কিমেল স্থগিতাদেশ ও তাৎপর্য
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের চাপের মুখে এবিসি টকশো উপস্থাপক জিমি কিমেলকে হঠাৎ স্থগিত করা হয়েছে। ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (FCC) কিমেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয়, বিশেষ করে তিনি রক্ষণশীল কর্মী চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তকে নিয়ে মন্তব্য করার পর। এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ও বিনোদন জগতে বড় ধাক্কা দিয়েছে এবং বাকস্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি করেছে।
FCC চেয়ারম্যান ব্রেন্ডন কার সতর্ক করেন, স্থানীয় টিভি স্টেশনগুলো যদি “আবর্জনা” কনটেন্ট প্রচার চালিয়ে যায়, তবে তাদের সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।
আমেরিকান মিডিয়ার ডানপন্থী ঝোঁক
ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর বড় বড় মিডিয়া ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ডানপন্থী ঝোঁকের দিকে যাচ্ছে। সিবিএস, মেটা প্ল্যাটফর্মস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস তাদের সম্পাদকীয় নীতি ও কার্যক্রমে পরিবর্তন এনেছে, যা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সমালোচনা কমানোর পথ তৈরি করছে।
অ্যানেনবার্গ স্কুল অব কমিউনিকেশনের অধ্যাপক ভিক্টর পিকার্ড বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় মিডিয়া সংস্থাগুলো ডান দিকে হেলে পড়ছে। এই ধারা আরও বাড়বে, কারণ এর বিপরীতে কোনো শক্তি নেই।”
অরাকলসহ রক্ষণশীল ব্যবসায়ীরা টিকটকের মার্কিন শাখা কিনতে এগিয়ে রয়েছে। এর ফলে ১৭ কোটি মার্কিন নাগরিকের ব্যবহৃত এই জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম রক্ষণশীল নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে।
মিডিয়ার ওপর বাড়তি চাপ
এবিসি–এর মূল কোম্পানি ওয়াল্ট ডিজনি এর আগেও ট্রাম্প সম্পর্কিত মামলা মেটাতে ১৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছিল। সাংবাদিক জর্জ স্টেফানোপোলাসের মন্তব্য নিয়ে করা সেই মামলায় সমঝোতা হয়েছিল।
হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া
হোয়াইট হাউস মুখপাত্র অ্যাবিগেইল জ্যাকসন বলেন, “জিমি কিমেল খারাপ রসিকতা করতে স্বাধীন, কিন্তু কোনো কোম্পানি অজনপ্রিয় অনুষ্ঠানের জন্য ক্ষতির ঝুঁকি নেবে না। এটি বাকস্বাধীনতার নয়, প্রতিভার সমস্যা।”
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রক্ষণশীল অগ্রগতি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে। ইলন মাস্ক টুইটার কিনে “এক্স” নামে চালু করেন এবং কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণকারী দল ভেঙে দেন। এরপর প্ল্যাটফর্মে ডানপন্থী কনটেন্ট বেড়েছে।
মেটা তাদের ফ্যাক্ট–চেকিং প্রোগ্রাম বন্ধ করেছে এবং ট্রাম্প–ঘনিষ্ঠ ডানা হোয়াইট ও জোয়েল কপলানকে নেতৃত্বে এনেছে। মার্ক জাকারবার্গ জানুয়ারি মাসে বলেন, “আমরা খুব বেশি ভুল করেছি এবং অনেক সেন্সরশিপ করেছি। এখন স্বাধীন মতপ্রকাশের মূলনীতিতে ফেরার সময়।”
মিডিয়া একীভূতকরণে ট্রাম্প–ঘনিষ্ঠ প্রভাব
FCC সম্প্রচার লাইসেন্সের পাশাপাশি মিডিয়া একীভূতকরণের অনুমোদনেও গুরুত্বপূর্ণ। ডেভিড এলিসন স্কাইডান্স মিডিয়ার মাধ্যমে প্যারামাউন্ট কিনতে সক্ষম হন, আর প্যারামাউন্ট এখন ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারি কিনতে প্রস্তুত হচ্ছে। অন্যদিকে অরাকল টিকটক অধিগ্রহণের চেষ্টা করছে। ফলে সংবাদ ও বিনোদন শিল্পে রক্ষণশীল শক্তির প্রভাব আরও বাড়বে।
সহজ না কঠিন পথ
FCC চেয়ারম্যান কার অভিযোগ করেন, কিমেল দর্শকদের বিভ্রান্ত করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা সহজ পথে বা কঠিন পথে করতে পারি।” এই সতর্কতার পর নেক্সস্টার মিডিয়া গ্রুপ কিমেলের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এরপর তার সময়সূচিতে চার্লি কার্ককে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।
আদালতে মিডিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্প
২০২০ সাল থেকে ট্রাম্প বড় বড় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অন্তত নয়টি মামলা করেছেন। এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিরুদ্ধে ১৫ বিলিয়ন ডলারের এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিরুদ্ধে ১০ বিলিয়ন ডলারের মামলা রয়েছে।
সম্প্রতি একজন ফেডারেল বিচারক টাইমস–এর মামলাটি খারিজ করে দেন। তিনি বলেন, আদালত রাজনৈতিক প্রতিশোধের জায়গা নয়।
বাকস্বাধীন তার জন্য হুমকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে সমালোচকদের দমন করার প্রয়াস। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক জামিল জাফের মতে, এটি আমেরিকায় মুক্ত বক্তব্যের জন্য গভীর হুমকি।
কাটো ইনস্টিটিউটের ডেভিড ইনসেরা বলেন, “বাইডেন আমলে রক্ষণশীলরা অভিযোগ করেছিল সরকার তাদের বক্তব্য দমন করছে। এখন ট্রাম্প প্রশাসন একই যুক্তি ব্যবহার করছে সেন্সরশিপের জন্য।”
জিমি কিমেলের স্থগিতাদেশ কেবল একজন টকশো উপস্থাপকের ঘটনা নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও বাকস্বাধীনতার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের মুখে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের অবস্থান বদলাচ্ছে, যা আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক সংকেত।