প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টার্মার রবিবার বিকেলে যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এটি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিতে এক বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পটভূমি ও শর্ত
গত জুলাইয়ে স্টার্মার জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল যদি গাজায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তির পথে না আসে, তবে যুক্তরাজ্য তার অবস্থান পরিবর্তন করবে। নতুন ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার বহুদিনের নীতি থেকে সরে আসছে, যেখানে বলা হয়েছিল স্বীকৃতি কেবল শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবং সর্বোচ্চ প্রভাবের সময়ে আসবে।
সমালোচনা ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করছে ইসরায়েলি সরকার, জিম্মিদের পরিবার এবং কিছু কনজারভেটিভ নেতা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এটি সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করার শামিল। একইসঙ্গে জিম্মিদের পরিবার খোলা চিঠিতে স্টার্মারকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তিনি জিম্মি ফেরত না আসা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন।
যুক্তরাজ্যের যুক্তি
ব্রিটিশ মন্ত্রীরা বলছেন, নৈতিক দায়িত্ব থেকে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যাতে শান্তির সম্ভাবনা টিকে থাকে। তারা গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে দুর্ভিক্ষ ও সহিংসতার ছবি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের এক কমিশন সম্প্রতি অভিযোগ করেছে, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়েছে। যদিও ইসরায়েল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বসতি সম্প্রসারণ ও দুই-রাষ্ট্র সমাধান
ব্রিটিশ সরকার বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণের দিকে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। বিচারমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, বিতর্কিত ‘E1 প্রকল্প’ কার্যকর হলে একটি টেকসই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আশা শেষ হয়ে যাবে। এ কারণেই যুক্তরাজ্য স্বীকৃতির পথে এগোচ্ছে।
ফিলিস্তিন ও লেবার পার্টির অবস্থান
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সম্প্রতি লন্ডনে স্টার্মারের সঙ্গে দেখা করে এ প্রতিশ্রুতি স্বাগত জানিয়েছেন। ডাউনিং স্ট্রিট জানিয়েছে, উভয়পক্ষ একমত যে ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি সরকারের কোনো ভূমিকাতে হামাস থাকবে না। লেবার পার্টির ভেতরে বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিন স্বীকৃতির দাবি ছিল, এবং স্টার্মারের ওপর এ বিষয়ে চাপ বাড়ছিল।
কনজারভেটিভ ও মার্কিন প্রতিক্রিয়া
কনজারভেটিভ নেতা কেমি বাডেনোখ বলেছেন, তিনি দুই-রাষ্ট্র সমাধান চান। তবে এখনই স্বীকৃতি দেওয়া মানে সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও লন্ডন সফরে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পর্তুগাল, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াও এ পথে এগোচ্ছে। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের প্রায় ৭৫% ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যদিও এখনও তাদের কোনো রাজধানী বা সেনাবাহিনী নেই। ফলে এ স্বীকৃতি মূলত প্রতীকী।
দুই-রাষ্ট্র সমাধান
দুই-রাষ্ট্র সমাধান বলতে বোঝানো হয় পশ্চিম তীর ও গাজায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চল ইসরায়েল দখল করে রেখেছে, ফলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই।
সমালোচকদের প্রশ্ন
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন কেন যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের জন্য শর্ত রেখেছে, কিন্তু হামাসের জন্য নয়। চিফ রাবাই স্যার এফ্রেইম মিরভিস বলেছেন, স্বীকৃতি ঘোষণায় জিম্মি মুক্তি বা শান্তিপূর্ণ শাসনের কোনো শর্ত নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
গাজা পরিস্থিতি ও হতাহতের সংখ্যা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়, যেখানে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হয়। এরপর থেকে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় অন্তত ৬৪,৯৬৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের ভাষায়, গাজার বর্তমান অভিযান ‘বিধ্বংসী বিপর্যয়’ সৃষ্টি করেছে।
সারসংক্ষেপে, যুক্তরাজ্যের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একদিকে ইসরায়েল ও তাদের সমর্থকরা বলছে এটি সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে যুক্তরাজ্য দাবি করছে এটাই শান্তি প্রক্রিয়া বাঁচানোর শেষ সুযোগ।