আসাদের পতনের পর নতুন সংকট
দীর্ঘদিনের শাসক বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার নয় মাস পর সিরিয়া নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি। বর্তমানে দেশটির নেতৃত্ব দিচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। একদিকে ঘন ঘন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অন্যদিকে ইসরায়েলের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং নতুন সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আবার নতুন করে মাথা তুলেছে ইসলামিক স্টেট বা আইএসআইএস।
আইএসআইএসের পুনর্গঠন
২০২৪ সালে আসাদ সরকারের পতনের পর থেকে আইএসআইএস সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। তারা শুধু নতুন সরকারকেই নয়, খ্রিস্টান, শিয়া ও কুর্দিদের মতো সংখ্যালঘুদেরও টার্গেট করছে। ২০১৪ সালে এই গোষ্ঠী একসময় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। বর্তমানে যোদ্ধার সংখ্যা কমে প্রায় ২,৫০০ হলেও, বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে তারা আবার সংগঠিত হচ্ছে।
হামলার ধরন ও বিস্তার
আইএসআইএসের হামলা এখন আরও ঘন ঘন, লক্ষ্যভেদী ও উন্নত কৌশলে পরিচালিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের জুনে এক আত্মঘাতী হামলাকারী দামেস্কের একটি গ্রিক অর্থোডক্স গির্জায় বিস্ফোরণ ঘটায়—২৫ জন নিহত ও ৬৩ জন আহত হয়। এরপর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একাধিক হামলা চালিয়ে তারা চেকপয়েন্ট ও সরকারি যানবাহন টার্গেট করে। ২০২৪ সালে আইএসআইএস ২৯৪টি হামলার দায় স্বীকার করে, যা ২০২৩ সালের দ্বিগুণেরও বেশি।
নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঝুঁকি
এই হামলাগুলো নতুন প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সুন্নি, আলাওয়ি ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছেই। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফলে জনগণের মধ্যে বড় আকারে সন্ত্রাসী পুনর্জাগরণের শঙ্কা বাড়ছে।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রভাব
পরিস্থিতি আরও জটিল হবে যদি ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণামতো প্রায় ২,০০০ মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়। ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল আইএসআইএস-বিরোধী বৈশ্বিক জোটের মূল চালিকা শক্তি। মার্কিন সমর্থন ছাড়া সিরিয়ার নতুন সরকার বা কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) একা এই হুমকি মোকাবিলা করতে পারবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৬ সালের পরও মার্কিন বাহিনীকে আংশিকভাবে রাখতে হবে, যাতে গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সহায়তা অব্যাহত থাকে।
বিভক্ত সিরিয়ায় আইএসআইএসের সুযোগ
বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষকে কাজে লাগিয়ে আইএসআইএস নতুন যোদ্ধা নিয়োগে ব্যস্ত। তারা প্রমাণ করতে চায়, সরকার জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। সম্প্রতি জাতিসংঘও সতর্ক করেছে, সিরিয়ার বিভাজন আইএসআইএসকে আবার আন্তর্জাতিক হুমকিতে পরিণত করতে পারে।
২০২৫ সালের মার্চে লাতাকিয়ায় সুন্নি-আলাওয়ি সংঘর্ষের পর আইএসআইএস এসডিএফকে টার্গেট করে একাধিক হামলা চালায়। মে মাসে দামেস্কের দক্ষিণে সংঘর্ষের পরও তারা হামলা বাড়ায়। একই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার বৈঠকের অল্প কিছুদিন পর সিরিয়া ও ইরাকে আইএসআইএস একযোগে বোমা হামলা চালায়। এতে সিরিয়ার সেনাদেরও প্রথমবার টার্গেট করা হয়।
প্রচারণা ও মতাদর্শগত যুদ্ধ
আইএসআইএস নিয়মিত অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে শারা ও এইচটিএসকে আক্রমণ করছে। তারা শারাকে “ইহুদি এজেন্ট” আখ্যা দিচ্ছে এবং এইচটিএসকে অবিশ্বাসী ও মার্কিন-ইসরায়েলি পুতুল বলে প্রচার করছে। ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলা সিরিয়ার ভেতরে বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে, যা আইএসআইএস কাজে লাগাতে চাইছে।
মার্কিন প্রত্যাহার ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
মার্কিন বাহিনী ধীরে ধীরে ঘাঁটি ছেড়ে দিচ্ছে এবং সৈন্যসংখ্যা কমাচ্ছে। ইরাকেও একই পরিকল্পনা চলছে। ফলে পুরো বৈশ্বিক জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও মার্কিন সেনা কমান্ডাররা অন্তত ৫০০ সেনা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, প্রশাসন তা কমাতেও পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য
ট্রাম্প-শারা বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে সরাসরি সহায়তা বাড়িয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে অন্তত আটটি আইএসআইএস হামলা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াকে পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টায় চাপ দিচ্ছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। এখনই সেনা সরিয়ে নিলে সিরিয়া নতুন করে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারে। এতে শুধু আইএসআইএস নয়, হিজবুল্লাহর মতো ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোরও শক্তি বাড়বে।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের প্রয়োজন
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই সিরিয়া ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। বরং নিরাপত্তা কাঠামোকে শক্তিশালী করতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা দরকার। সিরিয়ার নতুন সরকারকে বৈশ্বিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হলে যৌথ প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম আরও কার্যকর হবে। যদিও শারার অতীত নিয়ে অনেক দেশ দ্বিধায় আছে, কিন্তু আইএসআইএসকে স্থায়ীভাবে পরাজিত করতে হলে নতুন সরকারকে অন্তর্ভুক্ত করাই একমাত্র পথ।
সিরিয়ার ভঙ্গুর বাস্তবতায় মার্কিন সেনা প্রত্যাহার আইএসআইএসের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে। যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাস দমনে করা আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পরিকল্পিত সেনা প্রত্যাহার না করে সিরিয়ায় সীমিত উপস্থিতি বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা রাখা।