জেন জেড নেতৃত্বাধীন বিপ্লবের এক বছর পর বাংলাদেশ এক নাজুক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে স্থিতিশীল করেছে এবং সংস্কার উদ্যোগ শুরু করেছে বটে, কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। নির্বাচনে বিলম্ব, আত্মবিশ্বাসী ইসলামপন্থী দলগুলোর উত্থান, সংস্কার বাস্তবায়ন ও অতীতের নির্যাতনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জটিলতা, বাড়তে থাকা আইনশৃঙ্খলাহীনতা, ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি, এবং দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকট—সব মিলিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক পুনরুত্থান আবারও পথভ্রষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
গণতান্ত্রিক সমর্থন, বাণিজ্য, উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর দাঁড়ানো ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব ঠিক এমন এক সময়ে টানাপোড়েনে পড়েছে, যখন তা সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল। ২০২৫ সালের শুরু থেকে সহায়তা কমানো, শুল্ক আরোপ এবং অনির্দেশ্য কৌশলগত অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব যখন দুর্বল হয়েছে, তখনই চীন তার উপস্থিতি বাড়াতে তৎপর হয়েছে। এই পিছিয়ে পড়া ঠেকাতে এবং বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের এই রূপান্তরকাল—এবং এর পরেও—আবার দৃঢ়ভাবে সমর্থন জোগাতে হবে। এতে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল ও স্বাধীন গণতন্ত্রে রূপ নিতে পারবে, যা ইসলামপন্থী সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকবে এবং চীনা অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম হবে—ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী হবে।
ভঙ্গুর গণতন্ত্র
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কমিশন গঠন ও সদ্য গৃহীত “জুলাই সনদ”-এর মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কারের ভিত গড়ে তুললেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখনো খণ্ডিত। শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রান্তিক হয়ে পড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দ্রুত নির্বাচনের দাবি তোলা অব্যাহত রেখেছে; অন্যদিকে শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) গভীর সাংবিধানিক পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছে। আগে নিষিদ্ধ থাকা ইসলামপন্থী দল—যেমন জামায়াতে ইসলামী—পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে, যা ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি ক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

আওয়ামী লীগের (আ. লীগ) ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা এবং “অপারেশন ডেভিল হান্ট”—শেখ হাসিনার অনুগতদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানে ৪৮ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে প্রতিশোধমূলক ও বর্জনবাদী রাজনীতির নতুন সংস্করণ ফিরে আসার উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে সামাজিক টানাপোড়েন বাড়ছে: সংখ্যালঘু ও নারীদের ওপর ২,৪০০টির বেশি হামলা, অস্ত্র চুরি, পুলিশকে লক্ষ্য করে ও পুলিশের পক্ষ থেকে হামলা, এবং হিজবুত তাহরীর ও আল-কায়েদা-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর উগ্রপন্থী প্রচারণা—এসব ঘটনার খবর গত আগস্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করে এসেছে। ২০০১ সাল থেকে ওয়াশিংটন নির্বাচনী অখণ্ডতা, আইনসভা ও বিচারব্যবস্থা উন্নয়ন, এবং দুর্নীতি দমনে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে—যে রাজনৈতিক অকার্যকারিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আজ বাংলাদেশ লড়ছে, সেগুলোরই মোকাবিলায়। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধে ৪০ মিলিয়ন ডলার এবং নিরাপত্তা খাত সংস্কারে ৮০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশাপাশি হাজারো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের অভিযোগে অভিযুক্ত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়—যা কার্যকর কিন্তু জবাবদিহিমূলক নিরাপত্তা খাতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারকে স্পষ্ট করে।
তবে সাম্প্রতিক তীব্র সহায়তা হ্রাস এই অর্জনগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যখন সংস্কারপন্থা নিয়ে বিতর্ক চলছে এবং গণতান্ত্রিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো নাজুক, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা নতুন করে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাড়াবে—এবং উগ্রপন্থী ও স্বৈরতান্ত্রিক প্রভাবের প্রতি ভঙ্গুরতা তীব্র করবে। দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সহনশীলতা জোরদার করতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় পুনঃসম্পৃক্ততা এখন অপরিহার্য।

অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার খরচ
বাংলাদেশ–যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্ক এক টালমাটাল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করে; পরে আলোচনার পর তা ২০ শতাংশে নামানো হয়। বাংলাদেশ বেশি পরিমাণে যুক্তরাষ্ট্রের গম, তুলা, গ্যাস ও উড়োজাহাজ কেনার ব্যাপারে সম্মত হলেও ঘটনাটি কৌশলগত অংশীদারদের প্রতি ওয়াশিংটনের অস্থির বাণিজ্যিক অবস্থানের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে—এর ৮৫ শতাংশই প্রস্তুত পোশাক খাত থেকে। ২০২৫ সালের শুরুতে চীন থেকে সরিয়ে পোশাক উৎসের পুনর্বিন্যাসের সুযোগে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শীর্ষ পোশাক সরবরাহকারী হয়ে ওঠে। কিন্তু হঠাৎ শুল্ক বাড়ায় ওয়ালমার্টের মতো বড় খুচরা চেইন অর্ডার স্থগিত করে, বন্দরে জট সৃষ্টি হয়, আর ৪ মিলিয়নের বেশি (মূলত নারী) শ্রমিকের কর্মসংস্থান-নির্ভর আরএমজি খাতে কারখানা বন্ধ ও ছাঁটাইয়ের হুমকি দেখা দেয়।
এই অনিশ্চয়তা এমন সময়ে দেখা দিল, যখন শেখ হাসিনার আমলের বহু বছরের অর্থনৈতিক কুশাসন ও দুর্নীতিতে অর্থনীতি থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার নিঃশেষ হওয়ার পর দেশটি পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখাচ্ছে—রিজার্ভ ২৫.৪৪ বিলিয়ন ডলার, প্রবাসী আয়ে রেকর্ড, এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ৫.৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস। এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিরতা রপ্তানি আয় ও বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ধাক্কার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে—যে দেশে ইতিমধ্যে কঠোর মুদ্রানীতির পথে হাঁটা হচ্ছে এবং ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি চলছে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তাও কমে গেছে। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় ও দ্বিদলীয় সমর্থন পেয়ে এসেছে—২০১৭ সাল থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা, যার মধ্যে ২০২৪ সালে ছিল ৩০০ মিলিয়ন ডলার; এটি বৈশ্বিক মোট সহায়তার ৫৪ শতাংশ।

কিন্তু ২০২৫ সালের মধ্যভাগে “জরুরি জীবনরক্ষা সহায়তা” হিসেবে ৭৩ মিলিয়ন ডলারের ছাড় দেওয়া হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অবদান নেমে আসে বৈশ্বিক বিতরণকৃত মোট তহবিলের ২৫ শতাংশে—যদিও জাতিসংঘের রোহিঙ্গা যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় (জেআরপি) নতুন করে ৯৩৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এর ফলে খাদ্যরেশন কমাতে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-অর্থায়িত ক্লিনিক ও স্কুলের কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে; পুষ্টিহীনতা, রোগব্যাধি ও শিক্ষাবঞ্চনা বেড়েছে—এবং জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রলোভনে ঝুঁকিপূর্ণতার মাত্রা বেড়েছে।
সাম্প্রতিক কংগ্রেসনাল “রোহিঙ্গা গ্যাপ অ্যাক্ট” প্রশাসনকে বাংলাদেশের খাদ্যসহায়তায় “ন্যূনতম মানদণ্ড” মেনে চলতে আহ্বান জানিয়েছে। জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে না—এমন আশ্বাস দিলেও আফগানিস্তানের মতো সাম্প্রতিক সংকট দেখিয়েছে, সহায়তার ঘাটতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উগ্রপন্থা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের টেকসই সমর্থন অপরিহার্য।
শূন্যতা পূরণে চীনের তৎপরতা ঠেকানো
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা কমার সঙ্গে সঙ্গে চীন দ্রুত প্রভাব বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মার্চে ইউনুস ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকে ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থকেন্দ্রিক চুক্তি হয় এবং ২০২৮ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত বাজার-প্রবেশাধিকার বাড়ানো হয়। জুনে চীন তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাংলাদেশগামী ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদলকে ঢাকায় পাঠায়—অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাল সরবরাহ করেও বেইজিং এগিয়ে আসে—ইউএসএইডের ৩৭ মিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি ছাঁটাইয়ের প্রেক্ষাপটে।

নিরাপত্তা খাতে ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে সরবরাহকৃত অস্ত্রের ৭০ শতাংশের বেশি এসেছে চীন থেকে। ঢাকার একটি স্কুলে চীনা তৈরি “এফ-৭” যুদ্ধবিমানের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় ৩০ জনেরও বেশি নিহত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীন-পাকিস্তান তৈরি “জেএফ-১৭” জেট কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে—যা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতে ব্যবহৃত হয়েছে। কক্সবাজারে নতুন নির্মিত বিএনএস পেকুয়া সাবমেরিন ঘাঁটি—যেখানে ছয়টি সাবমেরিন ও আটটি যুদ্ধজাহাজ ভিড়তে পারে—বেইজিংয়ের ভারত মহাসাগরীয় উপস্থিতিকে আরও মজবুত করেছে; যা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দু মনে নাও হতে পারে, কিন্তু একে উপেক্ষা করা কৌশলগত ভুল হবে। চীন এগিয়ে আসছে, আর ওয়াশিংটনের সুনাম টালমাটাল। আশাবাদ থাকলেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে পুনর্জীবিত গণতন্ত্রে বাংলাদেশের রূপান্তর নাজুক—বিভক্তি, অর্থনৈতিক চাপে ক্ষয় এবং বিরূপ স্বৈরতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকিতে ভরা। গণতন্ত্র, বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক দশকের বিনিয়োগ—সবই উল্টে যাওয়ার মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সীমা ছাড়িয়ে যায়: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ আঞ্চলিক উগ্রপন্থার প্রবণতা, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবের মাত্রা, এবং দক্ষিণ এশিয়া–ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলের কৌশলগত ভবিষ্যৎকে সরাসরি প্রভাবিত করবে।
The Diplomat, “Why Washington Can’t Ignore Bangladesh,” ২৭ আগস্ট ২০২৫।
সারাক্ষণ ডেস্ক 
























