ঢাকার দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ১৪.১১.১৯৯৫ তারিখের একটি সংবাদ-শিরোনাম, ‘একই নম্বরের ৫ টাকার দুই নোট।’ সংবাদটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা গেল: “একই নম্বরের ৫ টাকার কাগুজে নোট। নম্বর হচ্ছে খগ ৮৫৮৫১১১।… নোট দুটিতে কোনো প্রকার মুদ্রণত্রুটি নেই। বাঘের মাথার জলছাপ, ভিতরের নিরাপত্তা সুতাসহ সব কিছুই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নোট দুটোকে জেনুইন বলে মন্তব্য করেন।”… একজন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা বলেন, ‘কম্পিউটার-ত্রুটির কারণে একই নম্বর একাধিক নোটে চলে আসতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত নিরীক্ষায় তা ধরা পড়তে বাধ্য।”… একই নম্বরের এবং সম্পূর্ণ আসল চেহারার একাধিক পাঁচ টাকার নোট বাজারে এলো কিভাবে তা এক রহস্য।
আট দিন পরে ২২.১১.১৯৯৫ তারিখের জনকণ্ঠ পত্রিকায় আবার সংবাদ-শিরোনাম, ‘একই নম্বরের ৫ টাকার দুই নোট’ খবরের প্রতিবাদ। এই সংবাদটিরও কিছু অংশ উদ্ধৃত করা গেল “একই নম্বরের ৫ টাকার দুই নোট শিরোনমে ১৪ নভেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদের প্রতিবাদ করে দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিঃ এর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে।…. পত্রিকা অফিস হতে সংগৃহীত নোট দুটির নম্বরের প্রতি খালি চোখে লক্ষ করলেই দেখা যায় যে, দুটির মধ্যে একটি নোটের ক্ষেত্রে খগ ৮৫৮৫১১৯ নম্বরের নোটটির ৯ সংখ্যাটিকে ঘষে ১ বানিয়ে খগ ৮৫৮৫১১১ নম্বরের দুটি নোট বানানো হয়েছে। এর পরও নোট দুটি টেকনিক্যালি পরীক্ষা করেও একটি নোটের ক্ষেত্রে ঐ নম্বর পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।… কোনো কুচক্রীমহল হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে।”
একই নম্বরের দুটো নোটই আসল এবং খগ ৮৫৮৫১১৯ নম্বরের নোটটির ৯ সংখ্যাটির নিচের দিকের সামান্য অংশ ঘষে ১ বানিয়ে খগ ৮৫৮৫১১১ নম্বরের দুটি নোট বানানো হয়েছে-বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের এই অভিমত সম্পূর্ণ ঠিক। কিন্তু হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কোনো কুচক্রীমহল সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টায় এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে-এই অভিমত সম্ভবত ঠিক নয়। কী উদ্দেশ্যে দুটি নোটকে একই নম্বরের বানানো হয়, তার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন ইলিয়াস।
১৯৮৩ সাল। ইলিয়াসের কর্মস্থল তখন খুলনায়। তদানীন্তন এক মাননীয় মন্ত্রী জানালেন যে, বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে জাল নোট বাংলাদেশে আসছে; বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার জন্যেই এই জাল নোট সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানে এমন একজন লোককেও তিনি খুলনায় ইলিয়াসের কাছে পাঠিয়ে দেন। লোকটি বেশ জোর দিয়ে বলে, জাল নোটগুলোর ছাপা এমন নিখুঁত যে জাল বলে মনেই হয় না। বাঘের জলছাপ, সিকিউরিটি গ্রেড-সব কিছুই আছে আসল নোটের মতো। আপনি কোথায় কার কাছে এ নোট দেখেছেন? জিজ্ঞেস করেন ইলিয়াস।
-আমি দূরের এক বন্দরে পাটের ব্যবসা করি। দৌলতপুর এসেছিলাম পাট-বেচার বাকি টাকা আদায়ের জন্য। উঠেছিলাম দৌলতপুরের হোটেল বোরাক-এ। সন্ধ্যার পর একজন অপরিচিত লোক আমার রুমে এসে ব্যবসায়ী বলে নিজের পরিচয় দেয় এবং আমার পরিচয় নেয়। তারপর সে বলে, ভাই, আমি জাল নোটের ব্যবসা করি। বিদেশ থেকে জাল নোট এনে সন্তায় বিক্রি করে দেই। বলতে বলতে লোকটি পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে আমার সামনে ধরে বলে, এই দেখুন, একশ টাকার দুটো নোট। আর দেখুন দুটো নোটের একই নম্বর। তারপর সে পঞ্চাশ টাকার দুটো, দশ টাকার দুটো এবং পাঁচ টাকার দুটো নোট আমার হাতে দিয়ে বলে, দেখুন, এগুলোও জাল নোট। আসল নোট কখনো একই নম্বরের দুটো হতে পারে না। জাল নোট যারা তৈরি করে তাদের পক্ষে প্রতিটি নোটের আলাদা আলাদা নম্বর দেয়া সম্ভব নয়। তাই তারা একই নম্বরের অনেকগুলো নোট তৈরি করে। এগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। নিজের পকেট থেকে একশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা ও পাঁচ টাকার নোট বের করে ওগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখলাম। আসল নোটের মতো অতি চমৎকার ছাপা, বাঘের মাথার জলছাপ, সিকিউরিটি থ্রেড সবই আছ ঐ জাল নোটে। লোকটি বলে, একশ টাকার জাল নোট আমরা চল্লিশ টাকায় বিক্রি করি। আপনি চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে এক লাখ টাকার নোট কিনতে পারেন। আমি অবাক হয়ে কিছু চিন্তা করছিলাম। লোকটি বলে, আপনি বোধহয় ভাবছেন, এগুলো চালানো যাবে না, জাল বলে ধরে ফেলবে। আপনি এ পাঁচ টাকার জাল নোটটা নিয়ে নিচের দোকান থেকে দুটো ফাইভ-ফিফটিফাইভ সিগারেট কিনে আনুন। দেখবেন, দোকানদার এই নোট জাল বলে চিনতেই পারবে না। আমি নোটটা নিয়ে নিচে গেলাম। সে-ও গেল আমার পেছনে পেছনে। দুটো ফাইভ-ফিফটিফাইভ সিগারেট নিয়ে দোকানদারকে আমি পাঁচ টাকার জাল নোটটা দেই। সে সিগারেটের দাম রেখে বাকি পয়সা ফেরত দেয়। আমি বুঝতে পারলাম, এই নোট জাল বলে চেনার সাধ্য নেই কারো। বিদেশ থেকে এরকম জাল নোট এলে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হবে, তাই আমি আমার পরিচিত মিনিস্টার সাহেবের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করেছি। তিনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
লোকটি থামলে ইলিয়াস তাকে জিজ্ঞেস করেন,- আপনি দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনে প্রমাণও পেলেন যে এই জাল নোট চালাতে কোনো অসুবিধা হবে না। তারপর আপনার ইচ্ছে হয় নি এই জাল নোট কেনার?
লোকটি কেমন আমতা আমতা করছিল। তা দেখে ইলিয়াসের সন্দেহ হলো। তিনি বলেন, তারপর কী হলো সব খুলে বলুন। ঘটনা পুরোপুরি না শুনলে তো কিছু করা। সভব নয়।
লোকটি দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলে, স্যার, সে এক দুঃখের কথা। মিনিস্টার সাহেবকেও সে দুঃখের কথা বলি নি।
-স্যার, লোভ করতে গিয়ে কী সর্বনাশটাই না হয়েছে আমার। আপনি যখন কথা দিয়েছেন আমার কোনো বিপদ হবে না, তাই আপনার কাছেই শুধু বলতে পারি।
লোকটি এর পরের ঘটনা বলে যায়। সে বাড়ি গিয়ে দু’দিন পর একশ টাকার চার বান্ডিল নোট অর্থাৎ চল্লিশ হাজার টাকা একটা থলেতে ভরে নির্ধারিত সময়ে এক নির্ধারিত রেস্তোরাঁয় জাল নোটের ব্যবসায়ী লোকটার চার বান্ডিল নোট নেড়েচেড়ে দেখে থলেটা নিজের কাছে নিয়ে রাখে। ব্যবসায়ী তার নিজের থলের মুখ খুলে লোকটিকে দশটি একশ টাকার বাণ্ডিল অর্থাৎ এক লাখ টাকা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে সে বাসে যাবে, না লঞ্চে যাবে। লোকটি বাসে যাবে শুনে ব্যবসায়ী বলে, আপনি বিদেশী মানুষ, এত টাকা আপনার হাতে দিয়ে আপনাকে রাস্তায় ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছি না। দিনে-দুপুরে। যে-রকম ছিনতাই হয় আজকাল। চলুন আমরা আপনাকে বাস পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। আপনাকে বাসে বসিয়ে থলেটা আপনার হাতে দেব।
লোকটি রাজি হয়ে ব্যবসায়ী ও তার সঙ্গীর সাথে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হয়। তারা বড় রাস্তায় না উঠে গলিপথ ধরে হাঁটতে থাকে। আসল নোটের থলে এবং জাল নোটের থলে-দুটোই ছিল জাল নোটের ব্যবসায়ীর হাতে। কিছুদূর যাওয়ার পর দু’জন ইউনিফর্ম-পরিহিত কনস্টেবলকে উল্টো দিক থেকে আসতে দেখা যায়। তাদের মুখোমুখি হতেই জাল নোটের ব্যবসায়ীকে দেখে একজন কনস্টেবল বলে ওঠে, হারামজাদা কামরাইন্যা, তোরেই তো বিচরাইতে আছি, এইবার যাবি কই?
জাল নোটের ব্যবসায়ী পাশের একটা গলি ধরে দৌড়াতে থাকে। কনস্টেবলও তাকে ধরার জন্য তার পিছু ধাওয়া করে। দৌঁড়ে যাওয়ার সময় সে অন্য কনস্টেবলকে বলে যায়, ওর সঙ্গীসাথি সব হারামজাদারে ধরো। ব্যবসায়ীর সঙ্গীটিও ততক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছে। তার পেছনে ছুটছে অন্য কনস্টেবলটি। এদিকে আসল নোটের মালিক বিপদ দেখে দ্রুত পায়ে বড় রাস্তায় উঠে মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে ভাবে, তার ভাগ্য ভালো যে পুলিস তাকে ধরেনি। জাল নোটের কারবার করতে। যাচ্ছিল বলে সে থানায় গিয়ে এজাহারও দিতে পারেনি।
ঘটনার আদ্যোপান্ত শুনে ইলিয়াসের মনে হলো, এটি একটি প্রতারণার মামলা। কনস্টেবল দু’জনও তথাকথিত জাল নোটের ব্যবসায়ীর লোক।
প্রতারকদের পাকড়াও করা অতি জরুরি। একজন বিশ্বস্ত লোক ঠিক করে ঠিকাদার সাজিয়ে দুপুরবেলা পাঠিয়ে দেওয়া হলো হোটেলে বোরাক-এ। তার কক্ষের পাশেরটায় ওঠে আরেকজন বিশ্বস্ত লোক। সেই কক্ষে আস্তানা গেড়ে ইলিয়াসের একজন ফিল্ড অফিসার ও দু’জন ওয়াচার দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে।
সন্ধ্যার পর ঠিকাদারের কক্ষে ঢুকে জাল নোটের ব্যবসায়ী তাকে একই নম্বরের দুটি করে বিভিন্ন নোট দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে যে ঐগুলো জাল নোট। চল্লিশ হাজার টাকা দিলে সে এক লাখ টাকার ঐ জাল নোট নিতে পারে, আশি হাজার টাকা দিলে
দু’লাখ। ঠিকাদারের সংকেতসূচক কাশি শুনে ওয়াচার ও সাক্ষী নিয়ে ফিল্ড অফিসার লোকটিকে তথাকথিত জাল নোটসহ গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামিকে রিমান্ডে এনে অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, নোটগুলোর কোনোটাই জাল নয়। আসল নোটের যেগুলোর নম্বরের শেষ সংখ্যাটি ৯ তার নিচের দিকের ফুটকিসহ সামান্য অংশ ব্লেডের সাহায্যে উঠিয়ে কালো চাইনিজ কালি দিয়ে নিপুণ হাতে সংখ্যাটিকে ১ বানানো হয়। একই নম্বরের দুটো নোট তৈরি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকের মনে বিশ্বাস উৎপাদন করা যে সত্য সত্যই বিদেশ থেকে হুবহু আসল চেহারার জাল নোট আসছে। প্রলুব্ধ লোক রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় নিজেদের সঞ্চিত বা জমি-বেচা টাকা নিয়ে এসে এভাবে প্রতারিত হয়। জাল নোটের ব্যবসায়ী নোটের বাণ্ডিল বলে তার শিকারকে যা দেখায় তা নোটের আকারে কাটা কাগজের বাণ্ডিল যার ওপরে থাকে একখানা বা দু’খানা নোট। কনস্টেবল দু’জন সম্বন্ধে সে বলে যে ওরা জাল পুলিশ ছিল না, আসল নোটের মতো ওরাও আসল পুলিশ। ওরা দু’জনই রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স-এর সেপাই। খুলনার রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স-এর কমান্ড্যান্টকে বলে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অপরাধী দু’জন সেপাই-এরই গোঁফ ছিল। প্যারেড-এর দিন দেখা গেল তাদের গোঁফ নেই। গোঁফ চেঁচে ফেলা সত্ত্বেও ধৃত আসামি অনেক সেপাই-এর মধ্য থেকে দুজন অপরাধী সেপাইকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
অতএব দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে নয়, প্রতারণা বা ছিনতাইয়ের মতলবেই এই অপকর্ম করা হয়। বিনা আয়াসে ধনী হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে শিকার তাদের সঞ্চিত টাকা নিয়ে প্রতারকদের খপ্পরে গিয়ে পড়ে। আর এই প্রতারণার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, অপরাধের সাথে নিজেরাও জড়িত মনে করে প্রতারিত ব্যক্তি থানায় গিয়ে এজাহারও দিতে পারে না।
আবু ইসহাক 



















