেতুপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি সুলতান প্রতাপ সমাজের অধীন।

(৩) খাগড়া, ব্যাসপুর, আচার্যপাড়া প্রভৃতি স্থানগুলি গঙ্গাতীর সমাজের অধীন।

রাজসাহী প্রদেশের কাপ মধ্যে হরিপুর, লালুর, কাসিমপুরের চৌধুরীরা, হাঁসপুরের ভট্টাচার্যেরা, ক্ষেতুপাড়ার রায়েরা এবং কাসিমপুরের লাহিড়িবংশীয়েরা বিশেষ প্রসিদ্ধ। কাপ ক্রমাগত কুলীনে কন্যাদান করিতে পারিলেই কাপের মর্যাদা বৃদ্ধি হইল।

বারেন্দ্র কুলীন ব্রাহ্মণ কুলভ্রষ্ট হইলে কাপ হন এবং কুলীন বলিয়া আর গৌরব রাখিতে না পারিলেও কুলকার্যদ্বারা সর্বদা তাজা থাকেন; কিন্তু রাঢ়ী কুলীন ব্রাহ্মণ কুল ভঙ্গ করিলে, তিন পুরুষ পর্যন্ত কিয়ৎ পরিমাণে কুলীনের মর্যাদা রক্ষা করিয়াও কুলকার্য দ্বারা আর তাজা থাকিতে পারে না